রবিবাসরীয় গল্প
অন্তর্ঘাত
লকা বাঁকে ঘুরে যাওয়ার পর রমাকে ফোন করল শুভ
ফোন ধরলেন না কেন?
বাড়িতে লোক ছিল।
শুভ বিজয়ার প্রণাম নেবেন।
আর কিছু দেবে না?
চুপ করুন।
কী করছ?
পড়ছি। সেকেন্ড পেপারটা শেষ করলাম।
চুল দু’ভাগ করে সামনে এনেছ?
না। পেছনে বেঁধে রেখেছি।
ম্যাক্সি পরে আছ?
কী করে বুঝলেন?
দেখতে পাচ্ছি। ব্রা নেই।
ইস!
প্যান্টিও নেই।
ওফ্! আচ্ছা আপনি অন্য কথা বলতে পারেন না? একটু গল্প করার জন্য ফোন করলাম। নিঃশব্দে হেসে টুক করে ফোন কেটে দিল শুভ। একেবারে অফ করে দিল, যাতে এখন আর ধরতে না হয়। অলকা আসছে।
আজ ভিজেছি, জানেন।
বৃষ্টি হয়েছে তোমাদের ওখানে?
একটু আগে। গোধূলির কমলা আলোর মধ্যে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। এমন আগে দেখিনি।
তোমাদের বাড়ির সামনে তো একটা পুকুর আছে।
সেটা দেখবার জন্যই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিকেলের জল দেখলে তো মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু সেই জলে ঝাঁপানো বৃষ্টির ফোঁটা দেখে নেচে উঠতে ইচ্ছে করছিল আজ।
সত্যি নাচলে?
খুব চাইছিলাম, জানেন। থাকতে না পেরে শেষে নেমে গেলাম রাস্তায়।
ভিজলে?
অল্প। মা এসে চুলের মুঠি ধরে পিঠে দুমদুম করে দুটো কিল মেরে নিয়ে গেল।
ঠিক করেছেন।
মাকেও ডাকছিলাম তো। মা দেখো দেখো কী দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে, তুমিও ভিজবে এসো ব্যস, তার পরই ওই...
মাকেও ভিজতে ডাকছিলে?
কী হয়েছে তাতে? অমন নতুন বৃষ্টিতে ভিজতে কে না চায়?
তোমার মা-ই চান না শুধু।
মজা পাচ্ছেন তো, মার খেলাম বলে?
কিছুটা মজা পাচ্ছি, কিন্তু অনেকটা দুঃখ।
মানে?
ভেজা বিকেলের রঙে তোমায় দেখা হল না। গ্রিলের ফাঁকে পা তুলে দিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসেছিল শুভ। শেষ বিকেলের আলো বড় বড় গাছের সবচেয়ে উঁচু পাতা থেকে ফুরিয়ে যাচ্ছিল। শব্দ করে ফিরে আসছে পাখিরা। হাওয়ায় হাল্কা শীত। একটা পাতা গোধূলির আলো নিয়ে পায়ের কাছে এসে পড়ল।
এই সময়টা সাধারণত রমাকে ফোন করে না শুভ। জানে ও এখন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে। সারা দিন ক্লাসের পর মুখে ক্লান্তির কালি। হয়তো বাসে দাঁড়িয়ে। কিংবা ট্রেন ধরার জন্য ছুটছে। কিন্তু বিকেলের এই একা আলোয় বসে অকারণ এক কাতরতায় ফোন করতে বাধ্য হল। করে অবশ্য বুঝল আজ রমা বিশ্ববিদ্যালয় যায়নি। ক’দিন ধরে খুব বাজে স্বপ্ন দেখছি, জানেন।
স্বপ্ন তো! বাজে-ভালতে কী এসে যায়।
কী যে বলেন! মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে।
স্বপ্ন দেখে?
শুধু স্বপ্ন নয়, এখানে একটা খারাপ ব্যাপারও ঘটেছে।
এখানে মানে? তোমার বাড়িতে?
না, আমাদের পাড়ায়। আমারই বন্ধু ছিল মেয়েটা, বিয়ে হয়েছিল বছরখানেক আগে। ওর বর ছিল আমার দাদাদের বন্ধু। পরশু বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল।
সে কী! মেয়েটা এখন কোথায়?
শ্বশুরবাড়িতেই। কিন্তু ওখানে কি থাকবে? কী হবে বলুন তো?
মেয়েটা কি চাকরি-টাকরি করত?
না।
শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারবে না। নিজের বাড়িতেই ফিরে আসতে হবে।
যদি চাকরি করত?
তা হলে তো তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করত সে কী করবে। এখন কি আর তার বোঝা টানতে চাইবে পরের বাড়ির লোকেরা?
পরের বাড়ি মানে? ওটাই তো...
নিজের বাড়ি ছিল, যতক্ষণ ওর বর বেঁচে ছিল
কত সহজে বলছেন, না?
সত্যি কথা বলছি। এখন বুঝতে পারছ তো, তোমার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক?
ও সব কথা এখন থাক। ভাল লাগছে না। রমার এই কথায় সন্ধ্যার লুকনো অন্ধকারকে খুঁজল শুভ এবং টের পেল তারা দু’জনেই সেই অস্পষ্টতার দিকে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে।
এর মধ্যে যে এক রকম ভাল লাগাও আছে, সেটা ধরতে পেরে শুভ আরও উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ঠিক করল, বৈশাখের হাওয়ায় দূরের বাড়ির জানলার পর্দার মতো এই আনন্দটুকু মনে কিছু দিন দুলিয়ে রাখবে। রমার সঙ্গে কয়েক দিন কথা বলবে না। রমার ফোন এলেই এলোমেলো ভাবে কয়েকটা বোতাম টিপে দিত সে, যাতে বোঝানো যায় ফোনটা ঠিকমতো কাজ করছে না। এ ভাবে একটা সপ্তাহ প্রায় কাটাতে পারল। তোমার স্বপ্নের কথা বলো
রমার সঙ্গে আবার এক দিনের কথোপকথনের মাঝখানে বলল শুভ। না, শুনলে আপনি হাসবেন।
হাসির হলে হাসব। প্লিজ বলো।
খুব জলের দৃশ্য দেখছি। শুধু জল চার দিকে, আমি ভাসছি।
জলের ওপরে ভাসছ?
আরে বাবা, নৌকো বা কোনও কিছুতে আছি। সে সব তো মনে নেই আর। শুধু দেখছি চার দিকে জল, কোনও কূল নেই কোত্থাও, কোনও দিকেই। কিন্তু মনে হচ্ছে যে কোনও সময় কূল পেয়ে যাব, অথচ পাচ্ছি না।
আর?
আজকে দেখলাম, আমি হাওয়াই দ্বীপে গেছি।
হাওয়াই? গেছ নাকি সেখানে সত্যি, আগে?
কী মনে হয় আপনার?
তা হলে বুঝলে কী করে যে সেটা হাওয়াই, হনলুলু নয়?
ছাড়ুন, আপনার সঙ্গে কথা বলব না।
আচ্ছা আচ্ছা বলো। শুধু যদি একটু ধরিয়ে দিতে যে জায়গাটা হাওয়াই বলে তুমি কী করে চিনলে...
আপনি কোনও দিন স্বপ্ন দেখেননি, না?
স্বপ্নেই তো তোমাকে...
আজেবাজে কথা বলবেন না। স্বপ্নে যা দেখেন সব হুবহু মনে করতে পারেন জেগে উঠে?
একদম না। সব তো ছেড়েই দাও, তুমি যে হাওয়াই নামটা মনে রাখতে পেরেছ...
ওই নামটুকুই শুধু। নামটা তো শোনা ছিল। কিন্তু আসল কথা হল সেই দ্বীপে আমি একা। চার দিকে জল।
কূলে তো পৌঁছে গেছ তা হলে।
তাই, না?
শুভ দেখতে পেল উদাসীন আত্মকৌতুকের ভঙ্গিতে কথাটা বলল রমা, চেয়ারের হাতলে ওর হাত, চিবুকে আঙুল রেখে বাইরের সর্বনাশের দিকে তাকিয়ে। আজ সারাদিন তোমায় ফোনে পেলাম না।
আর বলবেন না। ভেবেছিলাম দোলের দিন দরজা বন্ধ করে বসে পড়ব শুধু। রং ছোঁবোই না। কিন্তু আটটা দশ-পনেরো নাগাদ মামিমারা, মাসি, মাসির মেয়ে, আরও প্রায়... মানে সব মিলিয়ে সাত-আট জন দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল।
এত নরম দরজা তোমাদের? কয়েকটা মেয়ের ছোঁয়ায় ভেঙে পড়ল?
শুনুন না। তার পর তো শুরু হল রং খেলা। কোত্থেকে যে এত রং আনল, সব্বাই একেবারে ভূত।
তুমিও?
তবে না তো কী! আমাকে পুঁটুলিতে ভরে সরিয়ে রেখে সবাই রং খেলল?
তোমার সারা গায়ে রং?
কী যে অবস্থা আমার সে আমিই জানি।
মানে?
বলছি যে রং দিয়ে ভূত করে দিয়েছে।
মুখে?
মুখে, হাতে, গলায়।
বুকে?
আপনি না!
হাসছ কেন? বলো না, বুকেও দিয়েছে?
দিয়েছে যান।
দুটো বুকেই দিয়েছে?
চুপ করবেন আপনি!
তুমি ওদের বুকে দাওনি?
হ্যাঁ, আমিও দিয়ে দিয়েছি।
তোমার এই হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ার কয়েকটা স্টিল যদি ধরে রাখা যেত! বিকেলে কী করলে?
বলেছিলাম না দোলের দিন সন্ধেয় আমরা সব্বাই মামাবাড়িতে বসে গান-নাচ-খাওয়াদাওয়া করি।
গিয়েছিলে?
ওমা! যাব না?
না, তুমিই তো বলছিলে পড়া অনেক বাকি আছে, এখন আর কিচ্ছু করব না...
সে তো ঠিকই, শুনুন না থার্ড পেপারের কোয়েশ্চেন কে করবেন কিছু জানেন?
এখনও ঠিক হয়নি।
আপনারটায় কিন্তু শুধু নামকরণটা করছি।
এক কথা একষট্টি বার বলে কী লাভ বলো তো তোমার?
একশো বাষট্টি বার বলব। কী করবেন আপনি?
আমি শুধু এক বার তোমার নীচের ঠোঁটে কামড় দেব। কাল ফোনটা ধরলেন না কেন?
তুমি বিয়েবাড়ি যাবে বললে যে।
আমি যাব বলে আপনি ফোন ধরবেন না কেন? আপনার তো বিয়েবাড়ি ছিল না।
গিয়েছিলে?
না গিয়ে উপায় আছে?
কী পরে গেলে?
আমার নিজের তৈরি মেখলা।
মেখলা কথাটার মধ্যেই একটা ডানা মেলা আওয়াজ আছে, তোমার বলায় তা আরও টের পেলাম।
তুমি পারো তৈরি করতে?
আরও কিছু কিছু কাজ পারি আমি, আপনি দেখেছেন, ভুলেও গিয়েছেন।
ভুলব কেন? আমার ঘরে তো এখনও তোমার সেই কাজটা আছে, মেরুন রঙের শাড়ির জমিতে সেলাইয়ের কাজ, একটি মেয়ে জল তুলছে কুয়ো থেকে।
এখনও আছে?
এখনও বলতে আমি... আচ্ছা তুমি হঠাৎ কথা এ ভাবে ঘুরিয়ে ধরছ কেন?
কোথায়? আপনিই তো বলেছিলেন বউদি কাজটার দিকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভাবে তাকান।
ও হো! তুমি সেই কথাটা মনে রেখে দিয়েছ? ধুর, ওটা বোকার মতো বলেছিলাম, ওর কোনও মানে নেই।
যাক গে, আসলে আপনাকে একটা কথা বলব বলে কাল বিয়েবাড়ি থেকে ফিরেই ফোন করেছিলাম।
কী কথা?
কাল একটা কাণ্ডই করেছি। বাবা তো সব সময় খুব রেগে থাকে আমার ওপর। ক’দিন ধরে কথাই বলছে না।
কেন?
জানি না। হাজার কারণ।
সে কী! তুমি এত কাজ করো বাড়ির, বাজার করো, দোকানে যাও, জামাকাপড়ের ব্যাগ সাইকেলে বেঁধে লন্ড্রিতে নিয়ে যাও, আমি তো নিজে দেখেছি...
চাকরি তো করি না।
এখনই কী চাকরি করবে তুমি? লেখাপড়া করছ তো।
বাবার মুখে সারাক্ষণ একই কথা তুমি কোনও রোজগার করো না, এক পয়সা বাড়িতে দাও না, ফলে যে ভাবে বলব, সে ভাবে চলতে হবে।
যাক গে, তো কী হয়েছে কাল?
বাবা আমাকে দু’বার দেখেছে ফোনে কথা বলতে। ব্যস, এমন রেগে গিয়েছে যে বাইরের দরজাটা বন্ধ না করেই শুয়ে পড়েছে। আমার ওপর রাগে, বুঝলেন তো! আর আমিও দরজা খোলা না বন্ধ না দেখেই শুয়ে পড়েছি।
এই রে!
আর বলবেন না। সারা রাত দরজা খোলা ছিল। সকালে বাবাই তো প্রথম ওঠে, উঠেই দেখে দরজা খোলা। তখন থেকেই শুরু চিৎকার। আমিও সমানে চেঁচিয়েছি।
তুমি চেঁচাবে কেন? তোমারই তো অন্যায়।
আমার?
তোমার না? তুমি এক বার দেখবে না?
শুনুন, আমি বাড়ির নব্বই ভাগ কাজ...
ফোনটা যতটা পারা যায় স্বাভাবিক ভাবে কেটে দিয়ে গলা অবিকৃত রেখে শুভ বলতে লাগল
যাক গে শোনো, তোমার পারিবারিক ব্যাপারে মন দেওয়ার আমার কোনও উৎসাহ নেই। দয়া করে আমার নোটটা ফেরত দাও, বইটাও সেই কবে থেকে রেখে দিয়েছ, মহা মুশকিল তোমাদের নিয়ে...
বলতে বলতেই শুভ বুঝল, অলকা দরজার পাশ থেকে নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.