|
|
|
|
বিষনীলে ফের অমৃত |
কে বলল, পয়লা বৈশাখে নতুন কিছু নেই? জীবনটা তো
একটা
ট্রেজার-হান্ট ট্রেজার-হান্ট খেলা।
চলুন হাতে একটা
বড় টর্চ
নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
গ্রিক-দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, ‘এক নদীতে দু’বার স্নান করা যায় না।’ ধাঁধা লাগে প্রথম শুনলে। একই নদী, একই ভাবে বয়ে চলেছে কূলকিনারা পার করে, তবে দু’বার ডুব দেওয়া যাবে না কেন? কিন্তু হেরাক্লিটাস বলবেন, যে জলে আগের দিন স্নান করেছ সে জল তত ক্ষণ পাড়ি দিয়েছে মোহনা পেরিয়ে সমুদ্রে। তা হলে? জল নতুন হলে, নদী পুরনো কী করে হয়? এ হে! এক গাল মাছি। সত্যিই তো, ভেবে দেখিনি। ভাবনাটা পুরনো, কেবল ‘নতুন’ কেমনে নতুন, এই ভাবনার রসদ জুগিয়ে চলে নদীর মতোই।
এত জটিল ব্যাপারস্যাপার ছেড়ে, আসুন, বরং সকালবেলা নিয়ে কিছু কথা বলি। গোটা দিনমান কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে কাটিয়ে দেওয়াটা ‘নিত্য’ বিশেষণটিকে জুত করে বোঝাতে পারে। অথচ দেখুন, একটা করকরে নতুন দিন আমরা পেয়েছিলাম। একটা ভরভরন্ত সকালবেলা। ‘সকালবেলা’ কিন্তু আমায় মাথার দিব্যি দেয়নি যে আগের দিনের মতোই ছ্যাতরানো, ধূসর মন নিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে, সকাল আটটা তিনের আগে কিংবা পরে ব্রাশ করা যাবে না, আজ মাখন-পাউরুটির বদলে লেড়ো বিস্কুট আর জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে পারবেন না। আসলে পুরনো ‘আমি’টাকে নিয়েই যত্ত ঝামেলা, সে নিজের মতো রুটিন বানিয়ে নিয়েছে আর সব্বার হাতে মাথা নিচ্ছে এই বলে কেন দুপুরের দিকে আকাশ বা গাছ থেকে টপ করে নতুন নতুন এক্সাইটমেন্ট তার কোলটিতে পড়ছে না। সে কিছুতেই মনে রাখছে না, আজ তার নতুন জীবনের প্রথম দিন। এ কি একটা ধম্মের কথা হল?
আপনি সত্যি করে বলুন তো, জীবনে দ্বিতীয় প্রেমে পড়ার সময় একই রকম ভাবে পেটের মধ্যে প্রজাপতি ফড়ফড়ায়নি? এক বারও ভেবেছিলেন, প্রথম প্রেমের কালশিটের ওপর সাতাশ বছর বয়সে ফের প্রজাপতি এসে বসবে? কিন্তু বসেছে তো! বসন্তের অঙ্গীকার আর অভিজ্ঞান ফের সত্য বলেই মনে হয়েছে। তার গালের তিল নতুন রকম ভাল-লাগা ছড়িয়েছে। অথচ তার পর একটু বয়স হলেই বলবেন, ‘আর প্রেম-ট্রেম হয় না।’ হয় মশায়, হয়। আপনি স্বীকার যান না বা পুরনো ভেঙে নতুনের কাছে যেতে পারেন না। ভয়, লজ্জা, সংশয় বড় বেদনার হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে। কিন্তু তাতে ‘নতুন’ প্রেম মনে টোকা দেওয়া বন্ধ করে কি? যদি বলি, নতুন গ্রহণ করতে গেলেও তো কিছু না কিছু বেদনা পেতে হয়। নতুন জুতোয় ফোসকা পড়ে না? না নতুন গেঞ্জির সাইজ-ট্যাগটা ঘাড়ের কাছে দাগ বসায় না? তখন কি আমরা ফোসকা বা দাগের ভয়ে নতুনকে ত্যাগ করি? করি না। হয় শুশ্রূষা করি, নয় কেটে বাদ দিই। এ বার আপনি কোন দলে সে আপনার ব্যাপার। তাই বলে ‘নতুন’ প্রেম হয় না, এমনটি বলা চলবে না, প্রেম না-করা চলবে তো না-ই।
তার পর যেমন ধরুন মানুষ। আপনি কুড়ি বছরে যেমন ছিলেন, এখন কি তেমন? কুড়ি বছরে ঝলমলে, তরতাজা, হ্যাপি গো লাকি বিশেষণ আপনার কপালে, নাকের পাশে কিংবা হাসিতে ঝুলিয়ে রাখতেন। আর এখন হয়েছেন (ধরুন আপনার মধ্য-চল্লিশ) খেঁকুড়ে, অন্যের ভাল-য় হিংসুটে, লোভী, তেলচিটে টাইপের একটা মানুষ। তা হলে আপনি নতুন হলেন না? কুড়িতেও নতুন, তিরিশেও নতুন, আবার বাহান্নয়। মিড-লাইফ ক্রাইসিস জীবনে কিছু না হোক সাঁইত্রিশ বার থাবা বসায়। প্রথমটা তিরিশে, শেষটা সাতষট্টিতে। প্রত্যেক বার নতুন হতাশা নিয়ে এবং প্রত্যেক বার নতুন ঝুঁকি আর সুযোগের পসরা সাজিয়ে। হাত বাড়িয়ে পাকড়াতে পারলে আপনি হতে পারেন আব্রাহাম লিংকন বা নিতান্ত ভিখিরি, না পারলে অবশ্যই ভিখিরি।
এক জন ভারী সাধারণ মানুষ সারা জীবন নিষ্ঠার সঙ্গে কেরানিগিরি করেছেন, সংসারধর্ম পালন করেছেন। কিন্তু হঠাৎ কোনও পরিস্থিতির চাপে খুন করে বসলেন পাড়ার মাস্তানকে। আপনি-আমি কেউ বিশ্বাস করতেই পারব না, তাই না? যে লোকটা সারা জীবন এত মিতভাষী আর ভাল, সে আজ কী করে খুনি হয়ে যায়? যায়। আসলে হতেই পারে সাতান্ন বছরে এই পরিস্থিতি উদয় হয়নি, তাই তার এই রূপ বেরিয়ে আসেনি। তা হলে? মানুষটাকে নতুন চিনলেন তো? আসলে কী জানেন, মানুষ প্রতিটি মুহূর্তে আলাদা। আপনার ত্বকের কোটি কোটি কোষ প্রতি নিমেষে মরে যাচ্ছে, নতুন কোষ জন্মাচ্ছে। প্রেমিকের গালে এক সেকেন্ড আগে যে চুম্বন আঁকলেন, এখন দ্বিতীয় চুম্বনের জন্য নতুন গাল জন্ম নিয়েছে। মনোগত ভাবে তো বটেই, বায়োলজি-বই-গত ভাবেও! মানুষের জীবনটা অনেকটা পৃথিবীর সূর্যকে আবর্তন করে যাওয়ার মতো। যখন আলোটা নির্দিষ্ট জায়গায় পড়ে তখন সেই জায়গাটা আলোকিত হয়ে ওঠে, বাকিটা ঢাকা আর অন্ধকার। অতএব গোটা জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে নতুনত্ব শেষ হচ্ছে না।
এ সব কচকচির চেয়ে বরং চলুন হাতে একটা বড় টর্চ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। জীবনের যে কোণগুলো দেখাশোনা হয়নি, চেনাচিনি হয়নি, বন্ধুত্ব হয়নি সেই গলিঘুঁজির সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। এক মোড়ে পাব হয়তো তোবড়ানো টিনের কৌটো বেরং মাটি ভর্তি, অন্য মাঠে মস্ত টেডি বেয়ার, পেয়ারা গাছের তলায় পাখি-খাওয়া আধখানা পেয়ারা আর ছেলেধরার ঝুলিতে আখরোট-খোবানি! আসলে জীবনটা একটা ট্রেজার-হান্ট ট্রেজার-হান্ট খেলা। জলদস্যুর মতো এক চোখে কালো ঠুলি বেঁধে ঝপাং যদি গহীন জলে লাফ না-ই দিলাম, কে বলতে পারে গুপ্তধনের সোনা কিংবা তুলসী চক্রবর্তীর পরশপাথর চুপে চুপে রয়েই গেল গয়নার বাক্সে।
ফের কে বলল রে, পয়লা বৈশাখ একই ঘ্যানঘেনে! গাছপাকা সব। অ্যাম্বায় নেই, অম্বায় আছে। |
|
|
|
|
|