|
|
|
|
বেহালখাতা খোলার দিন |
উৎসবের মোড়কে পুরে না নিলে, নিত্য দিনের স্বেদগন্ধী জীবনটাকে একটু পালিশ না করে নিলে জীবন বাঁচে না।
নিরঞ্জনকে মোহাঞ্জন পরিয়ে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। তাই নববর্ষকে পয়লা বৈশাখ করে নিয়েছি
আমাদেরই মতো, আমোদ-আহ্লাদে, হুজুগে-হিড়িকে অ-সাধারণ। শিশির রায় |
পড়শি রাষ্ট্র যখন পয়লা বৈশাখ দিনটাকে রীতিমত ঢুকিয়ে নিয়েছে হৃদয়ে-রক্তে, বৈশাখী উৎসবকে রূপ দিয়েছে একটা জাতিসত্তার ‘কার্নিভাল’-এ, গঙ্গার এ পারে আমরা তখন হুজুগে বাঙালিয়ানার দেখনদারির মোচ্ছবে আকুল। তন্নিষ্ঠ মনন আর স্নিগ্ধ উৎসবমুখরতা যে কোথাও নেই তা নয়, কিন্তু সব কিছুরই ওপরেই একটা দায়সারা, মধ্যমেধার পোঁচ আমাদের একদা-রুচিমান অন্দর অন্তরকেও কেমন বেআব্রু করে গিয়েছে। আমরা তাই পয়লা বৈশাখকে স্টেট হলিডে’র ওপরে উঠতে দিলাম না, বাংলা বছরটাকে কেবল মনে রাখলাম বেণীমাধব শীল কি মদন গুপ্ত অথবা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা-পাতায়, বিয়ে-অন্নপ্রাশন-উপনয়ন-শ্রাদ্ধকর্মের অপরিহাযর্তায়, আর দু’মাস ছ’মাস পর পর একটা পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণ কি এগারোই জ্যৈষ্ঠ কি সংক্রান্তির দিনগুলোয়। বাংলা ক্যালেন্ডার এখন রেড পান্ডার মতোই এক বিরল প্রজাতি (যদিও বা দেখবেন তো পাতাগুলো ঝ্যালঝেলে, ধুস্! বাইরের ঘরে টাঙানো যায় না), তারও পাতায় পাতায় সগর্ব ইংরিজির তলায় ম্লানমুখ বাংলা তারিখের সাব-অল্টার্ন উপস্থিতি, অমাবস্যা-পূর্ণিমা লাল-কালো, একাদশীগুলো আধখাওয়া বান-রুটি। রিন্টুমাসি আর দিদু-ঠাকুন ছাড়া কেউ দ্যাখেই না!
গোড়ার কথাটায় আসি। আজকের মেট্রোসেক্সুয়াল, কসমোপলিটান বাঙালি-জীবনে কি আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে নতুন একটা বাংলা বছরের, বা পয়লা বৈশাখের? ক’জন বাঙালি জানেন বঙ্গাব্দ প্রচলন করছেন রাজা শশাঙ্ক (ইংরেজি ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে যাঁর রাজত্ব, আর তাই বাংলা সন-তারিখ প্রায় ছ’শো বছর পিছিয়ে আছে ইংরেজির চেয়ে), আর বাংলা ক্যালেন্ডার মুঘল সম্রাট আকবরের উপহার (উপহার বলাটা ভুল হল, কৃষি-কর আদায়ের সুবিধার্থেই মুসলিম হিজরি ক্যালেন্ডারের বদলে বাংলা দোসরের আবির্ভাব)? ক’জনই বা জানি, বাংলা মাসের নামগুলো এসেছে কাব্যকথা থেকে নয়, আকাশে নক্ষত্রদের অবস্থান থেকে, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠায় জ্যৈষ্ঠ, উত্তরাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণায় শ্রাবণী, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, পুষ্যা, চিত্রা থেকে একে একে আশ্বিন, কার্ত্তিক, পৌষ, চৈত্র? আর জানলেও বা, কী এমন জ্ঞানভাণ্ড হলুম? সব কিছুর মূলেই তো সময়, মহাকাল। কালেরই নিয়মে ‘বর্ষা আসে, বসন্ত’, চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ, ১৪১৮ পেরিয়ে উনিশে পা। প্রকৃতিরই অমোঘ বিধানে যদি এত সব কিছু, তবে শুধু একটি ‘নতুন’ দিন নিয়ে, আর একটি ‘নতুন’ বছর নিয়ে কেন এই মাতামাতি? রাত পেরিয়ে দিন আসছে, আহ্নিক গতির নিয়মেই আসবে। মাস গড়িয়ে বছর আসবে, এর চে’ বোরিং, সাধারণ ব্যাপার আর কী আছে? |
|
সত্যিই তো, ভেবে দেখলে, কোথায় আর নতুন সব কিছু, বা কোনও কিছু? যে সূর্যকে প্রায় দেড়শো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরের পৃথিবী থেকে রোজ দেখছি পুব দিকে উঠতে, আলো দিতে, তারও অন্তরে কিন্তু নিউক্লিয়ার ফিউশন-এ প্রতি পলে হাইড্রোজেন ভেঙে যাচ্ছে হিলিয়ামে। প্রতি মুহূর্তে সে-ও কি আর একই থাকছে ছাই? পৃথিবীতে পৌঁছতে সূর্যের আলোর সময় লাগে মিনিট আটের একটুখানি বেশি। তার মানে, আকাশে যে এখুনি জলজ্যান্ত সূর্যটাকে দেখছি, সে তো এই এখনকার সূর্য নয়, আট মিনিট আগের সূর্য! মহা ভজকট ব্যাপার! বিজ্ঞান কিন্তু এই সতত পরিবর্তনশীলতার পরপারে কোনও এক পারমানেন্ট অবিনশ্বরকে ছুঁতে চেয়েছে বরাবর। রসায়নশাস্ত্র এ বিষয়ে এগিয়েছিল অনেকটাই। দেখা গেল, আগুন, যাকে কিনা আমরা পোড়াতে, ধ্বংস করতে দেখেছি, সে নাকি আদতে যাকে পোড়ায়, তার অন্তঃপদার্থগুলিকে এ দিক-ও দিক করে মাত্র, দহনকার্যের আগে যে উপাদানগুলো ছিল, পোড়ার পরেও তারা থাকে, ভিন্ন গঠনে। তখন ভাবা হল, অণুকে ধ্বংস করা যায় না। বস্তুজগতে পরিবর্তন মানে তা হলে অণুর মতো কিছু স্থায়ী উপাদানের রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট কেবল। কিছু পরে তেজস্ক্রিয়তা এসে অণুদের হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল, পদার্থবিদরা নেচে উঠলেন ইলেকট্রন-প্রোটনের আপাত-অবিনশ্বরতায়। হা হরি, পরে দেখা গেল, ইলেকট্রন-প্রোটনও মিলছে, ভাঙছে, তবে আর ‘ম্যাটার’-এ নয়, এনার্জিতে। দেখা গেল, এই বিশুদ্ধ ‘এনার্জি’ও কিন্তু আগেকার মতো কোনও বস্তুর অন্তঃপদার্থের রিঅ্যারেঞ্জমেন্ট নয় আর, তার রূপ অন্য। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যাও বলল, আকাশের গ্রহ-তারাগুলি চিরস্থায়ী নয়, নয় নতুন-পুরাতনও। গ্রহগুলি এসেছে সূর্য থেকে, সূর্য নেবুলা থেকে। অনেক অনেক বছর তারা থাকবে বটে, কিন্তু কোনও এক শেষের সে দিনের মহাবিস্ফোরণের পর জেগে থাকবে শুধু এক বায়বীয় সত্তা। তখন কোথায় আর আপনার বৈশাখী-বাবুয়ানি, কোথায় হালখাতার নেমন্তন্ন!
উদাস-বিরস বিজ্ঞান-দর্শন ছেড়ে এ বার একটু হাসুন, আসুন রবীন্দ্রনাথে। আমাদের এত কাছের মনের মানুষটির কথা আজকের দিনে বলব না, তাই হয়? ওঁর ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোর পাতা উল্টে পেলাম অনিন্দ্যসুন্দর কিছু মণিমাণিক্য। নতুন বছরের ‘শুরু’, পুরনোর ‘শেষ’ এই দুইকে কী সুন্দর ভাবের ব্যাপ্তিতে মিশিয়েছেন ‘বর্ষশেষ’ প্রবন্ধে: ‘আজ বর্ষশেষের সঙ্গে কাল বর্ষারম্ভের কোনো ছেদ নেই একেবারে নিঃশব্দে অতি সহজে এই শেষ ওই আরম্ভের মধ্যে প্রবেশ করছে।’ শেষ, অন্ত যে আমাদের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। সত্যি তো, নতুন একটা বছর, নতুন একটা দিন মানে তো সেই অন্তিমের দিকে, মৃত্যুর দিকেই আর একটা বছর, আর একটা দিন এগিয়ে যাওয়া। বর্ষশেষ মানে তাই রবীন্দ্রদর্শনে ‘মৃত্যু’কে চিনতে পারা, ‘ক্ষমা’ করতে পারা। ‘সব যায়, চলে যায়, আমরাও যাই, এই বিষাদের ছায়ায় সর্বত্র একটি করুণা মাখিয়ে দিয়েছে।... এই বিদায়ের সুরটি যখন কানে এসে পৌঁছয় তখন ক্ষমা
খুবই সহজ হয়ে যায়, তখন বৈরাগ্য নিঃশব্দে এসে আমাদের নেবার জেদটাকে দেবার দিকে আস্তে আস্তে ফিরিয়ে দেয়।’ কী ঋদ্ধ এই ভাবনা, যা যাওয়ার জিনিস, তাকে যেতে দেওয়া, রাগ-অসূয়াকে নতুন বছরে টেনে নিয়ে না যাওয়া, পুরনো বছরের সঙ্গে বছর-ভর জমে ওঠা ক্লিন্নতার ভারা নামিয়ে, ‘ক্ষমা করে ক্ষমা নিয়ে নির্মল হয়ে’ নব বৎসরে প্রবেশ করা, স্তব্ধ, শান্ত, পবিত্র হয়ে!
দিনগত-পাপক্ষয়ের জীব আমরা, না জানি বিজ্ঞান, না রবীন্দ্র-মনন। শ্রীজাত’র সুনীলের কবিতার মতো, আমাদের এই ‘যত্তসব যাচ্ছেতাই ধুত্তেরি’ জীবনে ‘অসংখ্য প্রতিশ্রুতির ওপর শ্যাওলা জমে’, মনে হয় পৃথিবীতে এত দুঃখ, ‘মানুষের দুঃখই শুধু তার জন্মকালও ছাড়িয়ে যায়।’ নতুনেরা বছর-কে বছর পুরনো হয়, তবু কোনও দিন চিরচেনা, বা অচেনা কারও কাঁধে আলতো হাত ছুঁয়ে পরম মমতায় বলে ওঠা হয় না, এই যে, ভাল আছেন? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসের শেষটার মতো, উত্তর শোনার জন্যও তো এক মুহূর্ত কেউ দাঁড়ায় না আজকাল। এক ভুল ভাঙতে না ভাঙতে নতুন নতুন ভুলের মধ্যে প্রবেশ করে মানুষ। এই কলকাতা শহরেই, আমার এক একলা বন্ধু গাছেদের সঙ্গে থাকে। তার বসার ঘরে গাছ, ছাদে গাছেদের মেলা পাতাবাহার, ক্যাকটাস, দোলপূর্ণিমা (গাছের যে এত সুন্দর নাম হতে পারে আমি জানতামই না)। গাছেদের জন্য, গাছেদের ছেড়ে সে কোথাও যেতে পারে না, যায়ও না। ক’দিন আগের প্রথম কালবোশেখির দিন সে আমায় এসএমএস করেছিল: আমার গাছগুলো ডাল, পাতা মেলে দিয়ে আনন্দে নাচছে। আমি আর ওরা আনন্দে ভিজছি। আমার মনে হয়েছিল, এই তো, হঠাৎ নববর্ষাতেই ওদের কী সুন্দর, নিরাকার নববর্ষ! পাড়াগাঁয়ে থাকা এক বৃদ্ধাকে মাসে ছ’মাসে ফোন করি আমি, নতুন বছরেও। একাকিনী তিনি, ফোনে কথা বলতে গিয়ে অযথা আনন্দে, আবেগে তাঁর গলা কেঁপে যায়। ফোনের এ পারে আমি অনুভব করি তাঁর কল্যাণকর স্পর্শ। আমার পৃথিবী নতুন
হয়ে ওঠে।
এইগুলোই তো পাওয়া। হয়তো তাই উৎসবের মোড়কে পুরে না নিলে, নিত্য দিনের ধূলামলিন, স্বেদগন্ধী জীবনটাকে একটু পালিশ না করে নিলে, জীবন বাঁচে না। আমরা মানুষেরা, বঙালিরা তাই নববর্ষকে পয়লা বৈশাখ করে নিয়েছি নিতান্তই আমাদের মতো, আমোদ-আহ্লাদে, হুজুগে-হিড়িকে থকথকে। মহাকাল-মহাকাশের অব্যর্থ-অমোঘ নিদানকে অস্বীকার করে একটি বিশেষ দিনকে করে তুলেছি অ-সাধারণ। নিরঞ্জনকে মোহাঞ্জন পরিয়ে দেখতেই হয়তো আমরা অভ্যস্ত। ‘শুভ নববর্ষ’ তাই অন্য দিনের ঘড়ির কাঁটা মেনে চলা বাবুর কাছেই একটু আলসেমির, একটু প্রশ্রয়ের অন্য রকম একটা দিন। ‘পয়লা বৈশাখ’ তাই আপামর বাঙালি মনের এক অনবদ্য ‘মেন্টাল কনট্রাস্ট’, একটু বেচাল হওয়ার, বেহালখাতা খোলার দিন। বাড়াবাড়ি আরও একটু বেশি হলে, ক্ষতি কী? না হয় গেম্টা লাভেই হারলাম আজ!
সক্কলে ভাল থাকুন, ভাল রাখুন।
শুভ নববর্ষ। |
|
|
|
|
|