|
|
|
|
বুকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ |
|
তাঁর গানই প্রাণের আরাম। গর্বের ধন। আর, ইতিহাস বলবে,
একসময় গানের ক্ষেত্রে ভারতজুড়ে দাপট ছিল বাঙালিদের। মান্না দে |
|
বেঙ্গালুরুর বাড়িতে একা বসে থাকি। মাথায় ভিড় করে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান। কী করে গানে গানে এত নিখুঁত ছবি এঁকে গেছেন তিনি! আজ সকালেই নিজের মনে গাইছিলাম, ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়’। গানটা গাইলেই মনে একটা ছবি ভেসে ওঠে।
বাংলা গানে বাঙালির প্রধান গর্ব? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারও কথা ভাবতেই পারি না। খুব খারাপ লাগে, যখন শুনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি বাংলার নতুন প্রজন্মকে টানে না। আমি তো এই বয়সেও ভাবি, রবীন্দ্রসঙ্গীতের নতুন অ্যালবাম যদি করতে পারি! স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, শ্রাবণী সেনের মতো মহিলারা খুব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত করেন। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে নতুন পুরুষ কণ্ঠ পাওয়া যায় না, এটাই বিস্ময়কর। অনেকে ভাবেন, গান না শিখেই রবীন্দ্রসঙ্গীত করা যায়। এটা খুব বিপজ্জনক প্রবণতা।
বাংলা গান নিয়ে আমার আর একটা আক্ষেপ, এই বাংলায় নজরুলগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি, অতুলপ্রসাদী বা রজনীকান্তগীতি এখন সে ভাবে চর্চা হয় না। বাংলাদেশে দেখেছি, নজরুলগীতির চর্চা দারুণ। প্রচুর লোকে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গায়। এটা দারুণ ভাল ব্যাপার।
রবীন্দ্রনাথ বাদে বাংলা গানের আরও একটা গর্ব করার দিক আছে। একটা সময় বাঙালি সঙ্গীত পরিচালক, গায়কগায়িকার দাপট ছিল ভারত জুড়ে। মুম্বইতে অনিলদা (বিশ্বাস), শচীনদা (দেববর্মন)-এর যুগ থেকে সলিল, পঞ্চম বা বাপীরা সবাই বাংলার প্রতিনিধি। কিশোরকুমার, গীতা দত্ত থেকে আজকের শ্রেয়া ঘোষাল, কার কথা বলব? শ্রেয়া ভবিষ্যতে লতা, আশার জায়গাটা নেবে, এটা আমার বিশ্বাস। |
আত্মার শান্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। |
বাংলা গানে আইকন? আমার কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কথা মনে পড়ছে সবার আগে। যে ভাবে দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও ঝড় তুলেছিলেন গানে, অবিশ্বাস্য। রেকর্ড থেকে মঞ্চ কত রকম বাংলা গান গেয়েছিলেন। তার পরে শচীনদা। আসবেন পঙ্কজ মল্লিক মশাই। ছোটবেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতে পঙ্কজবাবু আমাদের আইকন ছিলেন। পরে যেমন হয়ে উঠেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। মনে আছে, এক রাতে ফাংশান সেরে আমাদের সিমলার বাড়িতে ফিরে রেডিয়ো খুলেছি। দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত হচ্ছে। শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলেছিলাম।
আমি নিজে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের খুব ভক্ত। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে যন্ত্রসঙ্গীতে বাঙালির অবদান নিয়ে কিছু বলতে পারব না। বাংলা আধুনিক গানের আইকন বলতে আমার কাছে দু’জনই থাকবেন। হেমন্তবাবু আর সন্ধ্যাদি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমার চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু ওঁকে আমি সন্ধ্যাদিই বলি। হিন্দি গানে মহম্মদ রফি আর লতা মঙ্গেশকরকে আমার ইন্সটিটিউশন মনে হয়। বাংলা গানে ওই দু’জন তাই।
হেমন্তবাবুর ওই ঐশ্বরিক কণ্ঠের তুলনা হয় না। সহজ সুরে বাঙালির মন জয় করেছেন। আমি নিজে যখন বাংলা গান করতে এসেছি, তখন ইচ্ছে করে ওঁর পথ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি, বাংলা গানে অন্য ধারা তৈরির। আবার হেমন্তবাবুর বাংলা গান শুনে অনেক শেখার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে স্বর প্রেক্ষণ। পঙ্কজ মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত জনপ্রিয় করার পিছনে হেমন্তবাবুরও একটা বড় ভূমিকা ছিল।
সন্ধ্যাদির রেওয়াজি কণ্ঠে নানা বৈচিত্র্য। আরতি (মুখোপাধ্যায়) বাংলা সিনেমায় নানা বৈচিত্র্যের গান করেছে। কিন্তু বাংলা গানে সামগ্রিক ভাবে সন্ধ্যাদি তুলনাহীন। মুনাওয়ার আলি খানের কাছে গান শিখতেন। মেলোডির সঙ্গে প্রতিটি গানে ছিল শিক্ষার ছাপ।
এই মানুষগুলোই বাংলা গানের বড় সম্পদ। ভাবতে ভাল লাগে, এঁদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। সারা জীবন ধরে হিন্দি গানই বেশি করেছি। বেশ কয়েক হাজার। তবু এখন যে বয়সে পৌঁছেছি, তাতে সারাক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীতই শুনি। আর মাঝে মাঝে মনে হয়, আরও যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারতাম! বুকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকেই রেখে দিয়েছি। |
|
|
|
|
|