বাঙালির অতীত অহঙ্কার তো অনেক কিছু নিয়েই! তার সাহিত্য! তার সংস্কৃতি! তার রবীন্দ্রনাথ! যুগ পরিবর্তনের এত বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মধ্যে তার সাংস্কৃতিক নিজস্বতাকে রক্ষা করতে পারা! তার উত্তমকুমার! তার সুচিত্রা সেন! পুরনো আমলের সেই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল! যারা গোটা দেশের ফুটবলকে শাসন করত!
আমি অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে অতীতের মনুমেন্ট নিয়ে নাড়াচাড়ায় বিশ্বাসী নই। আমার কাছে বরং পরিষ্কার হিসেব হল এখন আমরা কী করছি? ভবিষ্যতেই বা কোন দিকে যাচ্ছি? আর সেটা আদৌ ঝকঝকে দেখাচ্ছে কি না?
আমার কাছে কৃতী বাঙালির শংসাপত্র বোধ হয় অন্য রকম। আমার কাছে তিনিই কৃতী বাঙালি যিনি আসানসোল আর লিলুয়াতে রাজত্ব করেই থেমে যাননি। যিনি তাঁর কর্মকাণ্ডকে এমন প্রসারিত আর গুরুত্বপূর্ণ করতে পেরেছেন যাতে গোটা ভারতে তাঁর ছায়া পড়েছে। হয়তো বা বিশ্বেও।
অমর্ত্য সেন সমসাময়িক যুগের তেমনই এক জন মানুষ যিনি বাঙালিকে খ্যাতিমান করেছেন আরও। নোবেলজয়ী এক জন মানুষ আমাদেরই সময়ে বাস করছেন। বিদেশে উন্নততর শিক্ষা আর গবেষণার কাজে সব সময় পড়ে রয়েছেন বাঙালির বিশাল গর্ব তো অবশ্যই। কিন্তু আমার কাছে অনুপ্রেরণামূলক মানুষ হিসেবে ভীষণ প্রিয় হলেন লক্ষ্মী মিত্তল। আমি ইংল্যান্ডে তাঁর কাজকর্মের পরিধি নিজের চোখে সামান্য বোঝার সুযোগ পেয়েছি। অসাধারণ! এই শহরেরই এক জন মানুষ একেবারে সাধারণ অবস্থা থেকে লড়াই করে নিজস্ব উদ্যমে আজ কোথায় পৌঁছেছেন। আমরা একই কলেজ থেকে বি কম স্নাতক। সেন্ট জেভিয়ার্স। লক্ষ্মী মিত্তলের উত্থান থেকে এটাই মেসেজ জীবনে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়!
লিয়েন্ডার পেজ আমার ছোটবেলার বন্ধু। সে যে কী অসম্ভব সফল আন্তর্জাতিক বাঙালি! লিয়েন্ডারের যা গ্রান্ড স্লাম ডাবলস খেতাব, অবিশ্বাস্য! কোর্টে লিয়েন্ডারের দিকে এক ঝলক তাকালেই অবশ্য পরিষ্কার, কী করে ও এত বছর এমন খেলতে পারে। বরাবরই টেনিসের জন্য লিয়েন্ডারের এই প্যাশনটা সাঙ্ঘাতিক। আর জেতার খিদে। দুইয়ে মিলে যে পরের পর চ্যাম্পিয়নশিপ জিতবে, তা আর আশ্চর্য কী!
নিউ এজ বাঙালিকে লিয়েন্ডারের এই দু’টো গুণ আয়ত্ত করতেই হবে। অবশ্য যদি তারা বড় মঞ্চে ধারাবাহিক সাফল্য চায়।
সুব্রত রায় সহারাশ্রী। আমার আর এক জন খুব কাছের মানুষ। এক জেনারেশন ব্যবসায়ী। অথচ কোথা থেকে কোথায়! বরাবরের প্রবাসী। কিন্তু আমার কাছে এঁর লড়াইটাও ভীষণ আকর্ষণীয়। এক বার উনি টানা তিন দিন চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করেছিলেন। টানা ৭২ ঘণ্টা। শুনলে মনে হয় সাফল্য কি আর রোজকার দুধের প্যাকেট যে বাড়িতে এনে দুধওয়ালা ফেলে দিয়ে গেল! সাফল্যের জন্য নিজেকে তৈরি হতে হয়। যন্ত্রণা পেতে হয়। হাড়ভাঙা খাটতে হয়।
আমার মনে হয় আধুনিক বাঙালির অ্যাটিটিউডে কোথাও বড় গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। মনোভাব পাল্টাতে হবে। অন্যের সমালোচনা করে বসে থাকলে চলবে না। নিজেকে তৈরি করতে হবে। ঝুঁকি নেওয়া শিখতে হবে। আমার কাছে বাঙালির আসল অহঙ্কার নিজের রাজ্যের বাইরে প্রভাব সৃষ্টিতে। চলচ্চিত্র জগতে অনেক কৃতী বাঙালি ছিলেন। আছেন। যাঁরা জাতীয় পর্যায়ে ভীষণ সম্মানিত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেমন। ওঁর দাদাসাহেব ফালকে পাওয়াটা বাঙালির কাছে ভীষণ খুশির। টালিগঞ্জে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কাজ করে যাওয়ার ধরন আর পেশাদারিত্ব মনে রাখার মতো।
প্রবাসে সফল।
মিঠুন চক্রবর্তী। |
কিন্তু আমাকে যদি ব্যক্তিগত ভাবে কেউ জিজ্ঞেস করেন, আমি অতীতের অনেক বরণীয় নামের আগে মিঠুন চক্রবর্তীর কথা বলব। মুম্বইতে বসে মিঠুনদার বাকি ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে চাওয়ার উদ্যমটা আমায় সাঙ্ঘাতিক টানে।
নতুন সময়ের বাঙালিকে সবার আগে তার ভাবমূর্তি বদলাতে হবে। বাকি ভারত যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে বাংলায় কোনও কিছু হয় না, নড়ে না চড়ে না, এই দৃষ্টিভঙ্গি আর জমাট হতে দেওয়া চলবে না। মাঝে মাঝে বাঙালির মনোভাব দেখে সত্যি হতাশ হয়ে পড়ি। ভাবি কত রাস্তা যে যাওয়া বাকি! আমি যা করেছি সেটাই সেরা, আর বাইরের লোক কিছু জানে না এই ধ্যানধারণা ত্যাগ করতে হবে। বাইরের লড়াইটা কিন্তু খুব হিংস্র, উগ্র আর পেশাদারি। তার জন্য নিজেকে তৈরি করা আর মনোভাব বদল করাটা ভীষণ, ভীষণ দরকারি।
নিউ এজ বাঙালিকে আবার মনে করিয়ে দিই, ভাইরা, লিলুয়া, আসানসোলে রাজত্ব করে ভারতের রাজা হওয়া যায় না! |