শনিবারের নিবন্ধ
নতুন বাবু

শুভঙ্কর আর সমাপ্তি। সাউথ সিটির পেন্ট হাউসে ষাট পেরনো দু’জন। আমেরিকাতে ছেলে-মেয়ে। ইংরেজি কাগজ পড়লেও আনন্দবাজার ছাড়া ঘুম ভাঙে না। ‘ভিনদেশি তারা’ সিনেমায় বেশি ভাল না সিডিতে এ নিয়ে তুমুল তর্ক করেন। ‘কিং লিয়ার’-এর টিকিট না পেয়ে মন খারাপ করেন। ‘দেশ’ পত্রিকার ধারাবাহিক নিয়মিত পড়েন। এ হেন শুভঙ্কর আর সমাপ্তি আজ সারা দুপুর হেমন্ত-সন্ধ্যা শুনবেন। বিকেলে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ বা ‘আবার ব্যোমকেশ’ দেখতে যাবেন লাগোয়া মাল্টিপ্লেক্সে। সেখান থেকে বড় রেস্তোরাঁর বাঙালি খানা। যাত্রা শুরু সিঙ্গল মল্ট আর শেরি দিয়ে। সঙ্গে গন্ধরাজ ভেটকি। তার পর ফ্রেঞ্চ ওয়াইন। সঙ্গতে থাকবে লুচি আর ডাকবাংলো চিকেন। আর শেষ পাতে ভাপা সন্দেশ। একটু সুগার আছে। সে আর কী করা। হাজার হোক বচ্ছরকার দিন।
যেমন সুন্দর আর নন্দিনী। গতকাল সন্ধ্যাবেলায় ওরা ক্লাবে প্রি-পয়লা বৈশাখ করতে গিয়েছিল। বাংলা গান, বাংলা খাবার। তবে অন্যটা বাংলা নয়। সাগরপারের। ক্রিসমাস বা হোলির আগের রাতে যে রকম নাচানাচি হয়, তেমনই হল। সুন্দর আজ স্নান করে ধুতি-পাঞ্জাবি পরবে। সারা বছর তো মাল্টি-ন্যাশনালের কোট-প্যান্ট-টাই, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন আর সাগর পারের ক্লায়েন্ট সামলানো। তাই আজ ও ভীষণ খুঁতখুঁতে। পাঞ্জাবির মাড়, ধুতির কোঁচানো এমনকী নন্দিনীর ঢাকাইয়ের রং, সব কিছু একদম মনের মতো যেন হয়। ওর বাবা যেমন পরতেন। ওর মা যে রকম সাজতেন। হাজার হোক বচ্ছরকার দিন।
যেমন বরানগরের নন্দা আর সৃজিত। দু’জনের আলাদা আলাদা কাজের জায়গা। একজন উত্তরে সারাদিন আর অন্যজন গভীর দক্ষিণে। দু’জনেই নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। তারপর কোনও দিন ফিল্ম ক্লাবে ইরানি ছবি দেখা আর নয়তো বাড়ি ফিরে কলেজের ডাঁই খাতা। ছুটির দিনটা বাড়ির কাজ আর গড়িমসি।

বেরনোটা মেনুতে থাকে না। আজ ফন্দিটা অন্য।
একটু দেরি করে বিছানা ছেড়ে তারপর একেবারে সোজা বেরিয়ে পড়া। দু’বাড়িতে প্রণাম করে সোজা নন্দন চত্বর। সারাদিন সেখানে কাটিয়ে অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখে গোলবাড়ির মাংস আর রুটি কিনে বাড়ি। হাজার হোক বচ্ছরকার দিন।
যেমন হরিনাভির সূর্যতারা অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা। কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই প্রায় মফস্সলে বড় হওয়া বাঙালি। জীবনে সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েই কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছেন। হরিনাভি কলকাতা কি না এ নিয়ে কেউ তর্ক জুড়লে পিন কোড দেখান। তা এই ফ্ল্যাট বাড়িতে আজ সাজো-সাজো রব। ডেকরেটার স্টেজ বেঁধে দিয়েছে। গাড়ি রাখার জায়গা জুড়ে দুপুরে এলাহি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। সব বাঙালি পদ। রোজকার নুড্লসপাস্তার আজ কোনও পাত্তা নেই। আর সন্ধেবেলা ফাংশন। বাড়ির বাচ্চারা নাচবে। একটু বড়রা অবাক জলপান করবে। আর তার পর বড় ছোট মিলে রবীন্দ্রনাথ। এ ছাড়া থাকবে গান। শুধুই বাংলা গান। বাচ্চারা ‘কোলাভরি’-হীন ফাংশনে উৎসাহ পায় না, পুজোর সময় তো এ সব কড়াকড়ি থাকে না। কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার। হাজার হোক বচ্ছরকার দিন।
যেমন রাসবিহারীর গৌতমবাবু। এমনিতে উনি রোজ একটু বেলার দিকে বাস্তুহারা বাজারেই যান। আজ সকাল সকাল লেক মার্কেট যাবেন। কল সেন্টার আর মিডিয়ার চাকরির জেরে সারা বছর বেপাত্তা মেয়ে-জামাই আজ হয়তো একবার আসবে। একটু ভাল মাছ, কিছু ফল আর সামান্য মিষ্টি। এখন না গেলে পরে যদি না পাওয়া যায়। হাজার হোক বচ্ছরকার দিন।
এই যাঁদের কথা বললাম, আজ তাঁরা সকলে অন্য রকম হয়ে যাবেন। আজ একদিনের জন্য, মাত্র এক দিনের জন্য নিজের মতো করে বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করবেন। বাঙালি বাবু হওয়ার চেষ্টা করবেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন বাঙালি হওয়াটা কি বাবুয়ানি করার উপলক্ষ মাত্র? একেবারে নয়, এমনটা প্রমাণ করা শক্ত। বাঙালিয়ানা বাবুয়ানির বেশ জুতসই অজুহাত। তবে এই একদিনের জন্য হঠাৎ করে বাঙালি বাবু হওয়াটা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়। অভ্যাসের আরাম থেকে ছুটি নিয়ে বেশ কিছু ঝকমারি পোয়ানো যে! যেমন ধরুন ধুতি। ম্যানেজ করা কি সোজা কথা? তাই ক্রিসমাস, পুজো, দোল, ভ্যালেন্টাইন্স ডে থাকতে শুধু আরেক দিনের স্ফুর্তির জন্য এঁরা সবাই এতটা কষ্ট স্বীকার করছেন এটা মানতে অসুবিধা হয়। বাঙালি হওয়ার খুব গাঢ় একটা প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই, না হলে এত লোকে এতটা পরিশ্রম করতেন না।
তাগিদটা কীসের? একটা সম্ভাবনা খুব প্রবল। আজকের এই কেব্ল, ইন্টারনেট, মোবাইলের যুগে সবাই আমরা শেকড় ছিঁড়ে বিশ্ব নাগরিক হবার চেষ্টায় ব্রতী। ভাষায়, রুচিতে, রসনায় আমরা ক্রমে একে অন্যের মতো হয়ে যাচ্ছি, পরিচিতিহীন হয়ে যাচ্ছি। তার ওপর বাঙালি হয়ে থাকাটা এখন আর ফ্যাশনেবল তো নয়ই, উপকারীও নয়। তাই ভুলে থাকি বংশ পরিচয়। সযত্নে লুকিয়ে রাখি আমাদের উত্তরাধিকার। আমাদের আসল আমিকে অন্য জামা পরিয়ে, এ ফর অ্যাপল, সি ফর ক্যাট বলিয়ে, দূরে সরিয়ে রাখি। মনের নিভৃত অলিন্দে খোঁজ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই নাম-গোত্রহীন হয়ে থাকাটা নিয়ে আমাদের অস্বস্তি আছে। ধরাচুড়োর প্রয়োজনটা অস্বীকারও করতে পারি না আবার অন্য জামায় স্বচ্ছন্দও থাকি না। তাই ছদ্মবেশ ছাড়ার সুযোগটাই আমাদের আসল তাগিদ।
পয়লা বৈশাখ আমাদের দেয় সেই তাগিদ মেটানোর কুণ্ঠাহীন স্বাধীনতা। দেয় নিজেকে হারিয়ে খোঁজার অবারিত সুযোগ। সেই জন্যই বোধহয় এই দিনটা এমন মনপ্রাণ দিয়ে বাঙালি হওয়ার উৎসব। আর উৎসব যখন তখন বাবুয়ানি তো থাকবেই। থাকবে আজকের মোড়কে অতীতকে খোঁজা। চকোলেট দিয়ে মাখা সন্দেশ, পাঁচফোড়ন দিয়ে চিকেন এসকালোপ। শিকড়ের গন্ধ নিবিড় করে পাওয়ার, ছোটবেলাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস। আর বাঙালি চাইবে বাবার মতো করে ধুতি পরতে, মায়ের মতো করে মুড়িঘণ্ট রাঁধতে, মাস্টারদা’র মতো করে আবৃত্তি করতে আর মালতীদির মতো করে গান গাইতে। আজ অন্তত। এই একটা দিনের জন্য।
পয়লা বৈশাখ তাই আর এক মহালয়া। অঞ্জলিভরা আর এক তর্পণ।

বাবু-বিবি পার্টি
ড্রেস কোড
বাড়িতে বা বাইরে, পার্টি যেখানেই করুন, আজকের ড্রেস কোড মানে নিখাদ বাঙালি পোশাক। ছেলেদের ধুতি-পাঞ্জাবি। মেয়েদের শাড়ি। ধুতি সামলাতে না পারলে পাজামা পরতে পারেন। বা ফেলুদা’র মতো প্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি। মেয়েদের কিন্তু শাড়ি পরতেই হবে। তাঁতের শাড়ির সঙ্গে চোলি ব্লাউজ ট্রাই করতে পারেন। নস্টালজিয়ার সঙ্গে আধুনিকতা মিশিয়ে আপনিই হয়তো হলেন সেরা বিবি।

গান
রবি কবির গান দিয়ে শুরু করতে পারেন। তারপর ‘গভীরে যাও’, ‘তুমি যে আমার’, ‘জানি দেখা হবে’ তো আছেই। নাচানাচির জন্য ‘পাগলু ডান্স, ডান্স’ বা ‘হান্ড্রেড পারসেন্ট লাভ’। বা বাংলা ব্যান্ডের গান। আর হ্যাঁ, বাড়ির মিউজিক সিস্টেমটা যেন ভাল থাকে। বাংলা গানের সিডির স্টকটাও যেন অফুরান হয়।

মাথায় রাখুন
বাড়িতে পার্টি হলে বসার ব্যবস্থা করুন মেঝেতে। গদির ওপর পা ছড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা। বেশ কিছু তাকিয়া, বালিশের ব্যবস্থাও রাখুন। পা ছড়ানো ছাড়া বাঙালি আয়েস হয় নাকি!

আজকের জন্য অন্তত কলার টিউনটা হেমন্ত বা সন্ধ্যার গানের হোক। ফেসবুক আর ট্যুইটার আপডেটগুলোও হোক বাংলায়। আইফোনে ফেসটাইম আর স্কাইপি চালিয়ে রাখুন। বিলেত-আমেরিকার বন্ধুদের সঙ্গে লাইভ আড্ডা মারতে পারবেন। ভিডিও-সহ। ক্যামেরার ব্যাটারিতে যেন পুরো চার্জ থাকে। বিশেষ মুহূর্তগুলো ফেসবুকে আপলোড করতে হবে তো! বরফের জোগান রাখুন।

ডাবের জল, আমপোড়ার শরবত তো আছেই। নিছক ঠান্ডা জলেও যেন একটু কর্পূরের গন্ধ থাকে। অনেকেই হয়তো গরমে হার্ড ড্রিংকসের বদলে হাল্কা ককটেল বা মকটেল পছন্দ করবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.