|
|
|
|
|
|
বঙ্গে বাণিজ্য |
|
‘বিশুদ্ধতা’র সংগ্রাম চলছে
গৌতম বসুমল্লিক |
|
লড়াই দিয়ে শুরু। আজও তা চলছে। তিথি-নক্ষত্র গণনার ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতির সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত গণনার লড়াই দিয়ে সূচনা হয়েছিল ‘দৃক্সিদ্ধ’ মতের ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’। তার পরে কেটে গিয়েছে একশো বাইশটি বছর। মানুষ এখন অনেক বেশি বিজ্ঞানমনস্ক। তবু এখনও আধুনিক ‘দৃক্সিদ্ধ’ মতের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘প্রাচীনপন্থা’র বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক প্রযুক্তিবিদ লক্ষ করেন, সেই সময়ে প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকার তিথি-নক্ষত্রের সময়ের সঙ্গে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের প্রকৃত সময়ের কিছু হেরফের ঘটছে। তিনি অঙ্ক কষে দেখলেন, বহু বছর আগে লেখা যে ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থের নিয়ম মেনে সে যুগের পঞ্জিকাগুলি গণনা করে, তা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে মেলে না, তাই ওই সময়ের হেরফের। ওই গণনায় কিছু সংশোধন করে তিনি নতুন সময় বের করলেন। ঠিক সেই সময়েই কোনও এক গ্রহণের দিন প্রচলিত পঞ্জিকাগুলির দেওয়া সময়ের সঙ্গে গ্রহণের প্রকৃত সময়ের গরমিল হল এবং মাধবচন্দ্রের সিদ্ধান্ত ঠিক বলে প্রমাণিত হল। ওই সাফল্যের পরে মদনমোহন মালব্য, বালগঙ্গাধর তিলক, চন্দ্রশেখর সিংহ, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, শশধর তর্কচূড়ামণি প্রমুখ পণ্ডিতের পরামর্শে মাধবচন্দ্র ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ) বিজ্ঞানসম্মত গণনাভিত্তিক দৃক্সিদ্ধ ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’ প্রকাশ করলেন।
সে কালের ধর্মভীরু মানুষ আধুনিকতার থেকে সনাতন পদ্ধতির উপরে ভরসা করতেন বেশি। ফলে প্রাচীন মতের পঞ্জিকার ব্যবহারও ছিল অনেক বেশি। দৃক্সিদ্ধ মতের পঞ্জিকার ব্যবহার খুবই কম ছিল এক সময়ে। মাধবচন্দ্রের উত্তরাধিকারীরা তাই এক সময়ে চালাতে পারলেন না পঞ্জিকার ব্যবসা। বন্ধ হতে বসা ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’ চালাবার ভার নিলেন নির্মলচন্দ্র লাহিড়ী নামে এক গণিতবিদ। মূলত তাঁর উদ্যোগেই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে তিনি পুত্র অরুণকুমার লাহিড়ীকে সঙ্গে নিয়ে ১৭ বৃন্দাবন মল্লিক ফার্স্ট লেনে ‘অ্যাস্ট্রো রিসার্চ ব্যুরো’ নামে এক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ষষ্ঠীচরণ জ্যোতির্ভূষণের সহায়তায় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার প্রকশনার ভার গ্রহণ করলেন। এখনও সেখানেই রয়েছে পঞ্জিকার কার্যালয়।
মিশ্র গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী নির্মলচন্দ্র কাজ করতেন কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্যিক সংবাদ ও সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগে। ১৯৫৩-এ তিনি মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে গঠিত ভারত সরকারের ‘ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি’র সম্পাদক নিযুক্ত হন। ভারত সরকারের ওই সব প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, সময় গণনার ক্ষেত্রে প্রাচীন অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বদলে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রচলন ঘটানো। সেই কাজের অঙ্গ হিসেবে মেঘনাদ সাহা ও নির্মলচন্দ্র লাহিড়ীর উদ্যোগে আলিপুরে ‘ন্যাশনাল অ্যালম্যানাক ইউনিট’ স্থাপিত হয়। |
|
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
পরে সেটি সল্টলেকের ‘পজিশন্যাল অ্যাসট্রোনমি সেন্টার’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ওই ‘ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি’-র সুপারিশ অনুযায়ী ভারত সরকার ১৯৫৭ থেকে ১৪টি ভাষায় আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-সম্মত সময়-সারণি ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ (Indian Astronomical Ephemeris) প্রকাশ করে প্রতি বছর এবং ভারত সরকারের বিভিন্ন পুজো-পার্বণের ছুটি নির্ধারিত হয় ওই পঞ্চাঙ্গ অনুসারেই। ওই বছর থেকেই আধুনিক গণনা পদ্ধতি সম্বলিত সরকারি ‘পঞ্চাঙ্গ’ অনুসারে দৃক্সিদ্ধ পঞ্জিকার দিনক্ষণ নির্ধারিত হতে থাকে।
গণনার বিশুদ্ধতা সত্ত্বেও কেন এখনও জনপ্রিয় নয় এই পঞ্জিকা?
পঞ্জিকা-কমিটির সম্পাদক তথা বর্তমান স্বত্বাধিকারী মনোজকুমার লাহিড়ী বলেন, “এই রাজ্যে এখনও বিভিন্ন পুজো-পার্বণের ছুটি দেওয়া হয় পুরনো পঞ্জিকা মেনে। তাই সাধারণ মানুষ সেটাই ব্যবহার করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসরণে এখানেও রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ অনুসারে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা হওয়া দরকার, তবেই মানুষের সচেতনতা বাড়বে।”
অদৃক্সিদ্ধ পঞ্জিকার সমর্থক পণ্ডিত মুরারিমোহন বেদান্তাদিতীর্থ শাস্ত্রী অবশ্য মনে করেন, দর্শন-গ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে দৃক্সিদ্ধ অনুসরণ করা যেতে পারে কিন্তু পুজো-পার্বণের ক্ষেত্রে প্রাচীন মতের পঞ্জিকার মতামত গ্রহণ করা শ্রেয়।
তবে, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। বেলুড়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়-সহ ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন’-এর সব শাখাতেই ব্যবহার হয় এই পঞ্জিকা। এ ছাড়াও তালিকায় আছে কাঞ্চী কামকোঠী পীঠ, দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রম, বরাহনগর পাঠবাড়ি আশ্রম, গৌড়ীয় মঠ, কাঠিয়াবাবার আশ্রম ইত্যাদি। ওই সমস্ত ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনও ব্যবহার করেন বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। এ ছাড়াও আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ এই রাজ্যের আরও কয়েকটি পত্রিকাও দিন-তারিখের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই মেনে চলে। তা সত্ত্বেও পুজো-পার্বণের ক্ষেত্রে আমজনতা এখনও পুরনো মতের পঞ্জিকাই অনুসরণ করে। সেই কারণে পঞ্জিকার বাজারে খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়া বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা এখন সেই সচেতনতা বাড়ানোর লড়াইটাই চালাচ্ছে। বাংলা ভাষায় যে গোটা চারেক ‘বড়’ পঞ্জিকা রয়েছে তাদের মধ্যে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তই একমাত্র দৃক্সিদ্ধ মত অনুসারী। অন্য পঞ্জিকাগুলি সবই প্রাচীন গণনাপদ্ধতি অনুসরণ করে। ‘বিজ্ঞানসম্মত’ তকমাটাই তার হাতিয়ার। |
|
|
|
|
|