ব্যাগ গুছিয়ে...

ক্যাঙারুর দেশে
স্টেডিয়ামে ঢুকতে হলে ওঁকে পেরিয়েই আপনাকে যেতে হবে। বাঁ পা এগিয়ে রাখা। ডান পা মোড়া। ব্যাট উঠে আছে মাথার বাঁদিকে। দুই হাতে ধরা ব্যাটের হ্যান্ডেল। তিনি ডন ব্র্যাডম্যান।
স্টেডিয়ামের নাম অ্যাডিলেড ওভাল। ডনের প্রিয় স্টেডিয়াম। ১৯৩৪ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই শহরে এসে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে শুরু করেন ডন। জীবনের বাকি সময়টা ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই শহরেরই বাসিন্দা। শেষ ক্রিকেট তিনি খেলেছেন অ্যাডিলেডের ওভাল মাঠেই।
অ্যাডিলেড ওভালের ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ডের পাশে বসে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার এক দিনের খেলা দেখার সুযোগ হয়েছে। ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম ঘুরে দেখেছি এক ঝলক। কিন্তু কেনমিন্টন পার্কে ব্র্যাডম্যানের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি মেলেনি। এই বাড়িতেই শেষ জীবনটা ছিলেন ডন। মারাও গিয়েছিলেন ওই বাড়িতে। মারা যাওয়ার তিন বছর আগে ১৯৯৮ সালে নিজের ৯০তম জন্মদিনে এই বাড়িতেই ডন নেমন্তন্ন করে ডেকে খাইয়েছিলেন তাঁর প্রিয় সাম্প্রতিক কালের দুই ক্রিকেটারকে। একজন তাঁর দেশের শেন ওয়ার্ন। অন্য জন আমাদের সচিন তেন্ডুলকর।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া ট্যুরিজমের গাইড কেন্ট নিজে সচিনের বেজায় ভক্ত। কোন পোশাকে সচিন ওই নেমন্তন্ন রক্ষা করতে এসেছিলেন তা-ও কেন্টের জানা। আমরা যখন ব্র্যাডম্যানের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তখন অ্যাডিলেড ওভালে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার খেলার মধ্যাহ্নভোজের বিরতি চলছে। আমরা সোজা মাঠ থেকে এসেছি ওই বাড়ির কাছে। সচিনভক্ত কেন্টের মনটা খারাপ। কারণ, ওই দিন সচিন ছিলেন না ভারতীয় দলে। কিন্তু ওভাল স্টেডিয়াম, ব্র্যাডম্যান মিউজিয়াম এবং ব্র্যাডম্যানের বাড়ির সামনে কেন্টের মুখে শুধু সচিনেরই কথা।
অ্যাডিলেড ওভালে ওই দিনের খেলায় ভারত জিতল। বিস্তর নাচানাচি করলাম ভারতীয় সমর্থকদের সঙ্গে। কিন্তু মন জুড়ে থেকে গেলেন শুধু ডন। ডনের মিউজিয়ামে দেখেছি ওই কিংবদন্তির ডন হয়ে ওঠার কাহিনি। তাঁর ব্যবহৃত ব্যাট, বল, টুপি, জামা-প্যান্ট, ব্লেজার, সব রয়েছে ওই সংগ্রহশালায়। রয়েছে তাঁর জেতা বিভিন্ন ট্রফি, মেডেল। রয়েছে বেশ কিছু সংবাদপত্রের কাটিং। ওই সব কাটিং ডনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ। ১৯৪৮ সালে শেষ ইংল্যান্ড সফরে তাঁর গ্রিন ক্যাপ, বিশ্ব রেকর্ড (১৯৩০ সালের লিডসে ৩৩৪ রানের ইনিংস) করা ব্যাট সংরক্ষিত রয়েছে সেখানে।
ডন-ময় হয়ে অ্যাডিলেড থেকে সিডনি পৌঁছেও বুঝতে পারিনি সেখানে আমাদের জন্য কী উপহার অপেক্ষা করছে। সিডনি পৌঁছে অ্যাডিলেডে ব্র্যাডম্যানের বাড়ি ও ওভালের মিউজিয়ামের কথা শোনাতেই নিউ সাউথ ওয়েলস পর্যটনের গাইড ডগলাস হাসলেন। শুধু বললেন, “তাই!” ঝেড়ে কাশলেন না বছর তিরিশের মহিলা। ছোট্ট মন্তব্য করলেন, “এ বার শুধু দেখতে থাক।”
রাতে হোটেলের ঘরে পৌঁছে গেল একটা কাগজ। তাতে লেখা আমরা আগামী দু’দিনে কী কী দেখব। প্রথমটা সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড (এসসিজি)। দ্বিতীয়টা ওই কিংবদন্তি ক্রিকেটারের শৈশব থেকে বড় হয়ে ওঠার জায়গা সিডনির শহরতলি বাওরাল। ক্রিকেট জীবনের শুরু করবার সেই মাঠ। তাঁর প্রিয় স্টেডিয়াম। সেই মাঠের নাম এখন ব্র্যাডম্যান ওভাল। ওই স্টেডিয়ামের পাশেই এখন গড়ে উঠেছে বিশাল এক সংগ্রহশালা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট হল অব ফেম।
যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমীর কাছে এসসিজি একটা তীর্থক্ষেত্র। আর ডনের কাছেও ওই স্টেডিয়াম ছিল তাই। ওই মাঠের এসসিজি ট্রাস্টের এক কর্তা বলছিলেন, “১৯২০ সালে ১২ বছরের ডন বাবার হাত ধরে বোরাল থেকে এসেছিলেন এসসিজি-তে। অ্যাসেজ সিরিজের পঞ্চম টেস্ট দেখতে। ‘এই মাঠে খেলতে না পারা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই’- ফেরার সময়ে কিশোর ডন বাবার হাত চেপে ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।” এসসিজি ট্রাস্টের কর্তাটি বলেন, “আট বছর পরে দেখা গেল সেই কিশোর ওই মাঠে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্যাট ধরে ৪৫২ রান করেছেন। তখনও পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেটাই ছিল কোনও ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এ ভাবেই প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন ডন।”
যে কোনও ক্রীড়াপ্রেমীর কাছেই এসসিজি একটি তীর্থক্ষেত্র। একই চত্বরে রয়েছে প্রমাণ সাইজের দু’টি স্টেডিয়াম। একটি ফুটবল, অন্যটি ক্রিকেট। ফুটবল স্টেডিয়ামে ফুটবল ছাড়া রাগবিও খেলা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় রাগবি অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট, ফুটবলের থেকে সেখানে অনেক বেশি ভিড় বটে কিন্তু এসসিজি বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটের জন্যই, বলছিলেন ট্রাস্টের মুখপাত্রটি। ক্রিকেট ও ফুটবলের মাঝখানে রয়েছে টেনিস কোর্ট। রয়েছে একের পর এক নেট। ক্রিকেটের শিক্ষার্থীদের জন্য। এসসিজি-র প্রশাসনিক ভবনে রয়েছে ১০০ আসন বিশিষ্ট একটি প্রেক্ষাগৃহ। ক্রিকেট এবং ফুটবলের যাবতীয় সাংবাদিক সম্মেলন হয় সেখানেই।
এসসিজি-তে গিয়েই জানা গেল অ্যাডিলেড ওভালের আগেই সিডনির এই স্টেডিয়ামের একটি অংশ ডনের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের ওই অংশের নাম হয়েছে ‘ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ড’। স্টেডিয়ামের যে অংশে অস্ট্রেলিয়ার ডেসিংরুম সেখানে ক্রিকেটের ওই কিংবদন্তির স্মৃতির ছড়াছড়ি। ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সঙ্গে রয়েছে ছোটখাটো একটা সংগ্রহশালা। সেখানে সাজানো রয়েছে এই মাঠে খেলে যাওয়া ম্যাচের অসংখ্য স্মৃতি। ভারতের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচের স্কোর বোর্ড। সেখানে ডন সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। আসলে ডনের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হাতেখড়ি যে এই স্টেডিয়ামেই!
স্কোরার থেকে যে মাঠে ডনের ক্রিকেটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ সিডনির অদূরে সেই ব্র্যাডম্যান ওভাল মাঠ দেখার সৌভাগ্য হল পরদিন। মাঠের নাম ওভাল। পরে যোগ হয়েছে ব্র্যাডম্যান নামটি। “বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা মানুষটার নিজের মাঠের নাম তাঁর নামেই কি হওয়া উচিত নয়,” প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বাওরালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট হল অব ফেমের অন্যতম কর্তা শ্যানন ওকোনর। ডন খেলার সময় স্টেডিয়াম যেমন ছিল, ড্রেসিং রুম যেমন ছিল তার কোনও পরিবর্তন ঘটানো হয়নি। ওই মাঠে নিয়মিত খেলা হয়। মাঠের পাশেই কচিকাঁচাদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
আর রয়েছে ক্রিকেটের এক অসাধারণ সংগ্রহশালা। ডন তো বটেই, বিশ্বের সব সেরা ক্রিকেটারদেরই সম্মান জানানো হয়েছে সেখানে। যে কোনও দেশের যে কোনও টেস্ট খেলোয়াড়ের (একটি টেস্ট খেলে থাকলেও)- সম্পূর্ণ জীবনপঞ্জী মিলবে সেখানে। যেমন রয়েছে অম্বর রায়, প্রণব রায়েরও। ক্রিকেট নিয়ে যাঁরা গবেষণা করতে চান তাঁদের কাছে এই সংগ্রহশালা মক্কা।
ওই সংগ্রহশালার পিছনে ছোট বাগান পার হয়ে একটি রাস্তা। আর রাস্তার ও পারেই সবুজ ঘাসের চাদরে ঢাকা ফুটপাথের লাগোয়া একটি বাড়ি। লাল ইটে গাঁথা। বাইরে সাদা বেড়া। শ্যানন বললেন, “এটাই ডনের বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই ক্রিকেটের পাঠ শুরু করেছেন তিনি। ১৯৩৪ সালে বাওরাল ছেড়ে তিনি চলে যান অ্যাডিলেড। তত দিনে তিনি তাঁর জাত চিনিয়ে দিতে শুরু করেছেন।”
অনেকক্ষণ বসেছিলাম ডনের বাড়ির সামনে ঘাসের চাদরে। সম্বিত ফিরল ডগলাসের ডাকে, “এ বার রওনা দিতে হবে। অনেকটা পথ যেতে হবে যে!”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.