সহিষ্ণুতা সঙ্গী ছিল রঙ্গরসিক রাজনীতির
৯৯৮ সাল। পোখরানে দ্বিতীয় পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা হল। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখলেন ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার এক ছাত্র। নাম, পীযূষ পান্ডে। পীযূষের বন্ধু অনুরাগ কাশ্যপ, ইমতিয়াজ আলি, মনোজ বাজপাই, রঘুবীর যাদবরা কবিতাটা ‘সাইক্লোস্টাইল’ করে ক্যাম্পাসে সর্বত্র সেঁটে দিলেন। দিল্লির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, মদনলাল খুরানার তরফে মামলা করা হল। নিরাপত্তারক্ষীরা পীযূষকে তুলে নিয়ে গেল। তাঁকে পেশ করা হল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। অটলবিহারী কিন্তু সন্ধেটা শুধু কবিতা আর শায়রি নিয়ে আড্ডা মেরে কাটালেন। হাসতে হাসতে ফিরে এলেন বামপন্থী পীযূষ।
“এটাই গণতন্ত্র,” শুক্রবার দুপুরে ই-মেলে ঘটনাটার কথা জানালেন পীযূষের সেই সময়কার এক বন্ধু।
ফেসবুক-টুইটার-এসএমএস-ইমেল হাল আমলের ব্যাপার। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ঠাট্টাতামাশার চল বরাবরের।
উনিশ শতকে রানি ভিক্টোরিয়াকে ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’র তকমায় ভূষিত করতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি। সাধারণ ব্রিটিশদের ব্যাপারটা পছন্দ হল না। কোথায় কোন সাগরপারের উপনিবেশ, ইংল্যান্ডেশ্বরীর সঙ্গে তার নাম জুড়বে? ১৮৭৬ সালে লন্ডনের ‘পাঞ্চ’ পত্রিকায় কার্টুন ডিজরেলি মই বেয়ে সাইনবোর্ড আঁকতে উঠছেন। সাইনবোর্ডের ছবিতে ভিক্টোরিয়ার দু’টি মুখ। মইয়ের নীচে এক ব্রিটিশ চেঁচাচ্ছেন, “না না, বেঞ্জামিন ও ভাবে হবে না। রানির মাথায় আর নতুন কিছু জুড়ে কাজ নেই।”
ভিক্টোরীয় যুগেরও ঢের আগে মধ্যযুগের ইউরোপে ছিল ‘কার্নিভাল’। সামন্ত প্রভুর ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে সে দিন কৃষক-কামার-কুমোর-সহিসরা কেউ মুখোশ পরে নাচতেন, কেউ রান্নাঘর থেকে হাঁড়ি, খুন্তি এনে বাজাতেন। সে দিন যাজক থেকে সামন্ত প্রভু সবাইকে নিয়ে মস্করা করা যায়, গালি দেওয়া যায়। “ঠাট্টা করা জনসমাজের অধিকার। এর মধ্যে অন্তর্ঘাতের কোনও ব্যাপার নেই,” বললেন ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র।
মধ্যযুগের ইউরোপ অনেক দূর! গোপাল ভাঁড়ের বঙ্গদেশ তার সমূহ ভঙ্গুরতার মুহূর্তেও সতত রঙ্গে ভরা থেকেছে। উনিশ শতকে বিখ্যাতদের নাম ধরে ধরে ‘অবতার’ পত্রিকায় ছড়া লিখতেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।
‘শহর জুড়ে এক নতুন হুজুগ উঠেছে রে ভাই, অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই
এর বিদ্যাসাগর জন্মদাতা, বঙ্গদর্শন এর নেতা,’

লিখেছিলেন তিনি। কলকাতার রাস্তায় ‘জেলেপাড়ার সং’ বা ‘কাঁসারিপাড়ার সং’ বেরোত, সেখানেও নাম করেই বাবুদের ‘কেচ্ছা’ গাওয়া হত। কবিগান, আখড়াইয়ের আসর কাউকে ছাড় দিত না। অ্যান্টনি কবিয়াল ধুতি পরতেন বলে ঠাকুরসিংহ কবিয়াল তাঁকে ঠাট্টা করেছিলেন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির উত্তর ছিল,
‘এই বাংলায় বাঙালির বেশে আনন্দেতেই আছি
হয়ে ঠাকুরসিংহের বাপের জামাই কুর্তাটুপি ছেড়েছি।’

কবিগান, হাফ আখড়াইয়ের রমরমা অবশ্য ঔপনিবেশিক আলোকপ্রাপ্তির দৌলতে শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘বসন্তক’ থেকে ‘বিদূষক’ বহু কাগজে নিয়মিত ছাপা হত ব্যঙ্গচিত্র। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ কেউই কার্টুন আঁকায় পিছিয়ে ছিলেন না। গৌতম ভদ্রের মতে, ছড়া-কার্টুন রাজনৈতিক চর্চারই আঙ্গিক। যে আঙ্গিক স্বাধীনতা-উত্তর কালে প্রথম ধাক্কা খায় জরুরি অবস্থার সময়।
কেরলের কে শঙ্কর পিল্লাইকে মনে আছে? অনেকে বলেন, ‘শঙ্করস উইকলি’র প্রতিষ্ঠাতাই ভারতে রাজনৈতিক কার্টুনের জন্মদাতা। শঙ্কর জওহরলাল নেহরুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। নেহরুকে নিয়েও তাঁর পত্রিকায় অনেক ঠাট্টাতামাশা বেরোত। ইন্দিরা গাঁধীকেও ছাড়েননি। ভাত ফুটছে, হাঁড়ির গায়ে লেখা: সমাজতন্ত্র। রান্নার চোটে চারদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। সামনে বাটি হাতে পিলপিল করা নিরন্ন মানুষ। উপরে লেখা, ‘আর একটু সবুর করুন’। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পরেই শঙ্কর তাঁর পত্রিকা বন্ধ করে দেন। “জরুরি অবস্থার প্রথম বলি কিন্তু শঙ্করস উইকলি,” মনে করিয়ে দিচ্ছেন গৌতম ভদ্র। বাকি জীবনটা শঙ্কর শুধু ছোটদের জন্য কার্টুন এঁকেছেন।
দিন কয়েক আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বল জানিয়েছেন, সনিয়া-মনমোহন সিংহকে নিয়ে ফেসবুকে কোনও কার্টুন ‘ফরওয়ার্ড’ করা যাবে না। অথচ ষাটের দশকে অতুল্য ঘোষের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ‘কানা অতুল’ বলে নিম্নরুচির ঠাট্টাও করা হয়েছে, কেউ রেগে যাননি। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘অল্পবিস্তর’, দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্যালের ‘অচলপত্র’ থেকে গৌরকিশোর ঘোষের ‘রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য’য় তৈরি হয়েছে অজস্র রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যঙ্গরচনা। কার্টুন এঁকেছেন কুট্টি, চণ্ডী লাহিড়ী কিংবা অহিভূষণ মালিক। কুট্টির আঁকাতেই ১৯৭৭ সালে প্রমোদ দাশগুপ্ত আরামসে শুয়ে, পায়ের কাছে প্রফুল্লচন্দ্র সেন হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছেন, ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে।’ কুট্টি, আর কে লক্ষ্মণদের কার্টুনে আসার জন্য নেতারাও তখন মুখিয়ে থাকতেন। কার্টুন বেরোলে তাঁদের ‘ব্র্যান্ড ইক্যুইটি’ বেড়ে যেত।
কার্টুনের পাশাপাশি থাকত ভোটের ছড়া। দাদাঠাকুর ‘ভোট দিয়ে যা, আয় ভোটার আয়’ বলে হাসির গান বেঁধেছেন। তারও পরে ষাটের দশকে দেওয়ালে ছড়া,
‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদমতলায় কে
হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে জ্যোতিবাবুর বে।’

যুক্তফ্রন্ট তাতে দমে যায়নি, সেই ছড়ার পাশেই দেওয়াল লিখেছিল
‘ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ভাই
১১ মার্চ ইন্দিরাকে সাজিয়ে আনা চাই।’

১১ মার্চ সে বছর ভোটের তারিখ ছিল! এই সে দিনও বুদ্ধ-মমতাকে নিয়ে নানা ব্যঙ্গচিত্র মোবাইলে-ইন্টারনেটে ঘুরত! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দৃকপাত করেননি। সেই সহিষ্ণুতা কি কম পড়িয়াছে? এক সমাজতত্ত্ববিদের মতে, বাঙালিসমাজের সামগ্রিক সহিষ্ণুতার কথা এখানে বলা ঠিক হবে না। সহিষ্ণুতা কমে দু’টি কারণে। “যখন আমরা ‘নিরাপত্তার অভাব’ বোধ করি, কিংবা নিজেদের ত্রুটিহীন মহামানব মনে করি। এটি সমাজের নয়, ব্যক্তির সমস্যা হতে পারে।”
কী রকম? ১৯২২ সালে ‘লিপিকা’য় একটা গল্প লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কর্ণাটের সঙ্গে কাঞ্চীর রাজার যুদ্ধ। কাঞ্চীর রাজা জিতে ফিরছেন। জয়ের আনন্দে কিছু নিরীহ বালককে শাস্তি দিলেন তিনি। মন্ত্রী, সেনাপতি, পুরোহিত সকলে এক বাক্যে বললেন, ‘মহারাজের জয়।’ শুধু বিদূষক বিদায় নিয়ে বললেন, ‘আমি মারতেও পারিনে, কাটতেও পারিনে। বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব।’
“বাঙালির সহনশীলতা হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্রেক হয়, যখন শাসক হাসাহাসি সহ্য করতে পারে না।” ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় হাসলেন।

এ-কাল ও সে-কাল। দেওয়ালচিত্রে মমতা-বুদ্ধ। ব্যঙ্গচিত্রে প্রফুল্ল সেন এবং জ্যোতি বসু। সংগ্রহ থেকে
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.