পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম থেকে হুগলির খানাকুল-পুড়শুড়া, বর্ধমানের রায়না থেকে উত্তর ২৪ পরগনার দমদম তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজ্য সরকার। খুন, বেআইনি অস্ত্র ব্যবহার আইনের (আর্মস অ্যাক্ট) মতো জামিন-অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেও মামলা তুলে নেওয়া হচ্ছে। জেলার সরকারি আইনজীবীদের এ ব্যাপারে আবেদনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রী মলয় ঘটকও বলেছেন, “তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা মামলা চলছে, সেগুলি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” তাঁর দাবি, “তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ফাঁসাতে সিপিএম ওই সব মিথ্যা মামলা করেছিল।”
ক’জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তার নির্দিষ্ট সংখ্যা অবশ্য মলয়বাবু জানাতে পারেননি। সরকারি সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন জেলা মিলিয়ে ৫০০-এরও বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরবর্তী কালে অন্যদের বিরুদ্ধেও মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তৃণমূলের যে সব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নন্দীগ্রামের আবু তাহের (সরকারি ভাবে এখনও ‘ফেরার’), শেখ সুফিয়ান প্রমুখ। তৃণমূলের এক প্রথম সারির সাংসদ জানিয়েছেন, শুধু নন্দীগ্রাম নয়, কেশপুর-গড়বেতা, সবং-পিংলাতেও যে সব নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তা-ও তুলে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই সাংসদেরও দাবি, “সিপিএম মিথ্যা মামলা করেছিল। তাই তা তুলে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।”
আইনমন্ত্রীর নিজের জেলা বর্ধমানে প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী ৩৩টি মামলায় ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ওই সব মামলা মূলত বাম আমলে করা হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মামলা হয়েছে, এমন অভিযুক্তরাও এই তালিকায় রয়েছেন। বর্ধমানে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা তোলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী নার্গিস বেগম, তেমনই আছেন কুলটি পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান পূর্ণেন্দু ওরফে বাচ্চু রায়, জামুড়িয়ার নেতা তরুণ দাস, রায়নার নেতা বামদাস মণ্ডল, খন্ডঘোষের নেতা দেবীপ্রসাদ মণ্ডল। কয়লার কারবারের সঙ্গে যুক্ত কুলটির সুরজিৎ (সুজিত) চৌধুরী এবং শম্ভু সাউয়ের বিরুদ্ধেও মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বামদাস মণ্ডল এবং দেবীপ্রসাদ মণ্ডলদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ সুরজিৎ চৌধুরী ও শম্ভু সাউয়ের বিরুদ্ধে বেআইনি অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে।
২০০৯ সালে হুগলির পুড়শুড়া থানা এলাকায় সিপিএম নেত্রী সাউফুন্নিসা বেগমের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত শেখ আশা, মইদুল মির্ধা প্রমুখের বিরুদ্ধে যেমন মামলা তুলে নেওয়া হচ্ছে, তেমনই মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর খানাকুলে সিপিএম নেতা মহাদেব মণ্ডলের খুনে অভিযুক্ত স্থানীয় তৃণমূল নেতা কাশীনাথ মণ্ডল, উমেশ পাত্র, অবিনাশ পাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। খানাকুলের আরও এক সিপিএম কর্মী স্বপন সরের খুনের মামলায় অভিযুক্ত সুব্রত মণ্ডল, গোপাল মাকালদের বিরুদ্ধেও মামলা তোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি উত্তর ২৪ পরগনার দমদমের দুর্গানগরে দুই সিপিএম কর্মী সুজিত দাশগুপ্ত ও শম্ভু দাশগুপ্ত খুন হন। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত স্থানীয় তৃণমূল নেতা দেবাশিস বসাক, অমল মৃধা, খোকন ভট্টাচার্য প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। সুনির্দিষ্ট ভাবে কোনও মামলা বা অভিযুক্তের নাম উল্লেখ না করলেও আইনমন্ত্রী বলেছেন, “যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা তোলা হচ্ছে, তাঁরা সকলেই নির্দোষ।”
প্রাথমিক ভাবে সরকারি আইনজীবীদের বলা হয়েছে, মামলার ‘গুরুত্ব’ বিবেচনা করে তা প্রত্যাহারের জন্য যেন তাঁরা জেলা শাসকের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হলে তা মহাকরণে ‘লিগাল রিমেমব্রানসারে’র কাছে পাঠানো হবে। তিনি আইনমন্ত্রীর কাছে নোট পাঠানোর পর সরকারি স্তরে মামলা প্রত্যাহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মলয়বাবুর বক্তব্য, “যা-ই করা হোক, জেলা শাসকের সুপারিশ মেনেই করা হবে। কোনও বেআইনি কাজ করা হবে না।”
মামলা প্রত্যাহারের জন্য একটি ছাপানো আবেদনপত্রও তৈরি হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সরকারি আইনজীবী আবেদনপত্রে বলেছেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অযথা হয়রানির শিকার হচ্ছে। সরকারি নীতি ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা হোক। কারণ, মামলার সমস্ত দিক খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে’।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন জেলবন্দি, কামতাপুরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু নেতা-কর্মী ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু মাওবাদী অভিযোগে ধৃত বা জনসাধারণের কমিটির সঙ্গে যুক্ত বহু নেতা-কর্মীই এখনও জেলে। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই ছত্রধর মাহাতো থেকে শুরু করে বিভিন্ন নকশালপন্থী সংগঠন, বন্দি-মুক্তি কমিটি এবং পরিবর্তন-পন্থী বিশিষ্টদের একাংশ সরব।
প্রশাসনিক সূত্রে খবর, ওই বন্দিদের ব্যাপারে এখনও কোনও ‘সামগ্রিক সিদ্ধান্ত’ না-নেওয়া হলেও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা তোলার ‘সামগ্রিক সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয়েছে। মলয়বাবু বলেন, “তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যে সব মিথ্যা মামলা রয়েছে, তার প্রতিটি খতিয়ে দেখেই
মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারি আইনজীবীকে আবেদন করতে বলা হয়েছে।” কিন্তু তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে খুন বা বেআইনি অস্ত্র আইনে মামলাও তুলতে বলা হয়েছে। আইনমন্ত্রীর যুক্তি, “এ সব অভিযোগও সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং সাজানো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জেলা সিপিএমের নেতারা ওই অভিযোগ করেছিলেন। আমাদের নেতা-কর্মীরা যাতে অকারণে হয়রানির শিকার না হন, তাই তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে।” |