সমবায়ের ঋণ শোধ না-করলেও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণাকে কটাক্ষ করে বললেন, এমন জিনিস ‘পাগলের দেশে’ও হয় না! কিন্তু মমতার নেতৃত্বাধীন সরকারকে আরও ‘সময়’ দিতে তাঁরা প্রস্তুত বলেও জানিয়ে দিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরেই বিরোধী দল হিসাবে সিপিএমের সিদ্ধান্ত ছিল, মমতাকে ‘সময়’ দিতে হবে। তাঁর সরকারের গত ১০ মাসের জমানায় নানা ঘটনা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রভূত বিতর্ক হয়েছে, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এ বার সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসের অব্যবহিত আগে দলের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবুর সেই ‘ধৈর্য’ ধরার ‘লাইন’ই বহাল রাখা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির আয়োজনে রবিবার একটি সাধারণ সভায় এবং একটি সংবাদচ্যানেলে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে প্রায় একই কথা বলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দলীয় সূত্রের খবর, সাধারণ সভায় বুদ্ধবাবু বলেন, তাঁরা কী ভাবে সরকার চালিয়েছেন আর এখন কী ভাবে সরকার চলছে সবই মানুষ দেখছেন। একটা সরকারকে ‘বিচার’ করার জন্য ১০ মাস কখনওই যথেষ্ট নয়। আগামী কালই সরকার চলে যাচ্ছে না। তাই বামেদের ফিরে যেতে হবে মানুষের কাছেই। তাঁরাই ‘বিচার’ করে নেবেন তাঁদের অভিজ্ঞতায়।
সাক্ষাৎকারেও তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, নতুন সরকারের প্রায় এক বছর পূর্তির কাছাকাছি সময়ে দাঁড়িয়ে এ বার কি বিরোধীরা একটু ঝাঁপিয়ে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছে? বুদ্ধবাবুর জবাব, “সময় দিতে হবে, এ তো আমরা বারবার বলছি।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “বলার জায়গা তো উনিই (মুখ্যমন্ত্রী) তৈরি করে দিচ্ছেন। বিরোধী দলনেতা কিছু কিছু বলছেন। কিন্তু সেটা বলতে হচ্ছে। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এমন কিছু বলছেন যে, আমাদের না-বললেই নয়। পরিস্থিতি তো তিনিই তৈরি করছেন। আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি।” রাজ্য সরকারের মনোভাবে বারেবারেই যে ‘অসহিষ্ণুতা’র মনোভাব ফুটে উঠছে, তার সমালোচনা করেও ‘সময়’ দেওয়ার কথা বলেছেন বুদ্ধবাবু।
|
|
সময় দিতে হবে, এ তো আমরা বারবার বলছি।
কিন্তু বলার জায়গা তো উনিই (মুখ্যমন্ত্রী) তৈরি করে দিচ্ছেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী |
|
|
বাদ দেননি আত্মসমালোচনাও। জেলা পরিষদগুলির ক্ষমতা যে ভাবে খর্ব করা হচ্ছে, বিরোধীদের হাতে-থাকা নির্বাচিত পঞ্চায়েতগুলিকে যে ভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, প্রত্যাশিত ভাবেই সে সবের বিরুদ্ধে সরব বুদ্ধবাবু। একটা অংশের মানুষ ‘সাময়িক ভাবে’ তাঁদের থেকে দূরে চলে গেলেও ভূমি সংস্কার এবং তৃণমূল স্তরের সমাজে স্বশাসনের জন্য যে কাজ বামফ্রন্ট সরকার করে গিয়েছে, তাকে মুছে দেওয়া যাবে না বলেই বুদ্ধবাবুর দাবি। তবে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, পঞ্চায়েতের কাজের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও তাঁদের সরকারের বেশ কিছু ভুল হয়েছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি সব সময় রাখতে পারিনি।
গরিবের মধ্যেও ভাগ করে ফেলেছি। যে গরিবেরা সমর্থন করেন, তাঁদের জন্য কাজ করব। যাঁরা সমর্থন করেন না, তাঁদের কাজ না-করলেও চলবে, এটা করা উচিত হয়নি।”
শাসক এবং বিরোধীর ভূমিকায় যথাক্রমে তৃণমূল এবং সিপিএম দু’পক্ষেরই প্রথম ‘পরীক্ষা’ হতে চলেছে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার আগে রাজ্য সরকারের নানা সিদ্ধান্তে কি তাদের ‘কৃষক-দরদি’ ভাবমূর্তির বার্তা যাচ্ছে? বিশেষত, যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা সমবায়ের ঋণ শোধ না-করলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সংস্থান তুলে দিতে আইন সংশোধনের কথা বলেছেন, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড তৈরির উপরে জোর দিচ্ছেন। এই প্রশ্নের জবাবে ২৪ ঘণ্টার ওই সংবাদচ্যানেলে সমবায় ঋণ সংক্রান্ত মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণাকে তুলোধোনা করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বুদ্ধবাবুর কথায়, “ব্যাঙ্কের দর্শনই হল ঋণ আদায়। ঋণ নেব কিন্তু শোধ না-করলেও চলবে, এ কখনও হয়? তা হলে তো বলে দিতে হয়, এটা একটা হরির লুঠের জায়গা! এসো, টাকা নাও, চলে যাও! রাষ্ট্রায়ত্ত হোক, রাজ্যের কোনও ব্যাঙ্ক হোক, কেউ এটা করতে পারে?” তাঁর আরও সংযোজন, “যাঁরা ঋণ শোধ করতে পারছেন না, তাঁদের একটা রক্ষাকবচ দেওয়ার দায়িত্ব সরকার নিতে পারে। কিন্তু ঝণ শোধই করতে হবে না, ব্যাঙ্ক চলবে এটা কোনও পাগলের দেশেও হয় না!”
বুদ্ধবাবুর ব্যাখ্যা, গ্রামাঞ্চলে মহাজনি কারবারের খপ্পর থেকে বেঁচে কৃষক যাতে যথাযথ ভাবে ঋণ পান, তার জন্যই তাঁদের সমবায়ের আওতায় আনা হয়। গরিব মানুষ হলেও তাঁদের খুব কম অংশই ‘ডিফল্টার’ হন। তাঁদের কিছু ‘রিলিফ’ দিতে পারে সরকার। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টির জন্য ফসল নষ্ট হলে এককালীন সুদ মকুব হতে পারে, ঝণ শোধের মেয়াদ বাড়ানোর মতো ‘স্বস্তি’ দেওয়া যেতে পারে। “কিন্তু ঋণ নেব, একেবারে শোধই দেব না, এটা হয় না!” সাফ বলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে সংবাদমাধ্যমে এটিই ছিল বুদ্ধবাবুর প্রথম সাক্ষাৎকার। |