প্রতিরক্ষা কেনাবেচায় প্রথমে ঘুষ কাণ্ডের অভিযোগ, পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে লেখা সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিংহের চিঠি ফাঁস হয়ে যাওয়া। এই জোড়া অস্বস্তির মুখে পড়ে সেনাপ্রধানকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব যে বিবেচনা করেননি, তা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্র এখনও সে পথে হাঁটতে চায়নি। তবে অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র, যিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দক্ষিণহস্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন, আজ এ ব্যাপারে সওয়াল করলেন। জানালেন, সেনাপ্রধানকে বাধ্যতামূলক ভাবে দু’মাসের ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। শুধু তাই নয়, ভি কে সিংহের তীব্র সমালোচনা করে ব্রজেশ বলেন, “উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত সব থেকে অপদার্থ সেনাপ্রধান হলেন উনি।”
সাক্ষাৎকারে ব্রজেশ আজ বলেন, “সেনাপ্রধান যে ভাবে বিতর্ক তৈরি করেছেন, সেই অবস্থায় তিনটি বিকল্প ছিল। তাঁকে সেনাপ্রধান পদে রেখে দেওয়া, বরখাস্ত করা বা বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া।” ব্রজেশের কথায়, “তাঁকে বরখাস্ত করা উচিত হবে কি না, সে ব্যাপারে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছি। কিন্তু ভেবে দেখেছি, তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তুলনায় তাঁকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল। তাতে তাঁকে বরখাস্তও করা হল না। কিন্তু এ-ও বলা হল যে, আপনি দু’মাসের ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। সরকারের কাছ থেকে বেতন নিন। দু’মাস পর অবসর নিয়ে পেনশন উপভোগ করুন।” |
এরই পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো সেনাপ্রধানের চিঠি ফাঁস হওয়া নিয়েও আজ মন্তব্য করেন প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তাঁর কথায়, “প্রধানমন্ত্রী, যাঁকে সব থেকে শ্রদ্ধা করি, তিনি এই চিঠি ফাঁস করার মতো ব্যক্তি নন। তাঁর সচিবালয়ের কোনও আমলা তা করেছে বলে মনে করি না। সুতরাং যদি সেনাপ্রধান নিজে ওই চিঠি ফাঁস না করে থাকেন, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর কোনও বন্ধু তা করেছেন।”
ব্রজেশের এই মন্তব্য কংগ্রেস নেতৃত্ব ইতিবাচক বলেই মনে করছেন। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, সেনাপ্রধান যে সঠিক কাজ করেননি, সেই বার্তা মানুষের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। এই কথাটা সরকার বললে যতটা না গ্রহণযোগ্য, তার তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে বাজপেয়ীর দক্ষিণহস্ত বলে পরিচিত ব্রজেশ মিশ্র সে কথা বললে। অতীতে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তিতে বিজেপি আপত্তি করলেও, মনমোহন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রজেশ।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সেনাপ্রধানকে ছুটিতে পাঠানোর ব্যাপারে সরকার কেন পদক্ষেপ করেনি? কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রে এখন রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস যথেষ্টই দুর্বল। সরকার একাধিক সমস্যায় জেরবার। আর সেই কারণে জটিলতা বাড়াতে চায়নি কেন্দ্র। তবে সেনাপ্রধানকে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি প্রকাশ্যে ঘুষকাণ্ডের অভিযোগ না জানিয়ে নিজেই এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারতেন। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে লেখা তাঁর চিঠি ফাঁস হওয়ায় দেশের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গোটা বিতর্ক থেকে মনে হচ্ছিল, সরকার বনাম সেনাপ্রধান লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তা যে উচিত হচ্ছে না, তা ভি কে সিংহকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আর তার পর সেনাপ্রধান নিজেই বিবৃতি দিয়ে বিতর্ক লঘু করতে সচেষ্ট হন। তিনি তা না করলে সরকারকে ভাবতেই হত। তা ছাড়া ভি কে সিংহের বিবৃতির পরেও সরকার একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে নেই। কারণ, অতীতে ভি কে সিংহ সাময়িক ভাবে চুপচাপ হয়ে গিয়েও পরে ফের বিতর্ক তৈরি করেন।
তবে কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, ব্রজেশ মিশ্র-সহ প্রাক্তন কূটনীতিক ও আমলারা যে ভাবে সেনাপ্রধানের সমালোচনা করছেন, তাতে তিনিই এখন কিছুটা চাপে রয়েছেন। অন্য দিকে সিবিআই সূত্রেও আজ বলা হচ্ছে যে, প্রতিরক্ষা কেনাবেচায় তাঁকে ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে সিবিআইয়ের কাছে যে লিখিত অভিযোগ করেছেন সেনাপ্রধান, তা-ও খুব একটা জোরালো কিছু নয়। সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জানিয়েছিলেন, তাঁকে ১৪ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকার অঙ্কও সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেননি ভি কে সিংহ।
সিবিআই যদিও পুরোদস্তুর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকী, টাট্রা ট্রাক সরবরাহকারী সংস্থা ভেকট্রা গ্রুপের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার রবি ঋষির পাসপোর্টও আটকে রেখেছে। তাঁকে আবার জেরা করতে পারে সিবিআই। রবি যাতে ভারত ছেড়ে যেতে না পারেন, সে জন্য সব বিমানবন্দরকেও সতর্ক করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সেনাপ্রধানের চিঠি ফাঁস নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীও। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি আগেই জানিয়েছেন, চিঠি ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই চিঠি ফাঁসের ঘটনায় সেনাপ্রধানও সন্দেহের উর্ধ্বে নেই। সে দিক থেকে অ্যান্টনির মন্তব্য আসলে সেনাপ্রধানের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি বলেও অনেকে মনে করছেন। |