বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এসেছে উন্নত প্রযুক্তি যা সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। কিন্তু ভূকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক শক্তির কাছে এখনও অসহায় মানুষ।
এই বিপর্যয় রুখতে না পারলেও একটা বিষয়ে সব বিজ্ঞানীরা কিন্তু এক মত যে, সঠিক কারণ জানা গেলে বিপর্যয়ে আগাম আভাস দেওয়া সম্ভব। ফলে সহজেই এড়ানো যেতে পারে ক্ষয়ক্ষতি।
|
আত্রেয়ী ঘোষ |
আর সেই পথেই গবেষণা করে ভূকম্পনের জন্য কোন কোন কারণ দায়ী তা নিয়ে একটি উন্নত গাণিতিক কম্পিউটার মডেল তৈরি করে ফেলেছেন এক বাঙালি বিজ্ঞানী। নাম আত্রেয়ী ঘোষ। আমেরিকার নিউ ইয়র্কের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত আত্রেয়ী ও সহকারী বিজ্ঞানী উইলিয়াম ই হল্টের দাবি, এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে যত মডেল আছে সেগুলো থেকে অনেক নিখুঁত ভাবে ভূকম্পের কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে তাঁদের আবিষ্কৃত এই গাণিতিক মডেলের সাহায্যে। তাঁদের এই গবেষণা ১৭ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
কলকাতাতেই জন্ম, বেড়ে ওঠা। গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল থেকে পাশ করে পদার্থবিদ্যা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। পরে মুম্বই আইআইটি থেকে স্নাতকোত্তর পাশ। স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করে এখন সেখানেই গবেষণা করছেন আত্রেয়ী। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মা গৃহবধূ। তাঁর বিজ্ঞানচর্চার পিছনে বাবার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে জানান তিনি।
উপগ্রহ চিত্রে পৃথিবীর যে রূপ এখন আমরা দেখতে পাই তার সঙ্গে কোটি কোটি বছর আগের পৃথিবীর মিল নেই। ভবিষ্যতের পৃথিবীর রূপও যে এখনকার মতো থাকবে না সে বিষয়েও বিজ্ঞানীরা এক মত। বরং তাঁদের মতে প্রতি মুহূর্তেই পৃথিবী একটু একটু করে নিজের রূপ বদলাচ্ছে। অনেক বছরের গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন পৃথিবীর এই রূপ বদলানোর পিছনে দায়ী এর উপরিভাগ জুড়ে থাকা কয়েকটি টেকটোনিক প্লেট এবং তার নীচে পৃথিবীর গভীরে থাকা ম্যান্টল স্তরের চলাফেরা। গলিত ম্যান্টলের প্রবাহের ফলে তার উপরে থাকা টেকটোনিক প্লেটগুলোর কখনও কখনও একে অপরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগে। কখনও বা তারা একে অন্যের থেকে দূরে সরে যায়। আবার একটি প্লেট অন্যের উপরে উঠে গিয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটে। ফলে তৈরি হয় পাহাড়, কখনও বা খাদ। |
আর এই পরিবর্তনের সঙ্গী হয় ভূকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, সুনামি।
নিউ ইয়র্ক থেকে আত্রেয়ী জানালেন, প্লেটগুলো তলার ম্যান্টলের উপরে ভেসে থাকে। দু’টি প্লেট সামনাসামনি এসে পড়লে ঘটে সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষস্থলেই সব থেকে বেশি ভূকম্প হয়। ম্যান্টলের প্রবাহের উপরেই নির্ভর করে প্লেটগুলো সামনাসামনি আসবে না দূরে যাবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে সব থেকে কঠিন কাজ হল এই ম্যান্টলের গতিবিধি নির্ধারণ করা এবং এর পিছনে কী কী শক্তি দায়ী তা খুঁজে বের করা। আত্রেয়ীর দাবি, জিওলজিকাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস)-এর সাহায্যে সংঘর্ষস্থলে প্লেটগুলোর অবস্থান, সংঘর্ষের ফলে তৈরি শক্তির প্রবাহ এবং কম্পন মাপক যন্ত্রের সাহায্যে পাওয়া তথ্য থেকে যে গাণিতিক মডেল তৈরি করেছেন, তা থেকে তাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে অনেক নিখুঁত ভাবে জানতে পেরেছেন। সেই সঙ্গে পৃথিবীর ভিতরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন শক্তির প্রভাব ম্যান্টল প্রবাহের গতিবিধি কী ভাবে প্রভাবিত করছে সে সম্পর্কেও অনেক স্পষ্ট ধারণা করতে পারছেন।
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে আত্রেয়ী জানান, একটা বড় পাত্রে ময়দার স্তূপ চূড়ো করে রাখলে তা কিছুক্ষণ পরে নীচে নামতে থাকে এবং এক সময়ে তা সমান হয়ে যায়। ঠিক একই ভাবে সব পাহাড়ও ক্রমশ নীচের দিকে নামার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু এই ঘটনা এত ধীরে ঘটতে থাকে যে তা আমরা লক্ষ্য করি না। পাহাড়ের এই নীচের দিকে নামার চেষ্টা তার আশপাশের অঞ্চলে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। একে ‘গ্র্যাভিটেশন্যাল পোটেনশিয়াল এনার্জি ফোর্স’ বা জিপিই বলে। উদাহরণ দিয়ে আত্রেয়ী বলেন, “হিমালয় পর্বতমালা নীচের দিকে নামার চেষ্টা করে ভারতীয় (ইন্ডিয়ান) প্লেটকে কয়েক কোটি বছর ধরে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু ইন্ডিয়ান প্লেটের তলার ম্যান্টল উল্টো পথে হিমালয়ের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নীচের দিকে নামতে পারছে না হিমালয়।” কিন্তু এর ফলে হিমালয়ের নীচে ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে সব সময় একটা ঠোকাঠুকি হয়েই চলেছে। তাই হিমালয় ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্প হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত ভূবিজ্ঞানী জ্ঞানরঞ্জন কয়ালের কথায়, “ভূকম্পের সঠিক কারণ জানতে অনেক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালাচ্ছেন। এই নিয়ে বেশ কিছু মডেলও তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও উন্নত মডেল তৈরি হবে। তবে এক জন বাঙালি হিসেবে আত্রেয়ীর এই গবেষণা যে ‘সায়েন্স’-এর মতো বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।” কিন্তু এখনও আরও অনেক দূর যেতে হবে বলে মনে করেন জ্ঞানরঞ্জনবাবু।
আত্রেয়ীও বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরকে সঠিক ভাবে চেনা আর তাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটাকে বোঝাটাই আসল। আর যে দিন এটা ঠিক ভাবে বোঝা যাবে সে দিন হয়তো ভূকম্পনককে অনেকটা কম ভয়ের চোখে দেখবে মানুষ। |