আলু চাষে এ বার ‘শাপে বর’ এ রাজ্যের চাষিদের।
মরসুমের গোড়ায় ধসা রোগ এবং ভাইরাসজনিত রোগ আলু চাষে অনেকটাই ক্ষতি করেছে। সার্বিক ভাবে ফলনও কম হয়েছে। সেই ‘শাপ’ই এখন হাসি ফোটাচ্ছে আলুচাষিদের মুখে। কেননা, মাঠ থেকেই জ্যোতি আলু কেজি প্রতি ৮ টাকা এবং চন্দ্রমুখী আলু সাড়ে ৯ টাকা দরে বিকোচ্ছে। বস্তা এবং পরিবহণ খরচ ধরলে কেজি প্রতি সেই দাম আরও ২-৩ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। দিন যত গড়াবে, দাম আরও বাড়বে বলে আশা চাষি এবং ব্যবসায়ী মহলের। স্বস্তির শ্বাস ফেলছে কৃষি দফতরও।
দফতরের তথ্যই বলছে, গত বার রাজ্যের ৪ লক্ষ ৮ হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল। আলু উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ টন। এ বার চাষ হয়েছে ৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে। ফলন হয়েছে ১ কোটি ২৫ লক্ষ টনের মতো। আলুচাষিরা যে এ বার ভাল দর পাচ্ছেন, তা মেনে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মঙ্গলবার বর্ধমান পুলিশ লাইনের এক জনসভায় মমতা বলেন, “গত বার আলুচাষিরা কেজি পিছু দুই থেকে আড়াই টাকা দাম পেয়েছিলেন। এ বার সেখানে কম করেও ৬-৭ টাকা পাচ্ছেন।” |
প্রশ্ন হল, মাত্র ১০ লক্ষ টন কম ফলনের জন্য দামের এতটা হেরফের হচ্ছে কী করে? কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্যতম প্রধান কারণ এ রাজ্যের আলু এ বার ভিন্ রাজ্যে যাওয়া। ফলে এ রাজ্যে আলুর চাহিদা বাড়ছে। পঞ্জাবে বৃষ্টির কারণে আলুচাষ মার খেয়েছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশেও আলুর ফলন অপেক্ষাকৃত কম। ফলে, ওই সব রাজ্যে আলু যাচ্ছে ব্যাপক হারে। গত বার মালগাড়ির সমস্যার কারণে অসমে আলু পাঠানো যায়নি।
তারকেশ্বরের এক আলু ব্যবসায়ী জানালেন, এ বার ইতিমধ্যেই অসমে মালগাড়িতে ৬ বার আলু গিয়েছে। মালগাড়ির এক একটি ওয়াগনে ৩৫ হাজার প্যাকেট (এক প্যাকেটে ৫০ কেজি) আলু তোলা যায়। মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন বর্ধমানে চাষিদের রফতানিযোগ্য আলু চাষের উপরে জোর দিতে বলেছেন। ঘটনা হল, এ বার আলুর গুণগত মান ভাল হওয়ায় ভিন্ রাজ্যে চাহিদা বেড়েছে।
আলুর কম ফলনও অবশ্য দাম বাড়ার পিছনে কাজ করেছে। আগে বার বার আলু ফলিয়ে দাম না পাওয়ায় এ বার বহু চাষি কিছুটা কম জমিতে চাষ করেন। বর্ধমান এবং হুগলিতে এ বার চন্দ্রমুখী ও জ্যোতি আলু কম হয়েছে। একই প্রবণতা দেখা গিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম এবং উত্তরবঙ্গে। যার ফলে, অতিফলন জনিত ঝক্কিও অনেকটা কমেছে। কৃষিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও বলেন, “এ বার আলু চাষের জমির আয়তন কিছুটা কমেছে। তার সঙ্গে ফলনও কম হওয়ায় আলু চাষিরা দাম পাচ্ছেন।”
অথচ অতিফলনের জেরে দাম না পাওয়ায় গত কয়েক মরসুমে কেবলই হতাশা সঙ্গী হয়েছে আলুচাষিদের। অভিযোগ, আলুর দাম না পাওয়ায় রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমানের কালনায় এবং গলসিতে গত মরসুমেই আত্মঘাতী হন দুই চাষি।
এ বার সেখানে তারকেশ্বরের কেশবচক গ্রামের আলুচাষি গোপাল পাল বলছেন, “বস্তাছাড়া জ্যোতি আলুর দাম ৫০ কেজি প্রতি ৩৫০-৩৮০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। বস্তা ও পরিবহণ খরচ মিলিয়ে সেই দাম আরও কিছুটা বেশি।” পুড়শুড়ার আলুচাষি উৎপল পাল বলেন, “চন্দ্রমুখী আলু বস্তা-সহ ৪৩০-৪৫০ টাকায় বিক্রি করছি।” ‘রাজ্য আলু বীজ ব্যবসায়ী সমিতি’র সহ-সম্পাদক, বর্ধমানের রায়নার বাসিন্দা দেবেশ ঘোষের কথায়, “তিন দশক ধরে আমি ব্যবসায় যুক্ত। এত অনুকূল পরিস্থিতি অনেক দিন পরে এল।”
এই পরিস্থিতিতেও অবশ্য চাষিদের একাংশের আলু ধরে রাখার প্রবণতা নিয়ে আশঙ্কা থাকছে। ‘প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতি’র রাজ্য নেতা স্বপন সামন্ত বলেন, “এই প্রবণতা মারাত্মক। গতবারই পুজোর মুখে দাম বাড়বে ধরে বহু চাষি আলু ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায় তাঁদের মাথা চাপড়াতে হয়েছে।”
খুশির আবহে কৃষিজীবীদের জন্য এটুকুই যা সাবধান-বাণী। |