‘দুর্যোগে’ অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই দীনেশের
নমোহন সিংহের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফার পরে কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। তাঁর ভবিষ্যতের পথটি কতটা দুর্যোগপূর্ণ হতে চলেছে, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর কাছে।
কংগ্রেস বা বিজেপির মতো বড় দলগুলির কেউই এখন দীনেশকে নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছে না। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁরা দীনেশকে স্পর্শ করতেও চান না! আবার যে কংগ্রেস নেতৃত্ব গোড়ায় ভেবেছিলেন, রেলমন্ত্রী পদে থেকেই মমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে যাবেন দীনেশ, তাঁরাও এখন বুঝছেন, মমতাকে ছাড়া গতি নেই। সামনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও মমতাকে দরকার কংগ্রেসের। সনিয়া গাঁধীও মমতার মতো শরিককে পাশে নিয়েই চলতে চান। তা ছাড়া, রেলমন্ত্রী থেকে মমতার বিরুদ্ধে যে লড়াইটা দীনেশ করতে পারতেন, মন্ত্রক চলে যাওয়ার পরে তা আর সম্ভব নয়। তৃণমূলেরও কেউ দীনেশের পাশে দাঁড়াননি।
এই পরিস্থিতিতে দীনেশ কী করবেন? এই প্রশ্নই এখন রাজধানীতে ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রথম সারির মার্কিন সংবাদপত্রে তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ, জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের একাংশে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীকে নিয়ে অনেক প্রচার হতে পারে, কিন্তু দীনেশ নিজে বুঝতে পারছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘মমতা বিনে গীত নাই’! মমতাই সেখানে ‘আইকন’। কংগ্রেস বা বিজেপির মতো বড় দলগুলি যেমন তাঁকে নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে না, তেমনই মনোভাব আঞ্চলিক দলগুলিরও। কারণ, তারাও এখন নানা বিষয়ে মমতাকে পাশে পেতে চাইছে। ফলে সম্পূর্ণ এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে দীনেশ। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী অবশ্য বলেন, “আমি এখনও এই সব বিষয়ে কিছু ভাবছিই না। রেল ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আমার বিবেক যা বলেছে, সেই অনুযায়ী আমি বাজেট পেশ করেছি। আমার মাথায় এর পরে আর কোনও পরিকল্পনা নেই। কোনও অঙ্ক কষে আমি এগোচ্ছি না।”
এক সময় অরুণ নেহরু ছিলেন দীনেশ ত্রিবেদীর ‘মেন্টর’। সেই সূত্রে ভি পি সিংহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও গড়ে ওঠে তাঁর। অরুণ নেহরু এখন দিল্লির এক খামারবাড়িতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে দীনেশের যোগাযোগ রয়েছে বটে, কিন্তু অরুণ নেহরুর এখন আর সেই প্রভাব নেই যে দীনেশকে রাজনৈতিক দলে নিয়ে আসেন। এই অবস্থায় নিজেকেই সময় দিচ্ছেন দীনেশ। মন দিয়ে শুনছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, পাকিস্তানি গজল। গত কাল দক্ষিণ কলকাতার একটি হলে গিয়ে ‘আবার ব্যোমকেশ’ সিনেমাটি দেখেছেন। শনিবার একটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বাঙালি খাবার খেয়ে সন্ধ্যায় সিনেমা হলে গিয়ে বিদ্যা বালনের ‘কহানি’ দেখেছেন। ক’দিন বাদেই আমেরিকায় ছেলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করবেন। সেই সময়ে সেখানেও যেতে পারেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। দীনেশের কথায়, “আমি গান শুনছি, বই পড়ছি। কোনও উদ্বেগ নেই, উৎকণ্ঠা নেই। আনন্দেই দিন কাটাচ্ছি। নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ মনে হচ্ছে।”
কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ ভেবেছিলেন, দীনেশ তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে একটা ভাঙন ধরাতে পারেন। কিন্তু এখন দলত্যাগ বিরোধী আইনে বদল হয়েছে। দল ভেঙে বেরিয়ে আসতে গেলে আগে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। এখন তা বদলে হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। আর অন্য দলের সঙ্গে মিশে যেতে গেলে গোটা দলটিকেই নিয়ে যেতে হবে। যেমন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার এক জন সাংসদ হিসেবে কে ডি সিংহ যখন তৃণমূলে এলেন, তখন এক জন থাকার সুবাদে গোটা দল হিসেবেই ধরা হয়েছিল। কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ তো দূরস্থান, নিজের সঙ্গে তৃণমূলের তিন জনকেও জোগাড় করতে পারেননি দীনেশ! কংগ্রেস নেতৃত্বও এখন বুঝতে পারছেন, মমতার দল যথেষ্ঠ সুসংহত। এখন যদি মমতা দীনেশকে দল থেকে অপসারণ করতেন, তা হলে তিনি নির্দল সাংসদ হিসেবে থেকে যেতেন পারতেন বা কংগ্রেসে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু মমতা সেই পথে হাঁটেননি। ফলে কবীর সুমনের যা অবস্থা হয়েছে, দীনেশের অবস্থাও কতকটা সেই রকম। দীনেশও দলত্যাগ বিরোধী আইনের ফাঁদে পড়তে চাইছেন না। বুঝতে পারছেন, দলে থাকতে গেলে দলের নির্দেশ তাঁকে মানতেই হবে।
এই পরিস্থিতিতে একটাই বিকল্প খোলা রয়েছে দীনেশের সামনে। তিনি যদি লোকসভার আসনটি ছেড়ে কংগ্রেস বা অন্য কোনও দলে যোগ দেন। কিন্তু যে দলেই যান, তাঁকে যে লোকসভার কোনও আসনে দাঁড় করানো হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আবার দাঁড় করালেও তিনি যে সেখান থেকে জিতবেন, তা-ও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। মমতার সমর্থন ছাড়া নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ব্যারাকপুর থেকেও তাঁর জেতা যে অসম্ভব, তা ভালই জানেন দীনেশ। তা ছাড়া অন্য প্রশ্নও আছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গুজরাত বা অন্য রাজ্য থেকে কোনও দল কেনই বা তাঁকে প্রার্থী করবে? ফলে সব দিক থেকেই সমস্যায় প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। দীনেশ নিজেও এখন বুঝতে পারছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া তাঁর কোনও গতি নেই। তাঁকে আপাতত তৃণমূলেই থাকতে হবে। তাই তিনি মমতার প্রতিও সুর নরম করছেন। মমতার নেতৃত্বের প্রশংসাও করছেন। তাঁর করা বাজেটে যে মমতার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সে কথা ফলাও করে উল্লেখ করছেন। ইস্তফা দেওয়ার আগে যে দিন মমতাকে ফোন করেছিলেন, সে দিন তৃণমূল নেত্রী দীনেশকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তিনি। বরং মমতা তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি সংসদীয় দলে থাকুন।” পরে দীনেশ সেই বৈঠকে যোগও দিয়েছিলেন। রেলমন্ত্রী হিসেবে মুকুল রায়ের শপথ গ্রহণের দিন রাষ্ট্রপতি ভবনে দীনেশের না যাওয়া নিয়ে যখন দলের ভিতরে অনেক গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, তখন কিন্তু মমতা রুষ্ট হননি। ঘনিষ্ঠ মহলে তৃণমূল নেত্রী বলেন, এটি বড় ইস্যু নয়। দীনেশের মনোভাব তিনি বুঝতে পারেন।
মমতার ঘনিষ্ঠ মহল থেকেও ইঙ্গিত এসেছে, দীনেশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন ভূমিকায় কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “ব্যক্তি কখনও প্রতিষ্ঠানের থেকে বড় হতে পারেন না। সংগঠনে মমতার নেতৃত্বও দীনেশকে মানতে হবে, তার উপরে ওঠা যায় না। কৌশলগত ভাবে দীনেশ যে ভুল করেছেন, তার খেসারত তাঁকে দিতেই হবে। অমর সিংহের মতো নেতা দীনেশের থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হলেও মুলায়মের দল ছেড়ে পেরে ওঠেননি। এখন অমর সিংহের একদা ঘনিষ্ঠ অমিতাভ-জয়া বচ্চনরাও মুলায়মের শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন। জয়া প্রদা ছাড়া অমরের পাশে এখন কেউই নেই। দীনেশেরও অমর সিংহের থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।”
অতীতে শিবসেনার সঙ্গে ঝামেলার সময় সুরেশ প্রভু বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রিত্ব খুইয়েছিলেন। বিজু জনতা দল ভেঙে নবীন পট্টনায়কের বিরোধীরা যখন লালকৃষ্ণ আডবাণীর কাছে এসেছিলেন, তখন নবীনের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। তৃণমূলের গোলমালের সময়েও বিজেপি মমতার সঙ্গ ছাড়েনি। কংগ্রেসের কেউ কেউ আবার ভবিষ্যতে রাষ্ট্রদূত, রাজ্যপালের মতো পদের টোপও দিয়ে রাখছে দীনেশের জন্য। কিন্তু এই প্রলোভনে কতটা পা দেওয়া উচিত, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন দীনেশ। কংগ্রেস যে ভাবে মমতার কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছে, তা নিয়ে তাঁর মনে মনে ক্ষোভ রয়েছে। এই অবস্থায় দীনেশ বুঝতে পারছেন, হয় তৃণমূল ছেড়ে তাঁকে বেরিয়ে যেতে হবে, না হয় দলের সঙ্গে সমঝোতা করেই চলতে হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.