|
|
|
|
|
|
|
মাতালনামা |
সে রসে যাঁরা বঞ্চিত নন, তাঁদের ঢুকঢুক চুকচুক সভ্যতা নিয়ে লিখছেন অমিতাভ গুপ্ত।
তবে মনে রাখবেন, এই লেখায় (পান) পাত্র ছাড়া বাকি সব পাত্রই কাল্পনিক।
|
সিনেমায় ভিলেন আর অমিতাভ বচ্চন গেলাসে করে লাল রঙের কী খায়, ছোটবেলা থেকেই সেটা জানার অদম্য কৌতূহল ছিল। বাড়িতে প্রশ্ন করায় বুঝিয়ে বলা হল, ওটা কোল্ড ড্রিঙ্ক। তা, সেই কোল্ড ড্রিঙ্ক চেখে দেখার বাসনা যখন তীব্রতর হয়ে উঠল এবং নাকের তলায় যে রোঁয়াগুলো বেরোচ্ছিল, সেগুলোকেও যখন গোঁফ বলে চালিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হল, তখন কোল্ড ড্রিঙ্ক খেতে বেরোনো গেল। চেনাজানার মধ্যে বখা সুধীজনের অভাব ছিল না, তাদেরই কেউ কেউ বুঝিয়ে বলল, লাইটহাউসের বারে গেলে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিয়ার খেলে নেশা কম হবে এবং চুইংগাম চিবিয়ে নিলে বাড়িতে আর গন্ধ পাওয়া যাবে না, সেটা জানা ছিল। দুই মক্কেল এক বিকেলে পৌঁছলাম। গম্ভীর মুখে বেয়ারাকে অর্ডার দিলাম, দু’পেগ বিয়ার। অর্ডারের বহর দেখে বেয়ারা যা বোঝার বুঝল। ফলে, যেটা খেয়ে রাস্তায় সোজা লাইন ধরে হেঁটে মাতাল হয়েছি কি না পরীক্ষা করে চুইংগাম, তুলসীপাতা এবং আরও দু’চারটে জিনিস খেয়ে বাড়ি ফিরলাম, সেটা সম্ভবত আদি-অকৃত্রিম কোল্ড ড্রিঙ্কই ছিল। সেই লাইটহাউস উঠে গিয়ে এখন একটা কুৎসিত শপিং মল হয়েছে। শঙ্খ ঘোষের বইয়ে পড়েছিলাম, কোনও এক মাস্টারমশাই নাকি ট্রামে করে বাড়ি ফেরার সময় বসুশ্রী সিনেমা পেরোলেই দু’হাতে চোখ চেপে মাথা নামিয়ে বসে থাকতেন, যাতে ভুল বানানের ‘উজ্জলা’ সিনেমার নামটি তাঁর চোখে না পড়ে। নিউ মার্কেটের সামনেটায় হাঁটলে এখন আমারও ঠিক সেই ইচ্ছেটাই হয়।
যাক গে, মাতালদের গল্পে আসি। আমাদের যখন নিতান্ত বালক বয়েস, তখন আমাদের পাড়াটা আধা-মফস্সল ছিল। ‘লোকে শ্যামবাজারে গেলেও ফিরে এসে বলত, কলকাতায় গিয়েছিলাম’ টাইপ। সেই পাড়ায় মাতালদের পীর মুর্শিদ ছিলেন বাবুরাম। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের সন্তান, অল্প বয়েসেই যথাবিধি কুসঙ্গে পড়ে সম্পূর্ণ বখে যাওয়ায় বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন। সম্পূর্ণ নয়, আধাখেঁচড়া ত্যাজ্য। অর্থাৎ, বাবার সঙ্গে বাড়িতে একই তলায় থাকা নিষিদ্ধ হল। বাড়ির এক তলায় বাবুরাম মামার জন্য একটা ঘর নির্দিষ্ট হল, যার সঙ্গে বাকি বাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই। এই রকম ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার জন্য বেশ কয়েক জন্ম তপস্যা করতে হয়। অবশ্য, তপস্যার খানিকটা জন্মের বাউন্ডারি টপকে এই জন্মেও এসে পড়েছিল। ভদ্রলোক কালীসাধক ছিলেন। সকালে পুকুরে স্নান করে রক্তবসন পরে বাড়ি ফিরতেন কী সব জপ করতে করতে। সেই সাধনার কোয়ালিটি সম্বন্ধে ধারণা নেই, কিন্তু শ্যামাসঙ্গীতের গলা সত্যি অসাধারণ ছিল। পান্নালাল ভট্টাচার্য ছাড়া অমন অসাধারণ ‘আমার সাধ না মিটিল’ কখনও কারও গলায় শুনিনি। বাবুরাম মামার বাড়ির এক তলার ঘরটা এলাকার সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মাতালের জন্য অবারিত দ্বার ছিল। সকালে বাবুরাম মামা স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে, এবং বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে পর দিন সকালে স্কুলে বেরোনোর আগে পর্যন্ত সেই আসরের মধ্যমণি ছিলেন তিনি নিজেই। আর, বাকি সময়টা অন্যদের নিজেদের চেষ্টায় করে খেতে হত। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ হত না।
কালীসাধক হওয়ায় বাবুরাম মামার মেজাজটা যাকে বলে ঠিক মোলায়েম ছিল না। মাঝেমধ্যেই মুখখারাপ করত। তা, ওটুকু আর কেউ গায়ে মাখত না। বাজারে পুঁটি মাছের দর কেমন সের্গেই বুবকার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, শ্যাওড়াফুলি লোকালে যে লোকটা আচার বিক্রি করে, সে আসলে কোটিপতি কি না, জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট হওয়ার আগে হাসতেন কি না এবং এই রকম আরও অনেক জরুরি ব্যাপারে সুচিন্তিত মতামত দিয়ে যেত। বাবুরাম মামা আরও কয়েক বার তাঁর পিতা এবং তস্য ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষকে স্মরণ করেও যখন দেখত যে এই হল্লা থামানো যাচ্ছে না, তখন ব্যোম কালী বলে লাফিয়ে উঠেই ঘরের আলো নিভিয়ে দিত। |
|
ছবি: দেবাশীষ দেব |
সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জন লাফ দিয়ে উঠে তক্তপোষের তলায়, আলমারির মাথায়, আলনার পিছনে লুকিয়ে পড়ত। ইতিমধ্যে বাবুরামের হাতে লাঠি, আর সেই লাঠি দমাদ্দম চলত। মাঝেমধ্যেই আর্তনাদ, আর ‘ব্যোম কালী’ বলে হুঙ্কার, অবশ্যই আলাদা আলাদা কণ্ঠস্বরে। মিনিট পাঁচেক পরে নিজেই লাঠি থামিয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিত। যারা সময় মতো লুকিয়ে পড়তে পেরেছিল, অথবা আল্লাতালার অসীম রহমতে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেও অক্ষত রয়েছে, তারা আহতদের ধরে ধরে ঘর থেকে বের করে দিত। ওটাই নিয়ম। অক্ষতরা আবার নিজের নিজের গেলাস বোতল নিয়ে বসে পড়ত। ঘরমণি মাতাল পিটিয়ে যে দিন মেজাজ খুব ভাল হয়ে যেত, সে দিন হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বাবুরাম মামা গান শোনাত।
এক বার স্কুলে পুজোর বোনাস পেয়ে তারাপীঠ গেল বাবুরাম মামা। শ্মশানে গোটাকয়েক তান্ত্রিকের গান শুনে নাকি একদম ফেলাট। তাদের দেদার মাল খাওয়াল। তান্ত্রিকরাও খুশি। এ রকম মুরগি পাওয়া মানে মা মুখ তুলে তাকিয়েছেন। জয় মা। বাবুরাম মামা তান্ত্রিকদের এমনই ভক্ত হয়ে গেল যে তাদের ছেড়ে আর ফেরার নাম করে না। শেষমেশ তান্ত্রিকরাও সঙ্গে এলেন। আসা তো নয়, যেন আবির্ভাব। ঘরে গানের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, বোতলের পর বোতল রাম ফুরোচ্ছে আর আসছে। তান্ত্রিকরা ভাগ্যদেবীর এ হেন আকস্মিক পক্ষপাতে নার্ভাসই হয়ে গেল।
কিন্তু হায়! যে কোনও ভাল জিনিসের মতো টাকাও ফুরিয়ে যায়। বাবুরাম মামার বোনাসের টাকাও ফুরোল। এর ওর কাছে ধার নিয়ে আরও কিছু দিন সাধুসঙ্গ চলল। সঙ্গে ঠারেঠোরে ইশারা অনেক তো হল, এ বার ডেরাডাণ্ডা তুলে রওনা দিলেই হয়। কিন্তু তান্ত্রিকরা নিজেদের সৌভাগ্যের চিরস্থায়িত্বে এতই বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল যে ইশারা ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। অতএব, এক রাতে লাঠি বেরোল। তবে, এ দফায় বেধড়ক নয়। বাবুরাম মামা লাঠি হাতে তান্ত্রিকদের হুকুম দিলেন, ‘থাক শালারা সারা রাত নিলডাউন হয়ে। যে নড়বি, তারই হাঁটু ভেঙে দেব।’ পর দিন সকাল থেকে আজ অবধি আমাদের পাড়ায় কোনও তান্ত্রিকের দেখা পাওয়া যায়নি।
শ্মশানের কথাই যখন উঠল, তখন আরও খানিকটা বলি। শ্মশানে দু’ধরনের মাতাল আছে রেসিডেন্ট মাতাল আর ভিজিটিং মাতাল। বার কয়েক শ্মশানে গেলেই রেসিডেন্ট মাতালদের সঙ্গে জান পহেচান হয়ে যায়। ভিজিটিং মাতাল প্রতি বারই নতুন। এ বার যে কথাটা বলব, সেটা শুনেই আমায় শ্রেণি চেতনা, পুঁজিবাদের আগ্রাসন, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে ঢের কথা শুনিয়ে দিতে পারবেন। শ্মশানে একটা ক্লাস আসে, যারা এখনও কাঁধে বডি বয়ে নিয়ে আসে। একটু গরিব, অশিক্ষিত টাইপ আগে যাদের ছোটলোক বলত, আজকাল ভাল বাংলায় সাবঅল্টার্ন বলে। এই পার্টির অনেক রকম চারিত্রিক বিশেষত্ব আছে। তার একটা হল, এদের মধ্যে গোটা দুয়েক ভিজিটিং মাতাল থাকবেই, যাদের কাজ হল প্রথমে প্রচুর পরিমাণে বাংলা খেয়ে সম্পূর্ণ বেহেড হয়ে যাওয়া এবং তার পর যখন বডি চুল্লিতে ঢোকানো হয়, তখন ‘ও দাদু গো, তুমি আমায় ফেলে চলে যেয়ো না গো, এই সালা আমিও দাদুর সঙ্গে যাব, আমায় আটকাস না, ও দাদু’ বলে প্রচণ্ড চেঁচামেচি করা। অন্যরাও রেডি থাকে। খেলা আরম্ভ হলেই তারা ভিজিটিং মাতালকে টেনে ধরে রাখে আর এই টানাটানির মধ্যে চুল্লিতে বডি ঢুকে যায়, তখন সবাই বাইরে গিয়ে চা খায়।
এক দিন গল্পটা অন্য রকম হল। বডির পাশে এক জন মহিলা অনেক ক্ষণ চুপচাপ বসে চোখ মুছছিলেন। রোগা ক্ষয়াটে মার্কা চেহারা। চুল্লির ঘরের কোলাপসিবল গেট খোলা হল। বডি ভিতরে ঢুকল। ভিজিটিং মাতাল প্রথমে একটু নিচু স্কেলে কান্না ধরল। এটা নিয়মের মধ্যে পড়ে। যাঁর নামে খারাপ কথা বললে এখন পাড়ায়-বেপাড়ায় বেধড়ক ঠেঙানি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে, একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউই নাটকের গোড়া থেকেই গাঁকগাঁক করেন না। সে যাক। যেই চুল্লির লোহার দরজা খুলতে আরম্ভ করেছে, অমনি ‘ও দাদু গো, তুমি কোথায় চলে গেলে গো, আমাকেও নিয়ে যাও গো’ আরম্ভ হল। অন্যরা তাকে ধরে টানার আগেই ভদ্রমহিলা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার ঘাড়ে। পায়ের হাওয়াই চটি হাতে, ফটাস ফটাস মারছেন আর চেঁচাচ্ছেন, ‘তুই যা দাদুর সঙ্গে। ঢোক তুই ভিতরে। দেখি কোন শালা তোকে আটকায় আজ!...’ মহিলা যা যা বলেছিলেন, তার পুরোটা লিখলে আমায় অশ্লীলতার দায়ে সোপর্দ করা হবে, তাই সেন্সর করে দিলাম।
মাতাল এবং তার আশেপাশের লোকদের গল্প বলার প্রধান সমস্যা এইটাই। তাই, দুর্গাপুজোর সন্ধ্যায় আকণ্ঠ গিলে আমার এক বন্ধু আর এক বন্ধুর কাকিমাকে দেখে কী রকম প্রেমে পড়ে গিয়েছিল, সেই গল্পটা এখানে বলতেই পারব না। ওই সব সেন্সরের সমস্যা না থাকলে বলতাম, আমার ওই বন্ধুটির মনে একটা বিজ্ঞানীসুলভ অনুসন্ধিৎসা ছিল। ফলে, হুইস্কি-রাম-ভদকা এক সঙ্গে খাওয়ার পর কয়েক ছিলিম গাঁজা খেলে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয় কি না, আল্ট্রা ভায়োলেট রে দেখতে পাওয়া যায় কি না, ইত্যাদি জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সে সন্ধে থেকে মিলিয়ে মিশিয়ে মদ-গাঁজা খেতে থাকে। অষ্টমীর রাত। আর এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধিপুজোর নেমন্তন্ন রয়েছে। এক পর্ব নেশা শেষ করে সেই বাড়িতে পৌঁছনো গেল। তার পর, চিলেকোঠায় বসে আরও এক দফা। নীচ থেকে যখন ডাক পড়ল, তখন সন্ধিপুজো হয়ে গিয়েছে। কেউ আর নিজের পায়ে নীচে নামার মতো অবস্থায় নেই। বাড়ির লোকও নাছোড়বান্দা। প্রসাদ দেবেই। বেশ কয়েক বার ডাকাডাকির পরেও যখন কেউ নীচে নামতে রাজি হল না, তখন পর্বতই মহম্মদের কাছে এল। মানে, ওই বন্ধুটির ছোটকাকিমা। আমাদের থেকে বছর সাতেকের বড় হবেন। সেই প্রথম দেখা। চেহারার বর্ণনা দেব না, ভাববেন নির্জলা গুল দিচ্ছি। আমরা প্রাণপণে মুখ সরিয়ে রেখেছি, যাতে মুখনিঃসৃত খোসবাই কাকিমা অবধি না পৌঁছোয়। কিন্তু, সেই অনুসন্ধিৎসু বন্ধুটির কুলকুণ্ডলিনী সম্ভবত জেগে উঠেছিল। সে কাকিমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে যে বন্ধুর বাড়ি, তাকে চিৎকার করে বলল, ‘ওরে বুবাই, ... কে রে?” এবং তার পর কাকিমা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত এবং সম্পূর্ণ আনসেন্সর্ড প্রশস্তি। তার পরেও বন্ধুবিচ্ছেদ হয়নি। ওদের পারিবারিক কলহ কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল, হেঁসেল আলাদা হয়েছিল কি না সে সব আর খোঁজ করিনি। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর কু-অভ্যাস আমাদের নেই।
তার চেয়ে বরং একটা নিরাপদ গল্প বলি। তখন দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নেশার মুক্তাঞ্চল হিসেবে আমাদের ক্যাম্পাসের বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। এক দিন এক সিনিয়ার দেখলুম একটু অবিন্যস্ত ভাবে করিডর দিয়ে হাঁটছে। এক বার ভাবলাম চলে যাই, নেশাড়ু হিসেবে এই দাদাটির বেশ নামডাক আছে। তার পর কী মনে হওয়ায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি, সে নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ পকেট হাতড়িয়ে চাবি বের করল। তার পর শুরু হল স্ট্রাগল। চাবি আর কিছুতেই তালায় ঢোকানো যায় না। বেশ খানিক ক্ষণ দেখার পরে এগিয়ে গেলাম। বললাম, আমি হেল্প করব? দাদা আমায় দেখে খুব খুশি। বললেন, করবি? আচ্ছা, দরজাটাকে একটু স্টেডি রাখ তো!
এই সব আবোলতাবোল কথার মধ্যে একটা গভীর প্রশ্ন করি রবীন্দ্রনাথ কি মদ্যপান করতেন? প্রশ্নটা আমার নয়, প্রাবন্ধিক সমীর সেনগুপ্তর। তিনি অনেক বই ঘেঁটে, অনেক হিসেবপত্র দেখে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে কবিগুরু রীতিমত মদ খেতেন। শুধু তাই নয়, বড়দের সঙ্গে বসে মদ না খাওয়ার মধ্যবিত্ত ন্যাকামো থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। ছোটদের সঙ্গেও খেতেন। মদ্যপদের প্রতি নাকি তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও ছিল। নির্মলকুমারী মহলানবীশ তাঁর বিলেতবাসের গল্পে জানিয়েছিলেন, এক ভোজসভায় তিনি জেদের বশে পর পর সাত গেলাস মদ খাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে কার্যত হাইজ্যাক করে হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ঘর অবধি পৌঁছে দেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর হাত ছাড়তেও রাজি হননি। রানি চন্দও বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে মদ্যপানের এটিকেট শিখিয়েছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন মদ খেতেন, তার ওপর আর কথা চলতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ অবধিই যখন গেলাম, তখন উত্তমকুমারকেও ছুঁয়ে আসি। এই গল্পটা আমার পিসেমশাইয়ের কাছে শোনা। তাঁর জবানিতেই বলি: তখন ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে আমার নিয়মিত যাতায়াত। এক দিন বেশ রাত হয়েছে। দাদা হুইস্কি খাচ্ছিলেন। হঠাৎ বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তুই তো নাটক করিস। আমাকেও একটা পার্ট দিলে পারিস।’ আমি তো শুনে প্রায় চেয়ার থেকে পড়েই যাই। বললাম, দাদা সত্যি করবেন? উত্তম বললেন, ‘একটা রোল দিয়েই দেখ না।’ উত্তেজনায় রাতে ঘুম এল না। পর দিন সকালেই ছুটলাম মহম্মদ খানের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে। আমাদের নাটকের গুরু। বললাম, উত্তমকুমার বলেছেন আমাদের গ্রুপে নাটক করবেন। খান সাহেব গোড়ায় পাত্তাই দিলেন না। আমিও নাছোড়বান্দা। বার বার বলায় শেষমেশ খান সাহেব বললেন, ‘তা হলে ওই নতুন স্ক্রিপ্টটা নিয়ে যা। গিয়ে দেখা, যদি পছন্দ হয়।’
সেই রাতেই আবার ময়রা স্ট্রিটে ছুটলাম। আমার সঙ্গে বেণুদির বোনপো খোকন। দেখি, দাদা বসে আছেন। সটান হাতে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিলাম। বললাম, দাদা কোন রোলটা পছন্দ হল, কবে বলবেন? উত্তমকুমার খানিক ক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘রোল... মানে, তুই কি সিনেমা করছিস?’ আমি স্তম্ভিত। বললাম, দাদা, কাল যে বললেন আমাদের গ্রুপে নাটক করবেন! এ বার উত্তম অবাক। বললেন, ‘আমি বলেছি? কখন?’ কেন, কাল রাত্রেই তো বললেন। এ বার হাসলেন উত্তমকুমার। বললেন, ‘ওহ, তাই বল। ওরে, ওটা আমি বলিনি, হুইস্কি বলেছিল।’
গড়িয়ার দিকে একটা মাতালবাহিনী আছে। একটু বয়েসে বড়, সবাই পঞ্চাশের আশেপাশে। রিফিউজি পাড়ায় ডাংগুলি খেলে ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া বন্ধু সবাই। আড্ডায় লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বিশুদ্ধ বাঙাল।
এক দিন খবর এল, পাড়ারই এক জন প্রচুর মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে রোজ বউ পেটাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে গেল। ‘আরে, হারামজাদায় করে কী? ওই গুবিন্দ ছ্যামড়াটার এত সাহস হইসে! একডা ব্যবস্থা না করলেই নয়।’ ব্যস, সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। গোবিন্দকে একটু পিসফুলি বকে দিতে হবে।
সিদ্ধান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাহিনী রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। লোকটার বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক পাড়ল, গুবিন্দ, এক বার বাইরঅ তো। গোপাল বাড়ি থেকে বেরোতেই মার। চড়-থাপ্পড়, কিল। মিনিট পাঁচেক বেধড়ক পেটানোর পর গোপালকে সোজা করে বসানো হল। বাহিনীর নেতা সামনে এলেন। বললেন, ‘দ্যাখ, তর বউরে তুই মাইরা পাটপাতা বানাইবি নাকি সোহাগ করবি, হেইডা তর ব্যাপার। সে বিষয়ে আমাগো কোনও বক্তব্য নাই। কিন্তু, মদ খাইয়া তো বউ পিটান চলব না। তাতে মদের বদনাম হয়। লোকে কইতাসে, মদ খাইয়াই তুই এমন সব কাজ করস। হেইয়া তো চলতে পারে না। আমাগো দ্যাখ, ত্রিশ বৎসর মদ খাইতাসি, কহনও বউয়ের গায়ে হাত তুলসি? কোনও দিন না শুনি তুই এই আকাম করছস। মদের সম্মান রাখতে শেখ।’
তবে, ভালবাসা যে শুধু মদের প্রতি, তা নয়। সহমাতালের প্রতি মাতালের ভালবাসার গভীরতা দেখলে চোখে জল চলে আসবে। বহু কাল আগের কথা। এক কালীপুজোর রাত। বন্ধুর বাড়িতে পুজো। হোল নাইট নেমন্তন্ন। ছাদের ঘরে বসে প্রচুর ফুর্তির পর মনে হল, একটু গুমোট লাগছে। কাউকে কিছু না বলে ছাদে বেরিয়ে এলাম। দেখি, চেয়ার পাতা আছে। পর পর কয়েকটাকে জুড়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
একটু বাদে দুই বন্ধু ছাদে এল। আমার খোঁজে। একটু এ দিক ও দিক দেখে ওদের দৃঢ় বিশ্বাস হল, আমি নীচে পড়ে গিয়েছি। এক জন পকেট থাবড়ে দেশলাই বাক্স বার করল। একটা কাঠি জ্বেলে সেই আলোয় তিন তলার ছাদ থেকে নীচে খুঁজতে আরম্ভ করল, আমি পড়ে গিয়েছি কি না। |
|
|
|
|
|