|
|
|
|
অন্য বেঞ্চির নাগরিক |
প্রথম ল্যাপ থেকেই যে হোঁচট খাচ্ছে, তার আর কী রেস? সে তো ‘আনফিট’, তাই না?
কিন্তু তা হলে আইনস্টাইন, বিল গেটস, টম ক্রুজ? প্রতিভা প্রায়শ বর্ণচোরা। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
একটা ছোট ছেলে, কত হবে দশ, বা তা-ও নয় হয়তো, স্কুল করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এই স্কুলে এটাই ওর প্রথম দিন। ফলে চেনাশোনা নেই বিশেষ। টানা ছুটির চোটে স্কুলটাও কেমন ঝিম মেরে ছিল, এত দিনে যেন স্বর ফিরে পেল। মহাকাশ থেকে দেখলে বোঝা যেত, শয়ে শয়ে সূর্য কেমন ক্রিসক্রস করে যাচ্ছে করিডর। যে করিডরের এক ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সেই ছেলেটা। বয়স অনুযায়ী হাইট বাড়েনি। জামা টাইট, প্যান্ট ঢোলা। খাঁজখোঁজ থেকে উড়ে আসা উল্লাসের দমক যেন ওর বুকে ছ্যাঁত করে লাগছিল। বোঝাই যাচ্ছিল ওর পেট গুলোচ্ছে ভয়ানক, পারলে ছুট্টে চলে যায় মায়ের কোলের অন্ধকারে। এর পর তো ক্লাস আরম্ভ হবে, আর টিচার সবার সামনে ডেকে ওকে কিছু বলতে বলবেন, আর ও তো হোঁচট খাবে, তোতলাবে, মুখ নিচু করে থাকবে। অস্ফুটে বলবেও হয়তো নাম, কিন্তু কেউ শুনতে পাবে না। ঠিক সেই আগের স্কুলের মতোই। টিচার দয়া করে ওকে ছেড়ে দেবেন, আর ও সারি সারি ডেস্ক-এর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আড়চোখে অনুভব করবে হোল ক্লাসের ঠাট্টা। ওর হিসি পাবে জোরে। ক্লাস শেষে যাবেও টয়লেট, কিন্তু হবে না। ফিরে আসবে ক্লাসে, আর তার পরই অজান্তে কখন প্যান্ট চুঁইয়ে...
ক্লাসের পর ক্লাস ফুরিয়ে যাবে, আর ও কিছুই নাগাল পাবে না। অ্যাবসলিউট তথৈবচ। আসলে যে প্রথম ল্যাপ থেকেই মাইল খানেক পিছিয়ে, তার আর কী রেস? বরং বলা যায়, গ্রুপ ফটো’র এক্কেবারে বাঁ দিকের কোণ, বসানো। তা-ও আবার বাঁ হাতটাই কেটে গিয়েছে।
এমন তীব্র ‘আনলাকি’ বাচ্চা আমরা খুব দেখিনি কি আশপাশে? দেখেছি। তাদের মায়া করেছি বা মজা পেয়েছি বা মোজা খুলতে খুলতে মাকে গল্প করেছি, ম্যাক্সিমাম দু’এক দিন টিফিন খুলে শেয়ার করেছি। তার পর আমরা এক সময় রানিং-এ বাসে উঠে গিয়েছি আর ওরা একলা বাসস্টপে ভ্যাবাচ্যাকার মতো থমকে থেকেছে। ওদের কথা ওই অবধিই, আর নেই।
শেষ, আর নেই, ফিনিশ। এই কথাগুলোই মুখের ওপর শুনতে হয়েছিল আইনস্টাইনকে, চার্চিলকে, টমাস এডিসনকে, দা ভিঞ্চিকে, ওয়াল্ট ডিজনিকে, বিল গেটসকে, টম ক্রুজকে... লিস্ট আরও লম্বা করে যেতে পারব, আপনিই হাঁপিয়ে উঠবেন। এঁদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু ডিজএবিলিটি বা অক্ষমতা ছিল। আইনস্টাইন যেমন চার বছর অবধি কথাই বলতে পারতেন না, ন’বছর বয়সে প্রথম পড়তে শিখলেন, ফলে স্কুলে ওঁকে ‘স্লো-লার্নার’ ছাপ দেওয়া হল। শিক্ষকরা বললেন, ও তো ক্লাসে হাঁ করে বসে থাকে, শুধু কী যেন ভাবে, কারও সঙ্গে সহজে মিশতে পারে না, আবার খেলায় যে মন, তা-ও নয়। এক কথায় ‘আনফিট’। বিল গেটসও নাকি তাই। কেমন ক্যাবলার মতো হাঁটে, কী বলে, কিছু বোঝা যায় না, জমায়েতের মধ্যে থেকে দুম করে কাউকে কিছু না বলে উঠে যায় আপন মনে, ন্যূনতম ভদ্রতাও শেখেনি। ইডিয়ট একটা।
ক্লাসের ইডিয়ট ধরা হত টম ক্রুজকেও। এই লেখার শুরুতেই যে গল্পটা দেওয়া আছে, তার বেশ খানিকটাই টম-এর জীবন। হলিউড-এর চুড়ো ছোঁয়ার পর টম বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেই বাড়ি ফেরা বিকেলগুলোর কথা। ক্লাসের অন্য মস্তান গোছের ছেলেদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে, মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করত না। কান্না আসত, কিন্তু তারও আগে বমি আসত, নিজের ওপর। বাড়ি ফিরে রোজ এক কথা আর কীই বা বলবে। রাতের বিছানায়ও শান্তি নেই, বালিশ-ফাঁকে জমাট ভয়। একটু পরই তো সকাল, আর স্কুল, আবার ওই ষণ্ডামার্কা ছেলেগুলো ঘিরে ধরবে, টিফিন কেড়ে নেবে, মোক্ষম জায়গায় ভিজিয়ে দেবে আর সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাবে...
টমকে যা সামলাতে হয়েছিল, আইনস্টাইন, বিল গেটস বা ওয়াল্ট ডিজনিকে হুবহু সেইগুলোর সামনে পড়তে হয়নি হয়তো, কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে ওঁরা সব্বাই এক বেঞ্চির নাগরিক। এই অবস্থায় ওঁদের কী করার ছিল? হয় হজম করো সমস্ত অপমান, চুপ করে বুঝে নাও এমনটাই নিয়ম, না হয় পরের বার গলা চড়াও আর আঙুল তোলো, বলো ‘স্টপ, আজ থেকে’। প্রথমটা করা মানে তো এক রকম ফুরিয়ে যাওয়াই হল, অতএব ওঁরা তা করলেন না, বা বলা ভাল, পারলেনও না। আর পরেরটা করার কব্জির জোরও তো ওঁদের ছিল না। তবে এ বার?
আজকের দিন হলে, বাবা-মা সোজা মনোবিদের কাছে ছুটতেন। ওঁদের ভাগ্যে সে সব জোটেনি খুব একটা। আর সেটাই শাপে বর হয়ে দাঁড়াল। দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকেছে, তখন ঘুরে তো দাঁড়াতেই হবে। ওঁরা ঠিক তা-ই করলেন। আর তার পরই শুরু হল ভেতরের জুজুর সঙ্গে তির ছোড়াছুঁড়ি। প্রথম প্রথম লক্ষ্য ডাহা মিস হল, তার পর আবার ফেল, হতাশা, মাথা গরম, কান্না, আরও রাগ... করতে করতে কোনও এক সময়ে হঠাৎ তির ফাটিয়ে দিল জুজুর চোয়াল। এ কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে পড়ল দু’পক্ষই। কারণ এমন তো আগে কখনও ঘটেনি, ব্যাপার কী! তার পর আর একটা তির, আরও একটা তির। এই লড়াই-ই ওঁদের শেখাল আর এক মহাবিদ্যে। ডজ করার, বা কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার। প্রত্যেক চালেই তো আর কিস্তিমাত হবে না, ফলে মাঝে মাঝে দু’পা পিছিয়ে এসে আত্মরক্ষাও করতে জানা চাই। ব্যস, মুহূর্তেই বদলে যেতে লাগল ওঁদের সংসার। ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরল রং। রগে রগে বসন্ত। একটা ভরসা, একটা বিশ্বাস জন্মাল অন্তরে, যে বাইরের ঝঞ্ঝাকে আজ না হোক কাল ট্যাকেল করা যাবেই, আর আপাতত রাতে বেশ মোলায়েম একটা ঘুমও হবে।
যে কোনও বাচ্চা যখন এমন ধরনের অক্ষমতার সঙ্গে টক্কর দেয়, তখন কিন্তু সে কাতর ভাবে চায় বাবা-মা থাকুক পাশে, খুব কাছে। জাস্ট এক পা দূরে। কিন্তু আমাদের তুলকালাম মায়ার মন তো, ওইটুকু দূরত্বও সইতে পারি না। প্রাণ কেঁদে ওঠে, ভাবি আমি থাকতে আমার বুকের টুকরো কেন লড়বে এ লড়াই? ব্যস, নিশ্চিত হিতে বিপরীত। বাচ্চাটি স্পষ্ট বুঝে গেল, সে অসহায়। আর এ অসহায়তা ঢেকে দেওয়ার লোকও তো মজুত। অসহায়তা এর পর অভ্যেসে পরিণত হবে।
একটু আগেই যে বিখ্যাত মানুষদের নাম বললাম, তাঁদের মা-বাবা কখনওই এই সব অক্ষমতাকে ‘খুঁত’ হিসেবে দেখেননি। নিজের শিশু ক্লাসের অন্য কুড়ি জনের মতো নয় বলে লজ্জা পাননি, হীনম্মন্যতায় ভোগেননি, আলাদা খোপে পুরে রাখেননি। উল্টে বলেছেন, তুমি তোমার মতো, তোমাকে অন্য কারও দেখাদেখি তার মতো হতে হবে না। যতটুকু পারছ করো, আজ দুই পারলে তাই, কাল চেষ্টা করো তিন করার, না পারলে ক্ষতি নেই, কিন্তু চেষ্টায় যেন ফাঁক না থাকে, এইটুকুই। নিজেকে নিয়ে এক ফোঁটাও অস্বস্তিতে থেকো না, সহজ হও, আরাম করে পা ছড়িয়ে বসো। আর স্বপ্ন দেখো, স্বপ্ন, রাত্তিরে ঘুমিয়ে নয়, সকালে জেগে জেগে। কারণ এই স্বপ্নগুলোই তো ডেঞ্জারস হয়, বাস্তব হয়। |
|
|
|
|
|