দেওয়ালে ঝুলছে সদ্য কেনা ফায়ার এক্সটিংগুইশার। কিন্তু ভেতরে ঢোকার দরজা এতই নিচু যে মাথা ঝুঁকে কোনও রকমে পার হতে হয়। কোথাও আবার দরজা দিয়ে ঢোকে না ট্রলি-স্ট্রেচার। সরু সিঁড়িতে পাশাপাশি দু’জন যেতেও কষ্ট হয়। বিপদকালীন বিকল্প সিঁড়ি দূরের কথা। নিজস্ব জলাধার নেই। কোথাও আবার দমকল ঢোকার জায়গাও নেই। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সদর তমলুকের অধিকাংশ নার্সিংহোমের হাল এমনই। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই সেখানে। আমরি-কাণ্ডের পরে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেছিল প্রশাসন। খোঁচা খেয়ে দমকলের ছাড়পত্র পাওয়ার জন্যে আবেদন জানিয়েছিল নার্সিংহোমগুলি। কাজ হয়েছে ওই টুকুই। পরিকাঠামো রয়েছে সেই তিমিরে। নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধে কোনও রকম ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি উদাসীন প্রশাসন। অগত্যা শিকেয় সুরক্ষাবিধি।
তমলুক শহরের শঙ্করআড়া থেকে ধারিন্দা পর্যন্ত হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়কের আশপাশে রমরমিয়ে চলছে ২২টি নার্সিংহোম। জেলা হাসপাতালের কাছেই সেগুলি। তিন-চারটি ছাড়া প্রতিটিই গড়ে উঠেছে বসতবাড়িতে। কোথাও আবার লজ-হোটেলকে নার্সিংহোমে রূপান্তর করা হয়েছে। ঘিঞ্জি-জনবহুল এলাকার এই সব নার্সিংহোমে আগুন নেভানোর প্রাথমিক পরিকাঠামোটুকুও যে থাকবে নাতা বলাই বাহুল্য। |
বসতবাড়ি ব্যবহার করে কয়েক বছর আগে গড়ে ওঠা ধারিন্দার এমনই একটি নার্সিংহোমে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে শুধু ভিতরের দেওয়ালে ঝোলানো একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার। সাধারণ বসতবাড়ির দরজা আর অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে স্ট্রেচারে চাপিয়ে রোগী ওঠানো-নামানো যায় না। নার্সিংহোমের মালিক সজল কর বলেন, “অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা আগে বাধ্যতামূলক ছিল না। আমরি-কাণ্ডের পরে দমকল এই সব নিয়ে কড়া হওয়ায় আমরা নার্সিংহোম স্থানান্তরে উদ্যোগী হয়েছি। তবে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে আগে থেকেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করছি।”
শঙ্করআড়াতেও বেশ কিছু বসতবাড়িতে নার্সিংহোম গড়ে উঠেছে। একই রকমের অপ্রশস্ত সিঁড়ি। দ্বিতীয় সিঁড়ির অস্তিত্ব নেই। দমকলের ছাড়পত্র এখনও নেওয়া হয়নি স্বীকার করে স্থানীয় এক নার্সিংহোমের মালিক হরিপদ ভৌমিক বলেন, “ছাড়পত্রের জন্য দমকলে আবেদন জানিয়েছি সম্প্রতি। এখনও তা হাতে পাইনি।” তবে, আমরি-কাণ্ডের পরে শঙ্করআড়ারই নামী একটি নার্সিংহোমে বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। নার্সিংহোমের ম্যানেজার ব্রজগোপাল অধিকারী বলেন, “বিপদকালীন সময়ে রোগীদের বার করার জন্য দমকল দফতরের নির্দেশ মেনে বিকল্প সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আরও ভাল করার চেষ্টা চলছে।”
দমকলের ছাড়পত্র নেই কোনও নার্সিংহোমেরই। পূর্ব মেদিনীপুর নার্সিংহোম ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তমলুক শাখার সম্পাদক কানাইলাল দাস তা মেনে নিয়ে বলেন, “আমরি-কাণ্ডের পরে আমরা দমকল দফতরের বিধি মেনে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। ছাড়পত্রের জন্য দমকলের কাছে অধিকাংশ নার্সিংহোম আবেদনও করেছে। তবে, কেউই এখনও ছাড়পত্র পায়নি।” ছাড়পত্র পেতে দেরি হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তমলুক দমকল কেন্দ্রের আধিকারিক শ্রীকান্ত ধাড়া বলেন, “কোথাও আগুন লাগলে তা নেভানোর দায়িত্ব শুধু আমাদের। ছাড়পত্র হাওড়ার আঞ্চলিক অফিস থেকে আসে।”
আর এত অনিয়মের পরেও নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতর কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেন? জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুকুমার দাস বলেন, “আমরা নিয়মিত নার্সিংহোমগুলি পরিদর্শন করি। আমরি-কাণ্ডের পর সুরক্ষা-ব্যবস্থা নিয়ে জেলা প্রশাসনে বৈঠকও হয়েছে। নার্সিংহোমগুলিকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তবে, এই মুহূর্তে কড়াকড়ি করছি না। সময় দিয়েছি নার্সিংহোমগুলিকে। না হলে চিকিৎসা পরিষেবাই ব্যাহত হবে।”
দায় এড়ানোর পালায় চাপা পড়েছে সুরক্ষা-ব্যবস্থা। সদ্যই মেদিনীপুর শহরের একটি নার্সিংহোমে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে হয়তো আবারও গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে প্রশাসন। চলবে সাময়িক নজরদারি। কিন্তু পরিস্থিতি তাতে কতটুকু বদলাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে যথেষ্টই। |