শুধু ঘরে নয়। চার দেওয়ালের বেড়া ডিঙিয়ে শুধু জেলার মধ্যেও নয়। গৌরী, পড়শি রাজ্যেও ঘুরে বেড়ান কীর্তনের দল ‘সপ্তসখা’-কে নিয়ে। সেই পথ ধরেই গৌরীর ইচ্ছা আগামী দিনে তাঁর দল নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে চান। বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিতে চান বাংলার কীর্তনের সুর।
সেটা কবে?
প্রশ্ন শুনে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে গৌরী রায় পণ্ডিত বলেন, “সে তো মহাপ্রভু জানেন আর জানেন গুরু গোপাল দাস বাবাজি”। কেত্তন নয় ‘কীর্তন’। খোল নয় ‘শ্রীখোল’। কেত্তনিয়া নয় ‘কীর্তনীয়া’। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের কীর্তন সম্পর্কে এখনও রয়ে গেছে অবজ্ঞার ভাব। মহাপ্রভুর এমন যুগান্তকারী ধর্মভাবের আশ্রিত গান ও বাদ্যকে মিশিয়ে সকলের কাছেই পৌঁছতে চাই। গ্রাম-শহর ও নগরে।” নবদ্বীপের যোগনাথতলায় গৌরীকুঞ্জে বসে মধ্য তিরিশের এক মহিলা কীর্তনীয়া জড়তাহীন কণ্ঠে নিজের স্বপ্নের কথা জানালেন। পাশে বসে চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই মৃদঙ্গবাদক স্বামী গোবিন্দ পণ্ডিত ও স্কুলপড়ুয়া পুত্র। কীর্তন নিবেদিত এক মহিলার সংসার। আর অন্য সংসারটি? কীর্তনের সংসার? সে বেশ বড়। একাধিক বাদ্যযন্ত্র। মৃদঙ্গ দু’জোড়া। একটি অত্যাধুনিক কি-বোর্ড, সিন্থেসাইজার এবং দু’জোড়া করতাল। গায়ক-বাদক মিলিয়ে সাত জন। মূল গায়িকা গৌরী নিজে।
আধুনিক ‘কি-বোর্ড’ কী ভাবে কীর্তনের সুরের সহমর্মী হবে? কোনও সংশয়-জড়তা না রেখেই গৌরীর উত্তর, “কীর্তন গান বলেই তাতে নতুন যন্ত্রের প্রবেশাধিকার থাকবে না, এমন তো কেউ নিষেধ করেননি। বরং সুর ও শ্রবণের জন্যে, শ্রুতির মাধুর্যের জন্যে অন্য যে কোনও যন্ত্র আমার কাছে গ্রহণের এবং আদরের। যদি তা মূল কীর্তনের সুরের স্বরূপ প্রকাশে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।” বোঝা গেল এক আধুনিক মনের কীর্তনীয়ার ইচ্ছার কথা।
গৌরীর কীর্তন প্রেম শুরু ন’বছর বয়সে। কীর্তনের গুরু-ঘরটিও স্মরণ রাখার মতোই। গোপালদাস বাবাজির কাছে শুরু কীর্তনের মূল সুরের শিক্ষা। এর পরে শিখেছেন দ্বিজেন দে মহাশয়ের কাছে। কীর্তনের যে রাগসঙ্গীত আছে তার জন্যে রাগসঙ্গীতের চর্চা করেছেন নবদ্বীপের মঞ্জুলা ঘোষের কাছে। গৌরীর জীবন-পর্বে মিশে রয়েছে দুই বাংলার সংস্কৃতি। স্বামীর আদি বসত বাংলাদেশের রাজশাহীর প্রসাদপুরে। মা বাংলাদেশের বগুড়ার। বাবা এ দেশের মানুষ। “আমার প্রথম এবং শেষ পরিচয় কিন্তু কীর্তনই। যেখানে কীর্তনের আসর বসে, সেটাই আমার দেশ। সংসার আমার আসরের ওই সাত জন এবং শ্রোতারা।” হাসতে হাসতে বৈষ্ণবীয় রূপকের সাহায্যে গৌরী নিজের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রাখলেন।
ইতিমধ্যেই একাধিক সিডি, অডিও এবং ভিডিও প্রকাশিত। তবে প্রিয় কীর্তন ‘পূর্বরাগ’। ঘর-সংসার সামলে, কীর্তনের আসর চালানো, নতুন পালা প্রস্তুত বাংলার নারীর এই একক বিজয় তো কম নয়! |