|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
‘ভারতীয়ত্ব’ তত সাদাসিধে নয় |
শোভন তরফদার |
বেয়ারফুট অ্যাক্রস দ্য নেশন: মকবুল ফিদা হুসেন অ্যান্ড দ্য আইডিয়া অব ইন্ডিয়া,
সম্পা: সুমতি রামস্বামী। ইয়োডা প্রেস, ১৯৫০.০০ এম এফ হুসেন, আ পিক্টোরিয়াল ট্রিবিউট, প্রদীপ চন্দ্র। নিয়োগী বুকস, দাম অনুল্লেখিত |
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়। সহজ আঁকাও কি তাই? যেমন, ফলে মকবুল ফিদা হুসেনের রেখাঙ্কনে (১৯৭০-এ অঙ্কিত) একটি ‘সরস্বতী’ যখন নব্বইয়ের দশকে দেশজুড়ে বিষম গোলযোগের সৃষ্টি করল, তখনই, আচমকা, জনতার জ্ঞানচক্ষুটি উন্মীলিত হল যেন! তুমি কি কেবলই ছবি, এমন একটি বিস্মিত প্রশ্ন নিয়ে সবাই ছবির সম্মুখে দাঁড়ালেন, তরজা শুরু হল, আর কিমাশ্চর্যম, জনতা খেয়াল করল, ‘অসামান্য প্রাকরণিক দক্ষতা’ বা ‘ঘনীভূত সৌন্দর্য’-গোছের (অতি)প্রচলিত শব্দবন্ধে রচিত শিল্প-সমালোচনার বাইরে সেই বয়ানে ঢুকে পড়ছে আরও নানা শব্দ। অন্য সূত্রে চেনা, কিন্তু শিল্প-সূত্রে ঈষৎ অ-পরিচিতই যেন বা! জাতি, রাষ্ট্র, শরীর, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ব্যক্তি...!
এমন নয় যে আগে কখনও এই শব্দেরা উঁকিঝুকি দেয়নি শিল্প-বস্তুর পাঠে! কথাটা এই যে, ‘ছবি-দাস’ মকবুল যে ভাবে জনদরবারে প্যান্ডোরার বাক্সটি হাট করে খুলে দিয়ে গেলেন, তাতে বেশ স্পষ্ট করেই বোঝা গেল, তার ছিঁড়ে গেছে কবে! শিল্পবস্তু নিছকই দৃশ্য (এবং/অথবা শ্রাব্য) বস্তু নয় আর! শিল্পীর মনে তার বিন্যাসে, এবং জন-পরিসরে তার সংস্থানে আছে বিচিত্র কাটাকুটি! শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ইতিহাস, তাঁর ঐতিহ্য, তাঁর ব্যক্তিগত ধর্ম-সংশ্লিষ্ট অবস্থান, তাঁর যৌনতা, সেই যৌনতার সঙ্গে তাঁর সমাজ ও সমকাল এমন সব নানামুখী স্রোত ভিতর-বাহিরে, অন্দরে-সদরে ঢেউ তুলছে। এই বইয়ের সূচনাতেই আছে হুসেন-এর একটি উদ্ধৃতি, ‘লেট হিস্ট্রি কাট অ্যাক্রস মি উইদাউট মি’।
শিল্পী তা হলে কোথায়? ‘দেশ’-এর মাটিতে নেই, কিন্তু ‘স্ব-দেশ’ কি ছেড়েছেন তিনি? ছাড়া যায়? কেমন সেই ‘স্ব-দেশ’-এর গড়ন, যা নিছকই মানচিত্র নয়, জীবনানন্দের শব্দ ছুঁয়ে বললে, ‘মনোকণিকা’, সেই কণা দিয়ে গড়া কোনও মনোভূমি, যাকে আসল-নকল-এর চেনাশোনা প্রভেদের আদলে ধরা যাবে না। ফলে, ‘হুসেন কি ভারতীয়’, বা ‘হুসেন কতটা ভারতীয়’, সেই প্রশ্নগুলিকে নিছকই পাসপোর্ট দিয়ে বিচার করা মুশকিল! যেন ভারতের আর কাতারের মানচিত্র ক্রমাগত একে অন্যের গায়ে জড়িয়ে যায়, যেন সময়পটের গায়ে বিরাট, অস্থির তুলি দিয়ে তাঁদের ছবি আঁকেন, ছিঁড়েও ফেলেন নগ্নপদ, দীর্ঘকায় মকবুল ফিদা হুসেন!
এই সব খেয়াল না করলে হুসেন-এর শিল্প-কৃতির রস-ভোগে, কোথাও বাধা পড়তে পারে। ঠিক, রসের স্রোত সবার কাছে সমান বিভঙ্গে আসে না! তাই, এই সব বিষয়ে চূড়ান্ত অনবহিত থেকেও, কেউ দাবি করতেই পারেন, তাঁর গভীরতম রসোপলব্ধি হয়েছে! সেই দাবির বিরোধিতা করার অর্থ নেই, কিন্তু পাশাপাশি যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন, হুসেন-এর ‘সরস্বতী’ কেন আননহীনা, কেনই বা রেখাঙ্কনে তাঁর শরীর সনাতন ভারতীয় ঘরানার দেবী-রূপ-এর অঙ্কনে একটি ‘ছেদ’-এর মতো দেখা দেয়, কী ভাবে ‘মুসলমান’ মকবুল আর ‘ভারতীয়’ মকবুলের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে সংকট, তখন সেই সব প্রশ্নকে নিছক কূটকচাল বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।
সুমতি রামস্বামী সম্পাদিত আলোচ্য গ্রন্থটি থেকে উড়াল দেয় এমনই কিছু ভাবনা-জাগানো প্রশ্ন। ২০০৯-এ ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি আলোচনাসভার ফসল এই নিবন্ধ সংকলন। মনিকা জুনেজা-র সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সুলিখিত কথামুখটি বাদ দিলে মোট তেরোটি নিবন্ধ আছে এই বইতে। সুমতি রামস্বামী-র ভূমিকা-সহ আরও একটি প্রবন্ধ, সঙ্গে গীতা কপূর, অনন্যা জাহানারা কবির, বীণা দাস, কারিন জিজেভিৎজ, রাম রহমান, তপতী গুহঠাকুরতা, কাজরী জৈন, প্যাট্রিসিয়া উবেরয়, সুসান এস বিন, ব্রুস বি লরেন্স এবং একটি যৌথ রচনায় ডেভিড গিলমার্টিন এবং বারবারা ডি মেটকাফ। হুসেন যদিও ভাবনার কেন্দ্রে, কিন্তু বিষয়ের নির্বাচনে আছে মূল্যবান বৈচিত্র্য। ভারতশিল্পে আধুনিকতার বয়ান থেকে মাধুরী দীক্ষিত, ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে নির্বাসনের রাজনীতি, ভালবাসার (অ)সম্ভাব্যতা থেকে চিড়-খাওয়া জাতীয়তার সৌধ, এমন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলো ফেলা হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। একটি ছোট নিবন্ধে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা অসম্ভব। অসঙ্গতও বটে।
বরং সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, মকবুল ফিদা হুসেন নামক অধুনা-প্রয়াত এক ‘সেলিব্রিটি’ (যথাযথ বঙ্গীয় প্রতিশব্দাভাবে মূল ইংরেজিটিই থাক) কী ভাবে ভারতীয় শিল্প-ধারায় একটি সমস্যাপট তৈরি করেছিলেন, তাঁকে ‘গ্রহণ’ এবং ‘বর্জন’, অথবা এই দুয়ের একটি বিচিত্র মিশেল কী ভাবে আচমকা দেখিয়ে দিয়েছিল যে একঢালা, সাদাসিধে ‘ভারতীয়ত্ব’ বলে যা ভাবা হয়, তা আসলে একটি ঘোরতর জটিল বস্তু, ‘ভারতীয়’-র ধারণা কতটা ‘হিন্দু ভারতীয়’-এর ধারণার সঙ্গে জড়ানো এমন সব কথাই উঠে আসে এই প্রবন্ধগুলি থেকে। এই সব লেখার সঙ্গেই, দৃশ্যত পাশে পাশেই থাকে অজস্র ছবি। লেখাগুলিতে তাদের উল্লেখ থাকে ক্রমাগত, ফলে ভাবনা থেকে ভাবনায় এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পাঠকেরও সুবিধা হয় যথেষ্ট।
কথা আসে আরও। কী ভাবে ‘আত্ম’-র ভিতরেই দিব্যি ঢুকে থাকে ‘অপর’? তার সঙ্গে কি আদৌ কোনও সংলাপে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি আমরা? নাকি, ‘প্রলাপ’ বলে তার কথাকে উড়িয়ে দিলেই চলে? আশ্চর্য, ১৯৭৩-এ যে সাও পাওলো বিয়েনাল হুসেন-এর শিল্পকর্মের বিশ্বজোড়া স্বীকৃতির একটি মাইলফলক হিসাবে গণ্য, সেখানে তাঁর ছবির বিষয় ছিল ‘মহাভারত’! তিনি যে ‘মহাভারত’ আঁকছেন, বা ইন্দিরা গাঁধীকে ‘দুর্গা’-রূপে কল্পনা করছেন, তার মধ্যে আছে ঐতিহ্যের এক ধরনের আত্তীকরণ। কী ভাবে দেখা হচ্ছে সেই নির্বাচিত এবং নির্মিত ‘ঐতিহ্য’কে?
তা ছাড়া, দেখারও তো ছাঁচ বদলায়। হুসেনকে দেশের, (মানে, ভারতের) বাইরে থেকে যাঁরা দেখছেন, আর ভিতরে থেকে যাঁরা দেখছেন, দু’দলের দর্শনের চালচিত্র ভিন্ন হতেই পারে, হয়ও। আধুনিকতার দিকে কী ভাবে যাত্রা করছেন মকবুল ফিদা? ভারতশিল্প বললেই যে দুনিয়া জুড়েই এক ধরনের প্রাচীনতার খোপ (নাকি, ‘ট্রোপ’ বলব?) তৈরি হয়, তাকে কী ভাবে ব্যবহার করলেন তিনি? ‘সনাতন’ ভারতীয়ত্বের সঙ্গে কী ভাবে মিশল তাঁর নিজস্ব আধুনিকতা, প্রাকরণিক আধুনিকতা, তা ফিরে দেখা জরুরি। সেই গভীর অর্থে, এই বইটি শুধুই মকবুল ফিদা হুসেন নামক এক শিল্পীর উপরে কিছু নিবন্ধের সংকলন থাকে না আর। কারণ, মকবুল ফিদা হয়ে ওঠেন একটি দর্পণ, তাতে ছায়া ফেলে আধুনিক ভারতশিল্প সম্পর্কে নানাবিধ তাৎপর্যশীল ভাব ও ভাবনা।
মকবুল ফিদা সম্পর্কিত দ্বিতীয় গ্রন্থটি চরিত্রে ‘কফি টেবল’ ঘরানার। আয়তনে, এবং ওজনে সম্ভ্রম-জাগানো। মুদ্রণে অতি পরিপাটি। শ্রুতকীর্তি আলোকচিত্রী প্রদীপ চন্দ্র বিভিন্ন সময় হুসেনের অজস্র ছবি তুলেছেন, এবং সেগুলি নিপুণ ভাবে বিন্যস্ত করেছেন এই গ্রন্থে। জন-পরিসরে কী ভাবে বন্দিত মকবুল ফিদা, তারই একটি অসামান্য দৃশ্য-দলিল এই বই। পাশাপাশি, তাঁর কিছু নিভৃত মুহূর্তেরও ছবি ধরা আছে এখানে। সাদা-কালো এবং রঙিন ছবিতে বিভিন্ন মাত্রায় ধরা হয়েছে সমকালের এক কিংবদন্তিকে। হুসেন-উৎসাহীরা তো বটেই, সাধারণ শিল্পরসিকরাও বইটি সানন্দে সংগ্রহ করবেন। |
|
|
|
|
|