বিবাহবিচ্ছেদের পরেও বৈবাহিক সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সংশোধনী বিল অনুমোদন করল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। সেই সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে সম্পর্কে ‘পাকাপাকি চিড় ধরে যাওয়া’কে আইনি বৈধতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এত দিন পর্যন্ত গোয়া (সেখানে এখনও পর্তুগিজ দেওয়ানি আইন, ১৮৬৭ প্রচলিত) ছাড়া ভারতের আর কোথাও বিবাহবিচ্ছেদের পরে বৈবাহিক সম্পত্তির উপরে স্ত্রীর অধিকার স্বীকৃত ছিল না। বৈবাহিক সম্পত্তি মানে কী? বিবাহের পূর্বে উত্তরাধিকার সূত্রে বা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি এর আওতাভুক্ত নয়। কিন্তু বিবাহোত্তর জীবনে যে সব বিষয়সম্পত্তি তাঁরা কিনেছেন বা পেয়েছেন, তা বৈবাহিক সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। এ ছাড়া স্ত্রীধনের উপর নারীর পূর্ণাঙ্গ অধিকার আগে থেকেই স্বীকৃত রয়েছে।
এই বিবাহ আইন সংশোধনী (২০১০) বিলটি দু’বছর প্রাথমিক ভাবে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে রাজ্যসভায় পেশ হয়েছিল। তার পর সেটি সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যায়। ওই কমিটির সুপারিশগুলি অন্তর্ভুক্ত করে বিলটি আজ আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করা হয়। যেহেতু সংসদের অধিবেশন চলছে তাই, মন্ত্রিসভায় এই সংশোধনী পাশ হওয়া সত্ত্বেও তা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়নি। ফলে বিলের খুঁটিনাটি এখনও জানা যায়নি। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, চলতি বাজেট অধিবেশনেই সংশোধনী বিলটি সংসদে পেশ ও পাশ করানোর চেষ্টা করবে সরকার।
বিলটি পাশ হলে তা হিন্দু বিবাহ আইন এবং বিশেষ বিবাহ আইনের সংশোধনী হিসেবে কাজ করবে। এত দিন পর্যন্ত আইনের চোখে ‘বিচ্ছেদযোগ্য’ কারণ হিসাবে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের উপস্থিতি, নির্যাতন (শারীরিক ও মানসিক), মানসিক অসুস্থতা, একসঙ্গে না থাকা ইত্যাদির কথাই শুধু বলা ছিল। অথচ বাস্তবতার বিচারে বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উপরিউক্ত অভিযোগগুলি না থাকা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে মানসিক ব্যবধান অলঙ্ঘ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে সুপ্রিম কোর্ট বারবারই ‘সম্পর্কে পাকাপাকি চিড় ধরে যাওয়া’কে (ইরিট্রিভেবল ব্রেকডাউন অফ ম্যারেজ) বৈধ কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করছিল। মন্ত্রিসভার অনুমোদিত বিল সেই সুপারিশ মেনে নিয়েছে।
সেই সঙ্গে যদি কোনও দম্পতি পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে এই ‘পাকাপাকি চিড় ধরে যাওয়া’র কারণ দেখিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন, ৬-১৮ মাসের প্রতীক্ষাপর্ব (কুলিং অফ পিরিয়ড) থেকে তাঁদের অব্যাহতি দিতে পারবে আদালত। এত দিন পর্যন্ত পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে বিচ্ছেদের আবেদন করলেও ন্যূনতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১৮ মাসের মধ্যে আবেদন প্রত্যাহার করা হচ্ছে কি না, সেটা দেখা হত। ‘পাকাপাকি চিড় ধরে যাওয়া’র ঘোষণা করা হলে ওই প্রতীক্ষা-পর্ব মকুব করার অধিকার আদালতের থাকবে। মোটের উপর, বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়া এর ফলে সহজতর হবে বলেই আশা করা হচ্ছে। পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে যেখানে বিচ্ছেদ চাওয়া হচ্ছে না, সেখানে কী হবে? কোনও স্বামী যদি ‘পাকাপাকি চিড় ধরা’র কথা বলে বিচ্ছেদ চান, তার বিরোধিতা করার অধিকার স্ত্রীর থাকবে। কোনও স্ত্রী যদি ওই মর্মে আবেদন করেন, স্বামী তার বিরোধিতা করতে পারবেন না। এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিচ্ছেদ-পরবর্তী বন্দোবস্ত নিয়ে নিজস্ব মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে গর্ভজাত সন্তান এবং দত্তক সন্তানের সমান অধিকার স্বীকৃত হবে। বাবা না মা, কার কাছে থাকবে, ঠিক করার অধিকার দত্তক সন্তানের থাকবে। |
বস্তুত এ দেশে প্রতি বছর কতগুলি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশ, বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। আইন কমিশনের প্রাক্তন সদস্য তথা মহিলা অধিকার আন্দোলনের নেত্রী কীর্তি সিংহের বক্তব্য, কিন্তু এখনও বহু ক্ষেত্রে স্বামীগৃহে নির্যাতন সহ্য করেও স্ত্রী-রা বিবাহবিচ্ছেদে রাজি হন না। আর্থিক নিরাপত্তার অভাবই তার বড় কারণ। বিভিন্ন মহিলা সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে, বৈবাহিক সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে সংশোধিত বিলে।
কীর্তি সিংহের বক্তব্য, বর্তমান আইন অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদের পর স্ত্রী খোরপোষ পান ঠিকই। কিন্তু তা নির্ধারিত হয় পুরুষের আয়ের ভিত্তিতে। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা গিয়েছে পুরুষরা তাঁদের প্রকৃত আয় জানান না। সেই সংক্রান্ত প্রামাণ্য কাগজপত্রও স্ত্রীর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না। মহিলাদের মধ্যে আশি শতাংশকেই বিচ্ছেদের পরে তাঁদের বাপের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। নতুন বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে, আইন মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়নের কথা মাথায় রেখেই বৈবাহিক সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার কথা সংশোধনীতে বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের পরে স্ত্রী বা লিভ-ইন সঙ্গিনীর সামনে বিকল্প থাকবে। তাঁরা চাইলে মাসিক খোরপোষ নেওয়ার পরিবর্তে পাওনাগণ্ডার এককালীন নিষ্পত্তি করে ফেলতে পারবেন। সেই সঙ্গে বৈবাহিক সম্পত্তির একাংশের উপরেও তাঁদের দাবি থাকবে। সম্পত্তির আনুপাতিক ভাগ-বাঁটোয়ারা আদালতে নির্ধারিত হবে।
যদিও মহিলা সংগঠনগুলি এতেও খুশি নয়। কীর্তি আজ বলেন, “যে দাবিগুলি আমরা জানিয়েছিলাম, তার অর্ধেক দাবি মানা হয়েছে।” মহিলা সংগঠনগুলির দাবি, সমস্ত বিষয়ের নির্ধারণ ক্ষমতার যদি আদালতের হাতে থাকে, তাতে মেয়েদের অসুবিধা কমবে না। কারণ, বিচারবিভাগও অনেক ক্ষেত্রেই পিতৃতন্ত্রের উর্ধ্বে নয়। |