এক টাকা আয় করতে এখন কলকাতা মেট্রোর খরচ হয় আড়াই টাকা! ভারতীয় রেলের হাতে থাকা দেশের একমাত্র মেট্রোর এটাই বাস্তব ছবি। যা দেখে পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো করিডরটি রাজ্য সরকারের হাত থেকে রেল মন্ত্রকের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কার্যত বেঁকে বসেছে জাপান। ফলে রাজ্য সরকার ও রেল মন্ত্রকের মধ্যে হস্তান্তর প্রক্রিয়াটিও এখন বিশ বাঁও জলে।
কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক সূত্রের খবর, এই হাত বদলে আপত্তি রয়েছে প্রধান ঋণ প্রদানকারী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-র। তাদের আশঙ্কা, প্রকল্পটি রেল মন্ত্রকের হাতে চলে গেলে তখন যে ‘রেভিনিউ মডেল’ নেওয়া হবে, তাতে সম্ভবত লাভের মুখ দেখা যাবে না। উল্টে কলকাতা মেট্রোর মতো এটিও ক্ষতিতে চলবে।
গোটা দেশের মধ্যে ভারতীয় রেলের হাতে রয়েছে কেবল কলকাতা মেট্রোটিই। ইউপিএ-২ সরকারের রেলমন্ত্রী থাকার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই মেট্রোর দায়িত্ব পুরোপুরি রেলের হাতে নেন। তার আগে রেল ও রাজ্যের যৌথ দায়িত্বে চলত এই মেট্রো। সেখানেও অবশ্য ভাড়া বাড়বে কি না, তা ঠিক করার দায়িত্ব মূলত ছিল রেলের হাতে। গত সাতাশ বছর ধরে এই মেট্রো লাভের মুখ দেখেনি। এবং ২০০২ সালের পর থেকে বাড়েনি মেট্রোর ভাড়াও। মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, শুধু কলকাতা মেট্রোই নয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মেট্রো লোকসানে চলে। এ বছর মেট্রো রেলে লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি আয় হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ‘অপারেশনাল’ খরচ এত বেশি যে, মেট্রোর ১০০ টাকা আয় করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ২৪৮ টাকা। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক বলছে, এই পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই পূর্ব-পশ্চিম বা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো পুরোপুরি রেলের হাতে তুলে দিতে আপত্তি রয়েছে জাইকার।
কলকাতা মেট্রোর যাত্রিভাড়ার কাঠামো এখন কেমন? ন্যূনতম ৪ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১২ টাকা। সেখানে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর দায়িত্বে থাকা কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন বা কেএমআরসি-র প্রস্তাবিত যাত্রিভাড়া ন্যূনতম ৮ টাকা, সর্বোচ্চ ১৬ টাকা। দিল্লি মেট্রোর ভাড়া-কাঠামোও প্রায় এক। শুধু তাই নয়, কেএমআরসি-র প্রস্তাবিত ভাড়া-কাঠামোয় দু’বছরে ১২ শতাংশ হারে যাত্রিভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশও করা রয়েছে। এর বড় কারণ, মেট্রোয় যাত্রিভাড়ার উপরেই নির্ভর করে যাবতীয় খরচ। অথচ বহরে বাড়লেও এবং বাতানুকূল রেক চালু হলেও গত প্রায় দশ বছরে এক পয়সা বাড়েনি কলকাতা মেট্রোর ভাড়া। এই পরিস্থিতিতে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো পুরোপুরি রেলের হাতে গেলেও যাত্রিভাড়া থেকে আয় নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা অর্থ ঘরে ফেরত আসবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর আশঙ্কায় রয়েছে জাইকা। পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণে দেরি, কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বিবিধ কারণে প্রকল্পটি ২০১৩ সালের পরিবর্তে ২০১৬ সালে শেষ হবে বলে মনে করছেন কেএমআরসি কর্তারা। বাড়ছে প্রকল্পের খরচও। যা মোটেই ভাল ভাবে নিচ্ছে না জাইকা।
প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক-রাজ্য সরকার সমান অংশীদারির ৪৮৭৪ কোটি টাকার ওই প্রকল্পটিতে ২২৫৩ কোটি টাকার ঋণ দিতে রাজি হয়েছিল জাইকা। যে টাকা আগামী ৩৫ বছরে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জাইকাকে। ঋণের ওই অর্থ শোধ দিতে মেট্রোর মূল ভরসা, যাত্রিভাড়া থেকে আয়। সেই আয় থেকেই ঋণ শোধের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মী সংক্রান্ত খরচও ওঠার কথা। দিল্লি মেট্রো এই মডেলটি মেনেই চলে। কেএমআরসি-ও দিল্লি মেট্রোর ধাঁচে নিজেদের অধীনে একটি ট্যারিফ রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব করেছে। যা হলে রাজ্য বা রেল নয়, যাত্রিভাড়া বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব থাকবে সেই কর্তৃপক্ষের উপরে। দিল্লি মেট্রো সূত্রের খবর, এই পদ্ধতিতে চলে তারা ‘ব্রেক ইভন’-এর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সংস্থাটি লাভের মুখ দেখবে।
নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “এখন পূর্ব-পশ্চিম মেট্রোও যদি রেলের হাতে যায়, তা হলে জনমুখী কারণে তার ভাড়া কম রাখারও সম্ভাবনা প্রবল। তখন টাকা শোধ কী ভাবে হবে, সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।” গত দু’বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়ে সব পক্ষের আলোচনা চলছে। তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে একাধিকবার ওই প্রকল্প রেলের হাতে চলে গিয়েছে বলে দাবি করা হলেও আজ কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন সচিব সুধীর কৃষ্ণ জানান, “বিষয়টি নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।” প্রকল্পটি থেকে যদি আশানরূপ আয় না হয়, সে ক্ষেত্রে শর্ত অনুযায়ী জাইকাকে ঋণ শোধ করার দায়িত্ব থাকবে রাজ্য সরকারের কাঁধে। কিন্তু মালিকানা বদল হলে ঋণ মেটানোর দায়িত্ব কে নেবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক ওই চুক্তিতে প্রত্যেক অংশীদারের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। দায়িত্ব বদল হলে সেই চুক্তিরও পরিবর্তন হবে। তাতেও আপত্তি রয়েছে জাইকার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ইস্ট-ওয়েস্ট বা পূর্ব-পশ্চিম মেট্রোর দায়িত্ব নিজের হাতে নেওয়ার জন্য তৎপর হয়েছিল রেল। সে সময়ে রেলমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, কলকাতার সব ক’টি মেট্রো প্রকল্প রেল মন্ত্রকের হাতে রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম করিডর তৈরিতেও রেলের সাহায্য প্রয়োজন। তাই ওই প্রকল্পটি রেলের হাতে তুলে দেওয়াই উচিত। মমতার ওই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক চমক থাকলেও প্রায় দু’বছর কেটে যাওয়ার পরেও সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি।
তবে নির্মাণের দিক থেকে হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় যে জমি অধিগ্রহণের সমস্যা ছিল সেই জট কেটে গিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে কেএমআরসি-র পক্ষ থেকে। শিয়ালদহ স্টেশনের তলায় নির্মাণের কাজের ক্ষেত্রে এখনও আংশিক সমস্যা রয়ে গিয়েছে। কেএমআরসি-র অধিকর্তা সুব্রত গুপ্ত বলেন, “শিয়ালদহে একটি হাসপাতালের তলায় নির্মাণ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। সেটি খুব দ্রুত মিটে যাবে।” ইতিমধ্যেই সুভাষ সরোবরের প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গের কাজ শুরু করে দিয়েছে। হাওড়া প্রান্তের মাটির তলার কাজ সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে দেওয়া যাবে বলে আশা করছেন কর্তারা। জট কেটেছে সেন্ট্রাল স্টেশন নির্মাণের জমি অধিগ্রহণ নিয়েও। সেখানকার ব্যবসায়ীদের লু সুন ও বৌবাজার সরণীতে অস্থায়ী ভাবে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও কাজ শেষ হলে ওই ব্যবসায়ীরা ফের নিজেদের পুরনো জায়গায় বসতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সুব্রতবাবু। |