রাস্তা দেখিয়েছে উত্তরপ্রদেশের পানিপথ, পাণ্ডুয়ার পানপাড়া। সেই রাস্তার খোঁজেই হন্যে হয়ে ঘুরছেন ধনেখালির শ্যামলেন্দু পাল।
বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলে আরও ভাল ভাবে চাষ করা যাবে এটাই আশা বছর চৌত্রিশের ওই সব্জিচাষির। কিন্তু সরকার যে সে ব্যবস্থা করবে না, তা বুঝতে পেরে শ্যামলেন্দু নিজের উদ্যোগেই কখনও দৌড়চ্ছেন দমদম, কখনও কলকাতা, কখনও বা পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্ রাজ্যে। যদি বহুজাতিক সংস্থাকে বুঝিয়ে ধনেখালির শেওড়া গ্রামে আনা যায়। যে গ্রামে তিনি আরও চার বন্ধুর সঙ্গে টোম্যাটো, ভুট্টা এবং ক্যাপসিকাম চাষ করে ‘বিকল্প চাষ’-এ লাভের মুখ দেখেছেন। যে চাষ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন আশপাশের কয়েকটি গ্রামের চাষিরাও। যে চাষ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাবার (প্রসেসড ফুড) তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে কৃষি নিয়ে কিছু ‘কোর্স’ করার পরে বছর পাঁচেক ধরে শ্যামলেন্দু নিজের জমিতে টম্যাটো, ভুট্টা এবং ক্যাপসিকামের মতো বিকল্প-চাষ করছেন। শেওড়া গ্রামে গেলেই দেখা যাবে, শ্যামলেন্দুর জমিতে প্রায় ৬ ফুট লম্বা টম্যাটো গাছের চাষ। ভুট্টা গাছের ‘প্রাচীর’-এর মধ্যে তিনি ক্যাপসিকাম চাষ করেন। শ্যামলেন্দুর কথায়, “ক্যাপসিকামে যে পোকা লাগার সম্ভাবনা থাকে, সেই পোকা আগে লাগে ভুট্টা গাছে। কিন্তু ওই পোকা ভুট্টা গাছের পক্ষে সহায়ক। এতে ভুট্টা গাছও বাঁচবে, ক্যাপসিকামেও পোকা লাগবে না। কীটনাশক ছাড়াই ক্যাপসিকাম বেড়ে উঠবে।” |
জেলা উদ্যানপালন দফতরের কাছ থেকে পাওয়া এই পরামর্শ মতো চাষ করে গ্রামের অনেককেই উদ্বুদ্ধ করেছেন শ্যামলেন্দু। তবু তাঁর আফসোস, “বহুজাতিক সংস্থাকে পাশে পেলে আরও ভাল হত। চাষবাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারতাম। ঝুঁকি নিতে পারতাম। তেজি বাজার পেলে আরও ভাল ভাবে চাষ করতে পারতাম। প্রথাগত চাষে সেই সুবিধা নেই।”
ঠিক যে সুবিধাটা ভোগ করছেন পানিপথের বাঁধাকপি চাষিরা বা পাণ্ডুয়ার পানপাড়ার তারক নায়েক, মহাদেব প্রামাণিক, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো আলুচাষিরা। কারণ, তাঁদের ফসল কিনে নিচ্ছে বহুজাতিক সংস্থা। তারক-মহাদেবদের মতে, আগে থেকে চুক্তি হয়ে থাকার ফলে নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে দাম। মিলছে চাষ নিয়ে পরামর্শ। বাজারের ওঠাপড়ার আঘাতও কার্যত নেই। কোনও বছর চাষের খরচ বাড়লে লাভের অঙ্ক কমে ঠিকই, কিন্তু লোকসান হয় না। তা ছাড়া, ঋ
ণের বোঝাও সে ভাবে মাথায় চাপে না।
কিন্তু সেই সব বহুজাতিক সংস্থার পা কি শেওড়া গ্রামে পড়বে?
এটাই এখন দুশ্চিন্তা শ্যামলেন্দুর। কৃষির আধুনিক রীতিনীতি জানতে ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছেন মহারাষ্ট্র ও গুজরাত। তাঁর উপলব্ধি, “এখন দলবদ্ধ ভাবে চাষ করার সময় এসেছে। যেটা বহুজাতিক সংস্থা এগিয়ে এলে সহজ হয়। আমরাও সমবায় গড়ার কথা ভাবছি।” পানপাড়ায় যেমন ‘পানপাড়া সেচ অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ গড়ে ২৯ একর জমিতে প্রায় ২০০ জন চাষি বহুজাতিক সংস্থা ‘পেপসিকো-ইন্ডিয়া’র জন্য আলু চাষ করছেন।
ইতিমধ্যে চার খেতমজুরকে স্থায়ী ভাবে বেতন দিয়ে সারা বছরের জন্য নিয়োগ করেছেন শ্যামলেন্দু। তাঁর দেখানো পথেই হাঁটছেন আশপাশের সমসপুর-২, কামালপুর-সহ কয়েকটি গ্রামের চাষিরা। কামালপুরের চাষি উজ্জ্বল দে বলেন, “শ্যামলেন্দু চাষের উন্নতি নিয়ে সব সময় ভাবে। ওঁকে দেখেই আমরাও বিকল্প চাষে মন দিয়েছি।”
ধনেখালির সব্জিচাষিদের এই নতুন পথে হাঁটার কথা জানে জেলার উদ্যানপালন দফতর। দফতরের আধিকারিক দীপক ঘোষ বলেন, “ধনেখালিতে চাষিরা বিকল্প-চাষের ক্ষেত্রে অন্য ভাবে ভাবতে শুরু করেছেন। আমরা সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেও ওদের যথাসাধ্য সাহায্যের চেষ্টা করছি, যাতে ওঁরা লাভের মুখ দেখেন।”
কিন্তু এই বিকল্প চাষে কি উদ্বুদ্ধ হবে বহুজাতিক সংস্থা?
সেই উত্তরই মেলানোর চেষ্টা করছেন শ্যামলেন্দু। |