এক-একটা দিন যেন বুকের উপরে পাথরের মতো চেপে বসে। মা-মরা ছেলেটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেন ভাস্কর। আলগোছে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নেন ভিজে যাওয়া দু’গাল। অঞ্জনাকে ভোলার জন্য দু’বছর বড় কম সময়। আজও বন্ধ চোখের সামনে ভেসে ওঠে, পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি শরীর। আজও কোনও কারণে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে চারপাশে সব কিছু স্বাভাবিক দেখে বুকের ভিতরটা যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠে। মনে হয়, অঞ্জনার মৃত্যু তা হলে ভুলে গিয়েছে এই শহর!
এই অভিমানটুকু বুকে নিয়ে আজ ২৩ মার্চ, শুক্রবার আবার স্টিফেন কোর্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন ভাস্কর চক্রবর্তী। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই তাঁর। অভিমান রয়েছে বিস্তর। যাঁদের অবহেলায় এই ঘটনা, দু’বছর পরেও তাঁরা এখনও কেন ‘মুক্ত’, তা নিয়ে অভিমান রয়েছে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার উপরে।
আর সেই অভিমান থেকেই ভাস্করবাবুর সিদ্ধান্ত, অঞ্জনার মৃত্যুর ক্ষতিপুরণ হিসেবে পাওয়া দু’লক্ষ টাকা রাজ্য সরকারকে ফেরত দিয়ে দেবেন তিনি। ভাস্করবাবুর কথায়, “আমার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। দু’লক্ষ টাকা আমার কাছে অনেকটা। কিন্তু যদি অপরাধীরাই শাস্তি না পায়, তা হলে ওই টাকা আমার চাই না। বড় হয়ে রঙ্গন তো প্রশ্ন করতে পারে, মায়ের ক্ষতিপুরণ হিসেবে দু’লক্ষ টাকা নিয়ে তুমি কেন চুপ করে রইলে? কেন প্রতিবাদ করলে না?” |
আট বছরের রঙ্গনকে নিয়ে প্রতি দিনের যুদ্ধে সামিল শুধু সেই অভিমান। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা এবং মাতৃহীন ছোট্ট ছেলে। রেলের চাকরি করে শুধু নিজের বাড়িই নয়, শ্বশুরবাড়ির দায়িত্বও সামলাতে হয় ভাস্করবাবুকে। সেখানেও অঞ্জনা ছিলেন ভরসা। বিভিন্ন আত্মীয়-পরিজনের আলোচনা থেকে ছোট্ট রঙ্গন জেনেছে, পিছন থেকে আগুন যখন গিলতে আসছে, তখন অন্যদের সঙ্গে অঞ্জনাও উঠে গিয়েছিলেন ছাদের দিকে। কিন্তু, ছাদের কোল্যাপসিব্ল গেটে ছিল তালা। সেই তালা ভাঙা যায়নি। দু’দিন পরে ছাদের সেই সিঁড়ি থেকে পাওয়া গিয়েছিল অগ্নিদগ্ধ দেহগুলি। রঙ্গনের মনে সে কথাটিই বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। বাবাকে হাতের কাছে পেয়ে নিষ্পাপ মন থেকে প্রশ্ন আসে, “সেই সময়ে সিকিউরিটি গার্ড যদি সিঁড়িতে তালা না লাগাত, তা হলে কি মা বেঁচে যেত?” উত্তর নেই ভাস্করবাবুর কাছে। ছলছলে চোখে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেন ছেলেকে।
তরতাজা যুবক সৌরভ বারিকের মৃত্যুর পরে দু’বছর পার হয়ে গেলেও এখনও কেন অভিযুক্তেরা সাজা পেলেন না, তা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে তাঁর বাবা শৈলেনবাবুর। ফোনে বলেন, “যে অন্যায় ভাবে, অসহায় অবস্থায় এত জনের মৃত্যু হল, সেই ঘটনায় দোষীদের সাজা দিতে এত কেন টালবাহানা?”
পুলিশ জানিয়েছে, ২০১০ সালের ২৩ মার্চ সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। স্টিফেন কোর্টের তিন মালিক সঞ্জয় বাগারিয়া, প্রদীপ মোর এবং সুশীল সুরেখা ছাড়াও গ্রেফতার করা হয় এক লিফ্টম্যান এবং দুই কেয়ারটেকারকে। পরে তাঁরা সকলেই জামিন পেয়ে যান। পুলিশ জানিয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যেই ওই ছ’জনের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ এনে আদালতে চার্জশিটও জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়নি। |