হত্যাকারী কে?
পাঁচকড়ি দে।
অজিত আর ব্যোমকেশের সংলাপে পূর্বসূরির নামোল্লেখ করে গিয়েছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় পনেরো বছর পর তিনি নতুন করে ব্যোমকেশ সিরিজে ফিরেছেন তখন। ১৯৩৬ সালে ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’ বেরনোর পর আবার ১৯৫১-য় পৌঁছে পাঠকের দাবিতে লেখা হল ‘চিত্রচোর’। যে কাহিনিতে তুলনামূলক ভাবে বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে থাকবে, সত্যবতী।
শরদিন্দুর পূর্বজ গোয়েন্দা-কাহিনি লেখক, পাঁচকড়ি দে-র গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়ও বিবাহিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল, রেবতী।
২০১২-য় ‘আবার ব্যোমকেশ’কে রুপোলি পর্দায় আনছে ১৯৫১-য় লেখা ‘চিত্রচোর’ই। পরিচালক অঞ্জন দত্ত সোজাসুজি বললেন, এই গল্পটা বাছার প্রধান কারণই হল ব্যোমকেশ-সত্যবতীর দাম্পত্যের অংশটাকে তুলে ধরার সুযোগ। সত্যবতীকে একটা পূর্ণাঙ্গ চরিত্র হিসেবে হাজির করার সুযোগ।
পশ্চিমে স্বর্ণযুগের গোয়েন্দাদের মধ্যে ডরোথি সেয়ার্স-এর লর্ড পিটার উইমসি এবং নগাইও মার্শ-এর গোয়েন্দা রডরিক অ্যালেন বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দা শিরোমণি শার্লক হোমস বিয়ে করেননি, এরকুল পোয়ারো বিয়ে করেননি। এ বঙ্গে রবার্ট ব্লেক, জয়ন্ত-মানিক, কিরীটি কেউই বিয়ে করেনি। ব্যোমবেশ পরবর্তী সময়ে ফেলুদা থেকে কাকাবাবু, সকলেই অকৃতদার। শুধু নিখাদ গোয়েন্দা গল্পই বা কেন! অ্যাডভেঞ্চারের নায়করা টেনি বা ঘনা, প্রত্যেকেই তাই। চাঁদের পাহাড় বা হীরামানিক জ্বলে-র জগতটিও নারীবর্জিত। |
কেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক তথা সাহিত্য সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, এর কারণ দু’টো। প্রথমত বাংলা গোয়েন্দা গল্পের চরিত্ররা অধিকাংশই পুলিশ-প্রশাসনের যন্ত্র নন। তাঁরা ‘সত্যে’র সাধক। এই ‘সত্য’কে খুঁজতে হয় সব কিছুর বাইরে থেকে। গার্হস্থ্যের বন্ধন তাতে ব্যাঘাত ঘটায়। দ্বিতীয়ত সঞ্জয়ের মতে, সদর আর অন্দরের ভেদটা বাংলা সাহিত্যে অনেক দিন মেনে চলা হয়েছে। “ধরে নেওয়া হয়েছে, নারী থাকুক চাঁদ-তারা-ফুলের মধ্যে। অপরাধ-খুনখারাপির জগতে নারীকে সহধর্মিণী করাটা ঠিক ভাল দেখায় না!”
তা বলে কি বিবাহিত গোয়েন্দা একেবারেই নেই? গোয়েন্দাকাহিনিপিপাসু বলে পরিচিত ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র বললেন, “দেবেন্দ্রবিজয় আছেন। সুকুমার সেনের কালিদাস সিরিজে কালিদাসের স্ত্রী ওঁর প্রায় সহকারী বলা চলে। পরাশর প্রেমে পড়েছেন, তবে বিয়ে হয়নি। মনোজ সেনের মহিলা গোয়েন্দা দময়ন্তীও বিবাহিত।” তবে গৌতমবাবু একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, উদাহরণ থাকলেও সেটা সংখ্যায় কম। গোয়েন্দারা গড়পড়তা হিসেবে অবিবাহিতই।
এই মাপকাঠিতে সত্যবতী কতটা আলাদা? নবনীতা দেবসেন তেমন একটা উচ্ছ্বসিত হতে পারলেন না। তাঁর কথায়, “রহস্য উন্মোচনে সত্যবতীর ভূমিকা কোথায়? ব্যোমকেশ গোয়েন্দা না হয়ে গানবাজনা করলে সত্যবতী যা করতেন, এখানেও তাই-ই করেছেন!” প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের ছাত্র, গৌতমবাবুর মত কিন্তু ভিন্ন। তাঁর মতে, শরদিন্দু দাম্পত্যের নিজস্ব পরিসরকে গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে এক ভিন্ন রসের সঞ্চার করেছিলেন। ‘দুর্গরহস্য’ বা ‘রক্তের দাগে’র মতো গল্প অন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল ওই দাম্পত্যরসের হাত ধরেই। “সত্যবতী আসাতে
গল্পে বাড়তি মোচড় এসেছিল, যা শরদিন্দু ছাড়া আর কেউই সে ভাবে আনতে পারেননি।”
ব্যোমকেশ সিরিজে সত্যবতীর আবির্ভাব ঘটে ‘অর্থমনর্থম’ গল্পে। প্রকাশকাল, ১৯৩৩। তার পর একে একে ‘চোরাবালি’, ‘অগ্নিবাণ’, ‘উপসংহার’, ‘রক্তমুখী নীলা’, ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’ পেরিয়ে ‘চিত্রচোর’। মাঝের গল্পগুলোয় সত্যবতীর তেমন একটা উপস্থিতি দেখা যায় না। ‘অগ্নিবাণ’ গল্পে অজিতকে বলতে শোনা যায়, ঘটনাটি কয়েক বছরের পুরনো। ‘তখনও ব্যোমকেশের বিবাহ হয় নাই।’
অর্থাৎ শরদিন্দু সময়কালকে মাঝেমধ্যেই এগিয়ে-পিছিয়ে দিয়েছেন, নাক বরাবর হাঁটেননি। অর্থাৎ ‘অর্থমনর্থম’ থেকে ‘চিত্রচোরে’র ব্যবধান ১৮ বছরের হলেও, ব্যোমকেশ-সত্যবতীর দাম্পত্য তখনও অত পুরনো হয়নি। ‘চিত্রচোরে’ই ব্যোমকেশ-সত্যবতীর দাম্পত্য রসায়ন, খুনসুটি-ঝগড়াঝাঁটি সামনে এল। আর সেই সূত্রগুলো কাজে লাগিয়েই এ বার পর্দায় জন্ম নিচ্ছে এক নতুন সত্যবতী। বিয়ে-প্রেম-পরকীয়া ইত্যাদি নিয়ে ব্যোমকেশের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামবে সে। প্রয়োজনে বলে উঠবে, “চারটে চোর-ডাকাত ধরে জগৎ উদ্ধার করে দাওনি!” শুধু তাই নয়, ব্যোমকেশ নিজেও এ ছবিতে মানতে বাধ্য হবে, সত্যবতীর সহজাত বোধ বা ইন্সটিংক্ট অত্যন্ত শক্তিশালী।
শরদিন্দুর লেখায় এই ইঙ্গিতগুলো কিন্তু সবই ছিল, বললেন অঞ্জন। “আমি সেগুলোকে আধার করেই নিজের মতো করে চরিত্রটাকে ভেবেছি, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি।” সত্যবতীর চরিত্রাভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তীর ভাবনাতেও, “সত্যবতী এমন এক জন মেয়ে, যার নিজস্ব মতামত আছে। এই ছবিতে সে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা।”
অতএব? দর্শকের চিত্তাকর্ষণে ‘চিত্রচোরে’র অন্যতম বাজি কিন্তু গোয়েন্দার সংসারধর্মের কাহিনি! যেখানে ব্যোমকেশের বৌ শুধু নয়, সত্যবতী নিজগুণেই এক স্বতন্ত্র চরিত্র। |