প্রবন্ধ ২...
ওসামার সন্ততিরা
এক ঐতিহাসিক সুযোগ
সামা বিন লাদেন নাকি চেয়েছিলেন, তাঁর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনিরা ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে ভাল করে লেখাপড়া শিখুক এবং সেখানে শান্তিতে বসবাস করুক। তারা যাতে জেহাদের পথে না আসে, সে ব্যাপারে তিনি নাকি ভয়ানক জেদাজেদি করতেন। ভূতের মুখে রামনাম-এর মতো অবিশ্বাস্য মনে হয়? চমকপ্রদ তো বটেই। কিন্তু যিনি বিন লাদেনের এই খোয়াবের কথা জানাচ্ছেন, তাঁকে অবিশ্বাসই বা করি কী ভাবে? জাকারিয়া আল-সাদা যে ওসামার নিজের শ্যালক, তাঁর পঞ্চম স্ত্রী আমল-এর নিজের ভাই। এই আমল-এর গর্ভেই জাত ওসামার তিন ছেলেমেয়ে ইব্রাহিম, হুসেন ও জয়নাব মায়ের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের বাবার চার পাশে, যখন পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদের সেই বাড়িতে মার্কিন নেভি-সিলদের গুলিতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ওসামা ছটফট করছেন। স্বামী বা বাবাকে তারা বাঁচাতে পারেনি। নিজেরাও কি বেঁচেছে? ওসামার ওই নিকটাত্মীয়রা এখনও কার্যত বন্দি। একটা জানালাহীন ছোট্ট অন্ধকূপে মার্কিন ও পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের ঘন-ঘন জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদের ফাঁকে ওদের দিন কাটছে। ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে সুখ-শান্তিতে সেখানে বাস করার বাবার ইচ্ছা বোধহয় ওদের জীবনে পূরণ হওয়ার নয়।
বিন লাদেন নিঃসন্দেহে এক জন কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী। আমেরিকার বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ নারীশিশুনির্বিশেষে হাজার-হাজার নিরীহ, নিরস্ত্র, অসামরিক নাগরিকের প্রাণনাশের প্রত্যক্ষ প্ররোচনা থেকেছে। তবে আরও এক বার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, তাঁর অপরাধ যত গুরুতরই হোক, ন্যায়বিচার দাবি করে একটা পূর্ণাঙ্গ বিচার তাঁর পাওয়া উচিত ছিল, যেখানে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও অধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন। তাঁকে গ্রেফতার করে মার্কিন আদালতে বিচার করা যেত, যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন নাগরিকদের হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ছিল। কিংবা স্লোবোদান মিলোসেভিচের মতো আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁর বিচার হতে পারত। অথবা ন্যুরেমবুর্গ ট্রায়ালে যেমন নাতসি বর্বরতার বিচার হয়, সে-রকম কোনও বিশেষ ট্রাইবুনাল গড়ে সেখানেও তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা যেত। কিন্তু ৯/১১-র প্রতিহিংসা নিতে বদ্ধপরিকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসামাকে তেমন কোনও সুযোগ দেয়নি।
প্রস্তুতিপর্ব। গোপন ডেরায় ওসামা। ১৯৯৮
ওসামা কোথায় আত্মগোপন করে আছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর অতর্কিত কম্যান্ডো হানায় তাঁকে হত্যা করে তাঁর দেহ আটলান্টিকের নীচে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকী যে-পাকিস্তানে ওসামা আত্মগোপন করে ছিলেন, তার সরকারকেও অন্ধকারে রেখে বা অন্তত অগ্রাহ্য করে মার্কিন বাহিনী এই একতরফা নিধনকাণ্ড চালায়, যার পরিণামে ইসলামাবাদের সার্বভৌমত্ব অগ্রাহ্য করার দায়ও ওয়াশিংটনের ঘাড়ে চেপেছে। সেই থেকে ওসামার বউ-ছেলেমেয়েরা একটি অনালোকিত ঘরে বন্দি। ক্রমেই ইট-চাপা ঘাসের মতো বিবর্ণ, ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। জেহাদি হওয়ার বদলে ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে লেখাপড়া শিখে শান্তিতে বাস করার স্বপ্ন বোধহয় অধরাই থেকে যাবে। জেহাদির সন্তানদের জেহাদি না-হওয়ার অধিকার সভ্যতা মঞ্জুর করে না।
সন্ত্রাস মারফত জেহাদ ছড়ানো লোকদের প্রতি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কেমন আচরণ করে? সন্ত্রাস দিয়েই সে জেহাদকে নির্মূল করতে চায়। সন্ত্রাসীদের কোনও মানবাধিকার থাকতে পারে, এটা রাষ্ট্র সচরাচর কার্যত স্বীকার করে না, তাই সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংসতার বিপ্রতীপে রাষ্ট্রের দমনযন্ত্রের হিংস্রতা প্রকট হয়ে থাকে। দেশে দেশে দ্রোহকালের মোকাবিলায় রাষ্ট্র যে-সব বধ্যভূমি রক্তস্নাত করেছে, সেখানেই ছড়িয়ে আছে তার প্রমাণ। প্রশ্ন হল, জেহাদির নিরীহ শিশুসন্তানদের সঙ্গেও কি একই ধরনের আচরণ করার যুক্তি থাকে? ৩ বছর বয়সী হুসেন, ৫ বছর বয়সী জয়নাব কিংবা ৮ বছর বয়সী ইব্রাহিমকে মাসের-পর মাস অন্ধকার ঘরে বন্দি করে, জেরা করে পাক-মার্কিন গোয়েন্দারা বিন লাদেনের উপর কী প্রতিশোধ নিতে চান? অবশ্য যারা বিন লাদেনের ‘অপরাধ’-এর জন্য সাদ্দাম হুসেনকে সাজা দেয়, আল-কায়দার জুজু দেখিয়ে গোটা ইরাককে ধ্বংস করে, লাদেনকে তাদের হাতে তুলে না-দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখানোয় আফগানিস্তানকে বোমায় পুড়িয়ে পুরাপ্রস্তর যুগে ফিরিয়ে দেয়, তাদের এ প্রশ্ন করা হয়তো বৃথা। তারা তো কথামালার সেই নেকড়ের মতো!
তাই বিন লাদেনের শিশুসন্তানদের গবাক্ষহীন কারাগারেই ফেলে রাখা হোক। আর ইরানের মতো যারা মার্কিন প্রশাসনের বিরাগভাজন, ইজরায়েলের বিনাশকামী, উপরন্তু পরমাণু শক্তিধর হতে চায়, তাদের ডানা ছেঁটে ফেলতে জায়নবাদের আগ্রাসী যুদ্ধবাজদের লেলিয়ে দেওয়া হোক। অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে সাদ্দাম হুসেনের ইরাকের মতো আয়াতোল্লাদের ইরানকেও বশীভূত করা যায়নি। ইরাককে, আধুনিক ব্যাবিলন ও মেসোপটেমিয়াকে ছত্রভঙ্গ শ্মশান বানিয়ে তাতে পরস্পরের মাংসলোভী শৃগাল-কুক্কুরদের ছেড়ে দিয়ে মার্কিন নৌসেনারা স্বদেশে ফিরেছে। এ বার দারিয়ুস-জারেক্সেস-এর পারস্যেও তার পুনরাবৃত্তির মহড়া। কারণ আর ‘ইসলামি বোমা’ তৈরি হতে দেওয়া যায় না। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের হাজার-হাজার পরমাণু বা হাইড্রোজেন বোমাগুলো কিন্তু ‘খ্রিস্টান বোমা’ নয়, যদিও এদেরই দুটি হিরোসিমা-নাগাসাকিতে কয়েক মুহূর্তে কয়েক লক্ষ পীত মানবের প্রাণহরণ করেছিল। কিন্তু ইরান বানালে সেটা ইসলামি বোমা হয়ে যাবে! বিদ্বেষের অভিযোগ কেবল মুসলিমদের বিরুদ্ধে করা হয় মুসলিমরা খ্রিস্টবিদ্বেষী, তাই পাশ্চাত্যবিরোধী, তাই জেহাদি, সন্ত্রাসী এবং আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতার উৎকর্ষের অভিমান এক সংকীর্ণ আত্মরতি। এই সভ্যতা পূর্ণাঙ্গ মানব সভ্যতার সমার্থক নয়, তার এক খণ্ডিত অংশমাত্র, যার অন্য খণ্ডাংশগুলো ইসলামি, বৌদ্ধ, কনফুশীয় ও হিন্দু সভ্যতায় ছড়িয়ে রয়েছে। দেড়শো কোটি মুসলিমকে বাহির-দ্বার থেকে ফিরিয়ে দিলে সভ্যতার মানবিক ভুবন পূর্ণতা পেতে পারে না। তাদের কাছে টানতে হবে। তারা যখন নিজেদের ঘরের জানালা-কপাট উন্মুক্ত করে দাঁড়াতে চাইছে, তাদের জন্য পশ্চিমকেও নিজের অর্গলবদ্ধ সব দরজা খুলে ধরতে হবে, মেলে ধরতে হবে আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রতিটি দিগন্ত। ইউরোপীয় নবজাগৃতি একদা মধ্যযুগীয় ইসলাম থেকেই আহরণ করেছিল তার জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পচেতনা, স্থাপত্য, নন্দনতত্ত্ব। আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা সামগ্রিক ভাবে সেই নবজাগরণেরই উত্তরসূরি।
ইসলামের কাছে পাশ্চাত্যের সেই ঋণ কিন্তু এখনও অপরিশোধিত। সেই ঋণ পরিশোধের চেষ্টা শুরু করলে কেবল ইসলামি দুনিয়ার নয়, গোটা পৃথিবীর মঙ্গল হবে। ওসামা বিন লাদেনের ‘ইচ্ছা’ পশ্চিমের সামনে তার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.