উপলক্ষ এক, কবির অভিপ্রায় ছিল অন্য
মন কবি পৃথিবীতে আর নেই যাঁর রচিত দু-দু’টি গান পরে দু-দু’টি দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। এমন কবিও পৃথিবীতে আর আছেন কি, যাঁর রচিত জাতীয় সংগীত নিয়ে ‘জাতি’র মধ্যেই এত তীব্র বিরাগ-বিভাগ? গোটা শতাব্দী ধরে বিতর্ক? রবীন্দ্রনাথ এক বার অভিমান করে বলেছিলেন, দেশের মানুষ তাঁকে যত কষ্ট দিয়েছে, নেহাত বিধাতার কৃপায় মজবুত শরীর নিয়ে জন্মেছিলেন বলেই তিনি সে সব সহ্য করতে পেরেছেন। কথাটা কিন্তু এই জাতীয় সংগীত বিতর্ক সম্পর্কেই বলা। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাস ভারতের জাতীয় সংগীতের একশো বছর পূর্তির সময়। রবীন্দ্রনাথের জনগণমন-অধিনায়ক যিনি, তাঁর সম্পর্কে বিতর্ক ও তিক্ততার বিষয়ে খোঁজ করলে দেখা যাবে, তার উৎসটিও একশো বছর আগেই থেকে গিয়েছে।
২৭ ডিসেম্বর, ২০১১। কলকাতা। কংগ্রেসের অধিবেশন বসেছে শহরে। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন। প্রথমেই গীত হল একটি সমবেত গান, একেবারে নবরচিত, অশ্রুতপূর্ব। জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা। তার পর আর একটি গান। সেটি হিন্দি। বিতর্কে জড়াল সেই গানটিও। আসল কথা, ইংলণ্ডের সম্রাট পঞ্চম জর্জ প্রথম বার কলকাতা সফরে এলেন সে বছর। তিনি অবতীর্ণ হবেন ৩০ ডিসেম্বর। এ দিকে ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। কংগ্রেস নেতাদের মনে হয়েছিল, হাজার হোক উপনিবেশ বলে কথা, ইংলণ্ডেশ্বরকে একটু বিশেষ ভাবে বন্দনা জানানো উচিত। সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে অধিবেশনের একটি গান তাঁকে উৎসর্গ করতে চাইলেন তাঁরা। অধিবেশনের প্রথম দিন ২৬ ডিসেম্বর যেহেতু কার্যক্রম শুরু হল বন্দে মাতরম্ গান দিয়ে, দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৭ ডিসেম্বরই সেই স্বাগত-গানের দিন বলে নির্ধারিত হল। এখন প্রশ্ন কোনটি সেই স্বাগত গান? ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ না কি পরবর্তী হিন্দি গানটি?
জনগণমন-ই যদি সেই স্বাগত গান হয়, তা হলে ওঠে দ্বিতীয় প্রশ্ন। ১৯৩৭ সালে জাতীয় সংগীত সন্ধানের কাজ শুরু হতেই সেই প্রশ্নটি উঠল। যে গান ইংলণ্ডেশ্বরের বন্দনার জন্য রচিত, সেই গানকে কি আর স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত করা যায়? তা ছাড়া সে দিনের জাতীয় সংগীতের প্রধান দাবিদার ‘বন্দে মাতরম্’ গান, যার সুর-বাণীর ঝঙ্কারে পরাধীন দেশের জাতীয়তাবাদীদের এক বিরাট অংশের রক্ত উচ্ছল উদ্বেল হয়ে ওঠে, তার তুলনায় কি জনগণমন গানে স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষা ও প্রেরণা আছে?
রবীন্দ্রনাথের ছবি: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (কৃতজ্ঞতা: বিশ্বভারতী)

অর্থ-অনর্থ
ডিসেম্বর ১৯১১। দিল্লির দরবারে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ঘোষণা করলেন: বঙ্গভঙ্গ রদ হল। সঙ্গে অবশ্য এও বললেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হল কলকাতা থেকে দিল্লিতে। তবে রাজধানী নিয়ে জাতীয়-গৌরবে দীপ্ত বাঙালি মন বা মনন বিশেষ দুর্ভাবিত ছিল না। বরং তাঁদের সাধের স্বদেশী-বয়কট আন্দোলন যা শুরু হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ জানাতে, সেই আন্দোলনের বিপুল জয় তাঁরা দেখতে পেলেন এই ঘোষণায়। হয়তো সে জন্যেও, তাঁদের সম্রাট-বন্দনার ইচ্ছেটা জোরদার হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করা হল, একটি গান লিখে দিতে। ঠিক কে রবীন্দ্রনাথের কাছে এই অনুরোধ নিয়ে আসেন, তা স্পষ্ট জানা যায় না। জানা যায়, ‘ন্যাশনাল কমিটি’ এই অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ন্যাশনাল কমিটি মানে কলকাতায় সম্রাটের আগমন উপলক্ষে তৈরি সরকারি কমিটি, না কি জাতীয় কংগ্রেসের নিজস্ব কমিটি, বোঝা যায় না। রবীন্দ্রনাথ নিজে ১৯৩৭ সালে পুলিনবিহারী সেনকে লেখা একটি চিঠিতে এ বিষয়ে কিছু কথা লেখেন, যা আবার ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় (পৌষ, ১৩৪৪) প্রকাশিত হয়। ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, সরকারি মহলে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী, এমন এক বন্ধুই তাঁকে অনুরোধটি জানান। কে সেই বন্ধু? বিশেষজ্ঞ প্রবোধচন্দ্র সেন-এর অনুমান, এই বন্ধু-র নাম আশুতোষ চৌধুরী, যিনি পেশায় ব্যারিস্টার, সরকারি উঁচু মহলে যাঁর ঘোরাফেরা। জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল আবার অনুমান করেছেন, না, বন্ধুটি আশুতোষ চৌধুরী নন, পাথুরিয়াঘাটার স্যার মহারাজা প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর।
অনুরোধ যাঁরই হোক, রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, এই অনুরোধে তিনি একাধারে আশ্চর্য ও ক্রুদ্ধ হন। এবং, আশ্চর্য ক্রুদ্ধ অবস্থায় একটি গান লিখে দেন। সেই গানই জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে। সে গান কংগ্রেস নেতারা নিয়ে গেলেন, ২৭ ডিসেম্বর সভায় গাইলেন। লক্ষ করার ব্যাপার, সেই সম্রাটবন্দনার গান নিয়ে কিন্তু দুই রকম বক্তব্য ছাপা হল দুই ধরনের পত্রপত্রিকায়। ‘দি ইংলিশম্যান’, ‘দ্য স্টেটসম্যান’ ইত্যাদি সাহেবি পত্রপত্রিকাগুলি বলল, সম্রাটের জয়গান জনগণমন অধিনায়ক গাওয়া হল সে দিনের সভায়। ‘বেঙ্গলি’-র মতো বাঙালি-সম্পাদিত পত্রিকা বলল, জাতীয়তা-বোধক গান (Patriotic Song) হিসেবে গাওয়া হয়েছে জনগণমন আর সম্রাটবন্দনা হিসেবে গাওয়া হয়েছে পরবর্তী হিন্দি গানটি। এই দ্বিতীয় মতটিও যখন শোনা গিয়েছিল তখন-তখনই, অনুমান করা যায়, প্রথম থেকেই এ নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা ছিল। এবং সেই অস্পষ্টতার কারণ হয়তো এটাই যে, গানটি যে মোটেও সম্রাটবন্দনার গান হয়নি, তা সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছিল, এমনকী সাদা-চামড়ার চোখেও সেটা ধরা না-পড়বার কথা নয়। ফলে, কোনও ঝামেলায় না গিয়ে হয়তো একটি সোজাসাপটা বন্দনামূলক হিন্দি গান গেয়ে দেওয়াই শ্রেয় ভাবা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ নিজে কী বললেন? ছাব্বিশ বছর পর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেই চিঠিটিতে পাওয়া গেল তাঁর নিজের কথা: “পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর-পন্থায় যুগযুগধাবিতা যাত্রীদের যিনি চিরসারথী, যিনি জনগণের অন্তর্য্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্য রথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জ কোনোক্রমেই হতে পারেন না, সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। কেননা, তাঁর ভক্তি যতই প্রবল থাক, বুদ্ধির অভাব ছিল না।” বুদ্ধির অভাব ছিল না বলেই হয়তো সেই হিন্দি গানটির অবতারণা!
অর্থাৎ, তথ্যসাবুদ যেটুকু পাওয়া যায় তাতে সন্দেহ করা চলে না যে, রবীন্দ্রনাথ সম্রাটবন্দনার অনুরোধের পরই এই গানটি রচনা করেছিলেন। আবার এ বিষয়েও সন্দেহ চলে না যে, গানটি মোটেই সম্রাটের বন্দনার লক্ষ্য নিয়ে রচিত হয়নি। আমরা বলতে পারি, গানটার মধ্যে যেন একটা উত্তরণ ঘটে গিয়েছে। কিন্তু যদি এমন মনে করা যায় যে, উপলক্ষটা উপলক্ষই ছিল, আর কবির আসল লক্ষ্য ছিল, পরিস্থিতিকে নিজের মতো কাজে লাগিয়ে এমন একটি গান রচনা করা যেটি ভারতের জাতীয় চরিত্রের মূলে যে সত্য, তারই বন্দনাগীতি? তা হলে প্রথমাবধিই এই গান একটা আস্ত ‘সাবভার্শন’ বা অন্তর্ঘাতের উদাহরণ। তাই পদে পদে যুগযুগধাবিত দেশবাসীর কথা, দারুণ বিপ্লব আসার কথা, স্নেহময়ী মাতার কথা। পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জ-ই যেমন যুগান্তরের ভারত-রথচালক হতে পারেন না, সহজেই বোঝা যায়, তেমনই পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনও জর্জ-ই স্নেহময়ী মাতা-ও যে হতে পারেন না, সেটাও বেশ সহজ। তাই না?

‘গানের ভিতর’
‘সাবভার্শন’ এখানেই থেমে থাকল না। উপলক্ষকে কুপোকাত করল লক্ষ্য। অনেক দ্বন্দ্ববিতণ্ডার শেষে জনগণমন-ই নির্বাচিত হল জাতীয় সংগীত হিসেবে। ১৯৩৭ সাল থেকে শুরু হয় বন্দে মাতরম্ বনাম জনগণমন বিতর্ক। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বন্দে মাতরম্ বিষয়ে নানা আপত্তি-র কথা তোলে, এবং তার জায়গায় ‘অন্য কোনও’ গানের খোঁজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলি বন্দে মাতরম্-এর পক্ষে তারস্বর সমর্থন শুরু করে। সেই সময় মাদ্রাজের একটি কলেজের অধ্যক্ষ কাজিনস্ বলেন, তা হলে জনগণমন নয় কেন? “My suggestion is that Dr. rabindranath’s own intensely patriotic, ideally stimulating, and at the same time world-embracing Morning Song of India should be confirmed officially....(as) the true National Anthem of India.” বাঙালি পত্রপত্রিকা রে-রে করে ওঠে। প্রশ্ন তোলে, রবীন্দ্রগীতির মধ্যে আদৌ জাতীয়তাবোধ নামক বস্তুটি আছে কি? জনগণমন যে কারণে লেখা হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের তোড় এবং জোড়, দুই-ই ক্রমশ বাড়তে থাকে। এও বলা হয় যে, আসলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই কায়দা করে কাজিনস-কে দিয়ে প্রস্তাবটি আনিয়েছেন। কংগ্রেস একটি সাব-কমিটি তৈরি করে এ বিষয়ে মীমাংসায় আসার জন্য, যাতে থাকেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহরু। দু’জনেই রবীন্দ্রনাথের মত নেন বিষটিতে। এবং দু’জনেরই সিদ্ধান্ত, বন্দে মাতরম্ নয়, জনগণমন।
বাস্তবিক, নেতাজি একাই এই গানের যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দিলেন, তা অসামান্য। আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সংগীত হিসেবে এই গান বেছে নেন তিনি। জার্মানি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নানা জায়গায় এই গান গেয়ে এর আন্তর্জাতিক পরিচিতি তৈরি করেন। যে গান না কি এক দিন ‘ইংলণ্ডেশ্বরের জন্য’ তৈরি হয়েছিল, সেই গানের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন মূর্ত হয়ে উঠল দেশে বিদেশে। হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানির দেশের আহ্বান প্রচারিত হল এই গানেই। বন্দে মাতরম্ বিষয়ে মূল আপত্তি ছিল যে সেটি যেন বাংলার গান, বাঙালির গান, জনগণমন বিষয়ে ঠিক সেই জায়গাটাতেই সমর্থন তৈরি হয়ে উঠল: এই গান সর্ব ভারতের। আশ্চর্য যে, দু’একটি ভাঙা পংক্তি বাদ দিলে এই গানের কথা শুনে যেন বোঝাও গেল না সেটি আসলে বাংলা গান, বাঙালি কবির রচনা! সুর শুনলে বোঝা যায় না যে সেটা ঠিক কোন্ দেশি সুর। কোনও খণ্ড-পরিচয়ের ছাপ রইল না এই গানে। ভারতের জাতীয় সংগীতকে তো সেই খণ্ডতার উপরে উঠতে হতই।
এই যে সব রকম প্রত্যক্ষ প্রেক্ষিতকে ছাপিয়ে অন্য এক স্তরে উত্তীর্ণ হওয়া গান, এই-যে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের আগমন-ক্ষণে লিখতে বসে উপনিবেশের স্বাধীন আত্মপরিচয়কে কথায় সুরে ধরে দেওয়া, এর থেকে বড় ‘সাবভার্শন’ আর কী হতে পারে? জনগণমন-অধিনায়ক গানটিকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক, তা-ই যেন অলক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তার জয়টীকা হয়ে যায়। ওদের পায়ের তলা থেকে ওদের অগোচরে ওদেরই ডিঙিয়ে আমাদের চুপচাপ প্রবল পরাক্রমে উঠে-আসার কাহিনি হয়ে যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.