বোঝানো মানে কিন্তু রাগারাগি, অশান্তি নয়
আমি ইংরেজিতে এম এ পাশ করেছি। এ বার আমি এক বন্ধুর সঙ্গে একটি ডিমের ফার্মের ব্যবসা করতে চাই। আমার বাবা একটি স্কুলের সহ-প্রধানশিক্ষক। মা-বাবার ইচ্ছে, আমিও স্কুলশিক্ষক হই। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখে এসেছি। মা-বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। তাঁরা শুধু জানেন, স্কুল শিক্ষকতায় নিরাপত্তা আছে, মাইনে ভাল আর সামাজিক সম্মানও আছে। আমার মা-বাবার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমি নিজের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিতে রাজি, কিন্তু তাঁরা কিছুতেই আমায় ছাড়বেন না। বলছেন, প্রথমে চাকরির জন্য চেষ্টা কর, না পেলে না হয় তখন ব্যবসা করবি। এ দিকে, ই ডি আই কলকাতা আর নাবার্ড আমায় আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য দিতে রাজি আছে। মা-বাবাকে কী ভাবে বোঝাব?
সুমন বসাক, হাওড়া
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তোমাকে বলছি
দেখো সুমন, তোমার বয়স কত সেটা লেখোনি। এম এ পাশ করেছ দেখে অনুমান করছি, অন্তত বছর তেইশ হবে। মানে, যে বয়সে ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সব কথায় রাগ করে, বিরোধিতা করে, সেই টিন-এজ তুমি পেরিয়ে এসেছ। কাজেই, উত্তেজিত না হয়ে বোঝার চেষ্টা করো, মা-বাবা কেন বাধা দিচ্ছেন।
তোমার বাবা একটি স্কুলের সহ-প্রধানশিক্ষক। তাঁর শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা কম নয়। তোমার মা-বাবা চান, তুমি স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করে স্কুলে শিক্ষকতা করো, তাঁদের মতো জীবন কাটাও। তাঁদের এই চাওয়াটাকে তুমি তাঁদের সঙ্কীর্ণতা বলে ভেবে নিয়েছ। তুমি যে মাপকাঠিতে নিজের জীবনের লাভ-ক্ষতির হিসেব করছ, তোমার মা-বাবার মাপকাঠি হয়তো তার চেয়ে আলাদা। কিন্তু, ‘মা-বাবা কিছু বোঝে না’ মানসিকতাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করো।
বাবা-মা যা বলছেন, সেটা কি খুব ভুল? চাকরি মানে একটা নিরাপত্তা, নিয়মিত রোজগারের প্রতিশ্রুতি। স্কুলশিক্ষকের চাকরি মানে সেটা আরও নিরাপদ। জীবনে এই নিরাপত্তারও দাম আছে। মা-বাবারা সব সময়ই ছেলেমেয়ের একটা নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। ধরে নিচ্ছি, তোমাদের পরিবারে কেউ কখনও ব্যবসা করেননি। ফলে, এক জন ব্যবসায়ীর জীবন কী রকম, সে বিষয়ে তোমার মা-বাবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। সেটা তাঁদের অপরাধ নয়। তোমার কর্তব্য, ব্যবসা করে সফল হয়েছেন, এমন কিছু মানুষের সঙ্গে তোমার মা-বাবার আলাপ করিয়ে দেওয়া। তুমি নিশ্চয়ই তেমন অনেককেই চেনো, নচেৎ কী করে জানলে যে ব্যবসা করে দারুণ সফল হওয়া যায়?
জামশেদজি টাটা বা নাগবর রামরাও নারায়ণমূর্তির মতো মানুষের সাফল্যের কাহিনি তোমাকে উদ্বুদ্ধ করতেই পারে। তাঁদের জীবন সত্যিই অনুসরণযোগ্য। মুশকিল হল, এই সাফল্য অর্জন করার জন্য তাঁদের কতখানি সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সেটা কোনও জীবনী পড়ে বোঝা যায় না। বইয়ে তাঁদের ব্যর্থতার কথা নিশ্চয়ই পাবে, কিন্তু ব্যর্থতার আগে-পরে প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কী যন্ত্রণাময় ছিল, সেটা পাবে না। নিজের জীবন মানে কিন্তু সেই প্রতিটা মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে তোমায় বাঁচতে হবে। এই কথাগুলো তোমায় নিরুৎসাহ করার জন্য বলছি না। শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি, যা করতে চাইছ, সেই কাজটা কঠিন। চাকরি করার চেয়ে ঢের কঠিন। নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকলে এগিয়ে যাও, না হলে আরও এক বার ভাবো।
ডিমের ব্যবসা করার প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে আমাদের রাজ্যে ডিম উৎপাদন কেন্দ্র খুব একটা নেই। পুরো বাজারটাই এই মুহূর্তে অন্ধ্রপ্রদেশের উৎপাদকদের দখলে প্রতি দিন অন্ধ্র থেকে প্রায় পনেরো লক্ষ ডিম ঢোকে পশ্চিমবঙ্গে। ফলে তুমি এমন একটা ক্ষেত্র বেছে নিয়েছ যেটায় সাফল্যের সুযোগ রয়েছে। ব্যবসার বিষয়ে ঠিকঠাক পরিকল্পনা তৈরি করতে পারলে নাবার্ড থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া খুব একটা শক্ত হবে না। এই সুষ্ঠু পরিকল্পনা করাটাই কিন্তু খুব কঠিন কাজ। তাই তুমি যদি কোনও পেশাদার পরামর্শদাতার সহায়তা নাও, ভাল হয়। নাবার্ড ছাড়াও রাজ্য সরকারের স্বনিযুক্তি সংক্রান্ত দফতর ঋণ দেয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারো। বিশেষ করে যেগুলির সদর দফতর কলকাতায় রয়েছে, সেগুলিতে খোঁজ নাও। তবে গোটা প্রোজেক্টের যা প্রাথমিক খরচ, তার অন্তত ২০-২৫ শতাংশ নিজেকে জোগাড় করতে হয়। তাই কোনও পার্টনার পাওয়ার চেষ্টা করো।
মা-বাবাকে বোঝানোর কাজটি কঠিন। আগেই বললাম, কয়েক জন সফল ব্যবসায়ীর সঙ্গে তোমার মা-বাবার আলাপ করিয়ে দাও, তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট কথা বলার ব্যবস্থা করে দাও। নিজের ব্যবসার পরিকল্পনাটি বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলো। তাঁদের নিজের পরিকল্পনার অংশী করে নাও। তাঁদের সঙ্গে বিরুদ্ধতার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলো না। চাকরি না করে ব্যবসা করলেও যে তোমার সামাজিক সম্মান কমবে না, জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে না, তুমি মানুষ হিসেবে খারাপ হয়ে যাবে না এই কথাগুলো তাঁদের বোঝাও। বোঝানো মানে কিন্তু রাগারাগি, অশান্তি বা মানসিক চাপ তৈরি করা নয়। ভালবেসে, যুক্তি দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে বোঝাও।
বাবা-মাকে বলছি
আপনাদের ভয়ের সম্ভবত দুটো দিক এক, ছেলে চাকরি না করে ব্যবসা করলে তার জীবন আর্থিক দিক থেকে অনিশ্চিত হতে পারে; দুই, চাকরির তুলনায় ব্যবসা সামাজিক ভাবে কম সম্মানের। প্রথম ভয়টা তবুও খানিক যুক্তিসঙ্গত ব্যবসার আর্থিক দিকটা চাকরির বাঁধা মাইনের তুলনায় কম নিশ্চিত। কিন্তু, জীবনটা যখন আপনাদের ছেলের, তখন সিদ্ধান্তটা ওকেই নিতে দিন। সেই সিদ্ধান্তের ঠিক-ভুলের দায় যে ওকেই নিতে হবে, সেটা ও নিশ্চয়ই বোঝে। আপনারা আপনাদের কথাটা ওকে বুঝিয়ে বলুন, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ওর ওপর চাপ তৈরি করলে দু’পক্ষেরই ক্ষতি। বরং ওর দিক থেকে ওর জীবনটা ও কী ভাবে ভাবছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। আপনারা সেটা বুঝলে ওর অর্ধেক ভার লাঘব হয়ে যাবে। দ্বিতীয় আশঙ্কাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। ব্যবসা যথেষ্ট সম্মানজনক পেশা। স্কুলশিক্ষকের তুলনায় এক জন ব্যবসায়ী কম সম্মানযোগ্য হবেন কেন? ও তো নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে। কাজেই, ‘আর কিছু হল না বলে ব্যবসা করছে’ এই কথাটা ওর সম্বন্ধে কেউ ভাববে না। আপনারাই বা ভাবছেন কেন?
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা?
পড়ার খরচ নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে
জ্বর আসা? যে মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে।
এ বার থেকে ‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের
যে কোনও দুশ্চিন্তার কথা আমাদের জানান (এবং জানাও)
নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.