‘ক্রিয়েটিভ চাইল্ড’ সুপর্ব পাল
মায়ের লড়াইয়ে স্বীকৃতি সন্তানের
ক্লান্ত পরিশ্রম আর অসম্ভব মনের জোরেই ছেলেকে জিতিয়ে দিলেন মা। ‘প্রতিবন্ধী দিবসে’ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছ থেকে ‘ক্রিয়েটিভ চাইল্ড’-এর স্বীকৃতি পেল মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগরের বছর সাতেকের সুপর্ব পাল। প্রকারান্তরে যা সুপর্বের মা সুস্মিতা পালেরও হার-না-মানা মনোভাবের স্বীকৃতি।
সুস্মিতাদেবীর কথায়, “মনের জোরই বড় কথা। তার সঙ্গে চাই সামান্য সুযোগ। সব মা-ই তা হলে এমন অসাধ্য সাধন করতে পারবেন।” প্রতিবন্ধী শিশুর মায়েদের প্রতি তাঁর বার্তা, “ভেঙে পড়বেন না। ছেলেমেয়েকে প্রথাগত কোনও প্রতিবন্ধী-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে সব সময়ে ভর্তি করারও প্রয়োজন নেই। নিজের কাছে রেখেই প্রতিবন্ধী সন্তানকে অনেক বেশি স্বাভাবিক করে তোলা সম্ভব।”
রবীন্দ্রনগরে বাড়ি পীযূষ ও সুস্মিতা পালের। তাঁদের একমাত্র সন্তান সুপর্ব। জন্মের পরেই বোঝা যায়, সুপর্ব কানে শুনতে পাচ্ছে না। কথাও বলতে পারছে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, ৯৬ শতাংশ কম শ্রবণশক্তি নিয়েই জন্মেছে সুপর্ব। ফলে, কানের কাছে ড্রাম বাজালেও শুনতে পায় না। কথাও বলতে পারে না। তা হলে কী হবে ছেলেটার! ভাবনায়-ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন পাল-দম্পতি। একটি প্রতিবন্ধী-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ছেলেকে নিয়ে হাজিরও হয়েছিলেন সুস্মিতাদেবীরা। দেখেন, সেখানে যেমন ৫-৭ বছরের বাচ্চাও রয়েছে, তেমনই ১৮-২০ বছরের যুবকও রয়েছেন। কেবলমাত্র ইঙ্গিতেই তাঁদের বোঝানো হচ্ছে সব কিছু। কেউই কথা বলতে পারছে না। শুনতেও পারছে না। মায়ের মন কেঁদে ওঠে। সুস্মিতার কথায়, “ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেকে ভর্তি করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার মন সায় দেয়নি। কেউ কথা বলতে পারছে না, শুনতে পারছে না, কেবল ঠোঁট নাড়া দেখে আর ইঙ্গিতে সব কিছু বুঝছে দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।”
রবীন্দ্রনগরের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে। ছবি তুলেছেন রামপ্রসাদ সাউ।
তার পরেই শুরু হয় অসাধ্য সাধনে সুস্মিতাদেবীর নিজস্ব লড়াই। প্রতিবন্ধী সন্তানকে কী ভাবে শিক্ষা দান করা যায়, সে সংক্রান্ত বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করেন। আচমকা এক দিন কাগজে একটা বিজ্ঞাপন নজরে আসে। দুর্গাপুরের একটি সংস্থা প্রতিবন্ধী শিশুদের নয়, তাদের অভিভাবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বলে জানা যায়। পীযূষবাবু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁর পক্ষে দুর্গাপুরে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সুস্মিতাদেবীই হাজির হন সেখানে। টানা সাত দিন প্রশিক্ষণ নেন। দেখেন, এক জন দৃষ্টিহীন মহিলা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সুস্মিতাদেবীর কথায়, “প্রথমে বুঝতেই পারিনি যিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি দেখতে পান না। পরে জানতে পেরে আরও উৎসাহিত হই। এক জন নিজে দৃষ্টিহীন হয়েও প্রতিবন্ধী সন্তান-পালন সম্বন্ধে যদি এত কথা বলতে পারেন, তা হলে নিজের সন্তানের জন্য আমি পারব না কেন!”
শুরু হয় আম, পেঁপে, পেয়ারা আঁকা। ছবি সংগ্রহ। সে সবের নীচে সংশ্লিষ্ট জিনিসটির নাম লেখা। বাড়ির দরজায় লিখে রাখা ‘দরজা’, আলমারিতে ‘আলমারি’। সুপর্বকে দেখিয়ে সে সব শব্দ উচ্চারণ। মাঝে মাঝে রাস্তায় বেরোলেও আঁকা জিনিসগুলি যে বাইরেও থাকে, তা দেখানো। গ্রামে গিয়ে চাষি চেনানো, ট্রেন চেনাতে ট্রেন দেখানো, ফুলের ছবি দেখিয়ে ফুল চেনানো চলতেই থাকে। সুপর্ব-র কানে হিয়ারিং-এইডও লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সামান্য হলেও শুনতে পারে। এ ভাবেই দেখানো-শোনানোর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় সুপর্ব-র প্রাথমিক পাঠ। এত কাল নির্বাক ছেলেটা সে-সব ধীরে ধীরে বলতেও শেখে। সাহস আর সংকল্প বাড়ে মায়ের। এ বার শুরু হয় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর লড়াই। কিন্তু যে কোনও স্কুল সহজে ভর্তি নেয় না। অবশেষে মেদিনীপুর শহরেরই বেসরকারি নির্মলহৃদয় আশ্রমে সুযোগ মেলে। এখন সুপর্ব-র বয়স সাত।
পড়ছে প্রথম শ্রেণিতে। তবে স্কুল-কর্তৃপক্ষ শর্ত বেঁধে দিয়েছেন, ভাল ফল না করতে পারলে সুপর্বকে তাঁরা আর স্কুলে রাখবেন না। এই শর্ত স্বীকার করতে হয়েছে সুস্মিতাদেবীকে। তবে সুপর্ব আশ্বস্ত করতে পেরেছে তার মাকে। ষান্মাসিক পরীক্ষায় ভাল ফলই করেছে।
এ ভাবেই সুপর্ব পড়াশোনা শিখছে। তবলা বাজাতে শিখেছে। ছবিও আঁকছে। পরিবেশ-রক্ষা বিষয়ে এমনই চমৎকার একটি ছবি এঁকে ‘ক্রিয়েটিভ চাইল্ড’-এর স্বীকৃতি পেয়েছে ছোট্ট ছেলেটি। মানপত্র, স্মারকের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে তাকে। আর মায়ের মন আরও জোর পেয়েছে তাতে। সুস্মিতাদেবী তাই বলছেন, “হাল ছাড়ব না। আমার ছেলের মতো সন্তান যাঁদের, সেই মায়েদেরও বলব লড়াই ছাড়বেন না।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.