|
|
|
|
তৃণমূল বলছে ইতিবাচক, ‘সান্ত্বনা’ সিপিএমের |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
প্রত্যাশিত ভাবেই দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ী হলেন তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী। রাজ্যের শাসক শিবিরের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের কাজের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক ভোটের প্রতিফলন ঘটেছে এ বারের উপনির্বাচনে। তাঁর ছেড়ে-যাওয়া দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে তাঁরই ‘আস্থাভাজন’ সুব্রতবাবু ২ লক্ষ ৩০ হাজার ভোটে বিজয়ী হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতাও বলেছেন, এই জয় তাঁদের ‘আরও ভাল কাজ করার অনুপ্রেরণা’ দেবে।
স্বয়ং মমতা ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন ২ লক্ষ ১৯ হাজার ৫৭১ ভোটে। সে দিক থেকে দেখলে উপনির্বাচনে সুব্রতবাবুর জয়ের ব্যবধান সাদা অঙ্কে বেড়েছে। মমতার প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৭.১৯%, যা সুব্রতবাবুর ক্ষেত্রে ৬৪.৩২%। আড়াই বছর আগে এই কেন্দ্রে ভোটদানের হার ছিল ৬৬.৯২%, যা এ বারের উপনির্বাচনে কমে দাঁড়িয়েছিল ৫১.৮৫%-এ। সাড়ে ৬ মাস আগে বিধানসভা ভোটে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা এলাকায় ভোট পড়েছিল প্রায় ৫৯%। যেখানে সাতটি কেন্দ্রের গড় ধরলে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৯.৬৪%। |
|
তৃপ্ত: ফল ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সুব্রত বক্সী। রবিবার। ছবি: দেবাশিস রায় |
সুতরাং, গত লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের তুলনায় সব পরিসংখ্যানের বিচারেই এবং কম ভোট পড়ার নিরিখেও তৃণমূলের এ বারের ফল ‘উন্নততর’ হয়েছে। কিন্তু স্রেফ পাটিগণিতের বাইরেও তৃণমূল শিবিরের কাছে বিচার্য বিষয় ‘ইতিবাচক’ ভোট। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ের কথায়, “গত লোকসভা ভোটের সময় আমরা বিরোধী দল ছিলাম। সিপিএম-বিরোধী ভোট আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন নতুন সরকারের প্রতি মানুষ যে আস্থা রেখেছেন, এই ফল তার প্রমাণ।”
জয়ী সুব্রতবাবুরও প্রতিক্রিয়া, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই বাংলা নিরাপদ, মানুষ এই বিশ্বাস-ভরসাতেই ভোট দিয়েছেন। দলনেত্রী যে উন্নয়নমুখী বাংলা গড়ার সঙ্কল্প নিয়েছেন, তাতে তিনি ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন। তাঁর উন্নয়ন যজ্ঞকে সমর্থন করেই মানুষ ভোট দিয়েছেন।”
দক্ষিণ কলকাতায় এর আগে টানা ৬ বার জিতেছেন মমতা। দীর্ঘ দিন ধরেই এই কেন্দ্র তৃণমূলের ‘শক্ত ঘাঁটি’। সেখানে এ বারের পরাজয়ে ‘অপ্রত্যাশিত’ কিছু না-দেখলেও হারের মধ্যেও কিছু ‘সান্ত্বনা’ খুঁজে বার করতে পারছে সিপিএম! তাদের মতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ঘটনা এটাই যে, ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের পর থেকে রাজ্যে যেখানে যত নির্বাচন বা উপনির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই বামেদের ভোটের হার কমেছে। এ বারই প্রথম সেই প্রবণতা বন্ধ হয়ে বিধানসভা ভোটের তুলনায় দক্ষিণ কলকাতায় বরং ২%-এর চেয়ে সামান্য বেশি ভোট বাড়ল। দক্ষিণ কলকাতার অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রেই ‘লিড’ পেয়েছে তৃণমূল। কিন্তু কসবা (যেখানে এক কালে বামেদের ভাল ভোটব্যাঙ্ক ছিল) বাদে বাকি ৬টিতেই বামেদের প্রাপ্ত ভোটের হার বিধানসভার তুলনায় বেড়েছে। বিধানসভায় তৃণমূলের পক্ষে মোট ব্যবধান যেখানে ছিল ৩ লক্ষ ৭০ হাজারের উপরে, সুব্রতবাবুর ক্ষেত্রে তা ২ লক্ষ ৩০ হাজার হয়েছে। এই ‘আপেক্ষিক উন্নতি’র কথা মাথায় রেখেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী ঘরোয়া বৈঠকের পরে রবিবার দলের তরুণ প্রার্থী ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছে। একটি অনুষ্ঠানে কলকাতায় এসে শহর ছাড়ার আগে সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরিও ছাত্র-নেতা ঋতব্রতকে সাধুবাদ জানিয়ে গিয়েছেন। |
|
গণনাকেন্দ্রের পথে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র |
সুব্রতবাবুর জয়ে স্বভাবতই ‘স্বস্তি’ পেয়েছেন মমতা। কালীঘাটের বাড়িতে এ দিন তিনি বলেছেন, “দক্ষিণ কলকাতার মা-মাটি-মানুষকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করতে চাই না। তাঁদের শুভেচ্ছা, আশীর্বাদের জন্য কৃতজ্ঞ। আমার এক মা অসুস্থ। আর এক মা দক্ষিণ কলকাতার মা-মাটি-মানুষ মায়ের আশীর্বাদে আমি আপ্লুত!” মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “পক্ষে বা বিপক্ষে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, সকলকেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। পক্ষে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, সেটাই আগামী দিনে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের আরও ভাল কাজ করার অনুপ্রেরণা দেবে। মানুষই সব থেকে বড় বিচারক।”
একই সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী দাবি করেছেন, ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে আরও বেশি ‘নিরাপত্তা’ পেলে তাঁদের ফল আরও ভাল হত। তাঁর কথায়, “২০০৯ সালে তো মানুষ জানতেন না, পরিবর্তন হবে! ২০০৯ এর সঙ্গে ২০১১-র ভোটের অনেক ফারাক! ২০০৯-এ আমার ভোটের সময় কসবার কুমোরপাড়া, গার্ডেনরিচের মতো জায়গায় অবাধ ভোট করতে দেওয়া হয়নি।” গত লোকসভা ভোটের চেয়ে এখন রাজ্যের পরিবেশ আরও বেশি ‘গণতান্ত্রিক’ হয়েছে বলে দাবি করেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ‘গরিব, সাধারণ মানুষের জন্য’ যে উন্নয়নের কাজ তাঁর সরকার শুরু করেছে, তাতেই আস্থা রেখেছেন দক্ষিণ কলকাতার মানুষ।
বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে জোট শরিক প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এ দিন বলেছেন, “সুব্রত বক্সী অনেক ভোটে জিতবেন, এমনই ধারণা ছিল। ওঁকে শুভেচ্ছা। এই ভোট আর এক বার প্রমাণ করল, এ রাজ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সিপিএমের আর নেই!” তৃণমূলের নিজস্ব সাংগঠনিক হিসাবে আশা করা হয়েছিল, সুব্রতবাবু ৩ লক্ষ ভোটে জিতবেন। ফল প্রকাশের পরে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য বিধানসভা ভোটের চেয়ে প্রায় ৬% ভোট বেশি পাওয়ার বিষয়টিকেই ‘গুরুত্ব’ দিচ্ছেন। |
|
বিধানসভা ভোটের পরে রায়গঞ্জ, পুজালির পুরভোট এবং ভবানীপুরের বিধানসভা উপনির্বাচন থেকে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা সব ক’টি ভোটেই তৃণমূলের ফল ভাল হচ্ছে বলে জানিয়ে মুকুলবাবু ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে এ কথাও বলেছেন, “এই ফলের মাধ্যমে বাংলার মানুষ সংবাদমাধ্যমের একাংশকে এই বার্তাও দিচ্ছে যে, এই সরকার যে ভাবে চলছে, সেটাই ঠিক। অযথা খোঁচাখুঁচি করা ঠিক হবে না!”
মানুষের রায় ‘মাথা পেতে’ নিয়েই ঋতব্রত এ দিন বলেছেন, “একটা লড়াই হারলাম, কিন্তু যুদ্ধ জারি রইল!” সিপিএম প্রার্থীর কথায়, “যে মানুষ ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অভিনন্দন। যাঁদের ভোট পাইনি, সে দায় আমাদের।” দক্ষিণ কলকাতায় বামেদের এ বারের ভোটপ্রাপ্তির হার (৩৫.৬৮%) গত বিধানসভা নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্রে গড় ভোটপ্রাপ্তির (৩৩.৩৮%) চেয়ে বেশি। সামান্য বেশি গত লোকসভা ভোটের (৩৫.৩৬%) চেয়েও। ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে দু’মাস আগে সিপিএম প্রার্থী যেখানে প্রায় ২০% ভোট পেয়েছিলেন, সেখানে ঋতব্রতের প্রায় ৩৫% ভোট ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ বলেই আলিমুদ্দিন মনে করছে।
তৃণমূলের ‘দুর্গ’ বলে পরিচিত বেহালার দুই কেন্দ্রে বিধানসভার চেয়ে ব্যবধান কমাতে পেরেছেন ঋতব্রত। ‘বৈধ’ পোস্টাল ব্যালটের মধ্যে তৃণমূল ৯৯টি এবং বামফ্রন্ট ৮১টি পেয়েছে। সরকারি কর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের আঁচ এর ফলে টের পাওয়া যাচ্ছে বলে বামেদের দাবি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের কথায়, “ভবানীপুর এবং দক্ষিণ কলকাতা উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী দেয়নি। সুতরাং, কংগ্রেস-তৃণমূলের পাশাপাশি রামধনু জোটের বিরুদ্ধেই আমাদের লড়তে হয়েছে!”
সিপিএমের যাবতীয় ‘কৃতিত্বে’র দাবিকে নস্যাৎ করে মমতা অবশ্য বলেছেন, “কেউ চক্রান্ত করে উন্নয়নের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে চেষ্টা করলে শক্ত হাতে মোকাবিলা করা হবে। সিপিএমকে আগেই বলেছিলাম, ১০ বছর চুপ করে থাকতে। এখনও বলছি, চুপ করে থাকুন! কাজ করতে দিন!” |
|
|
|
|
|