|
|
|
|
জমি জালিয়াতি, কাঠগড়ায় তৃণমূল |
আনন্দ মণ্ডল • নন্দীগ্রাম |
তোমার নাম, আমার নাম নন্দীগ্রাম। তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পিছনে নন্দীগ্রামের জমির আন্দোলনের যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তা স্বীকার করেন। জমি আন্দোলনের ‘ধাত্রীভুমি’ সেই নন্দীগ্রামেই এ বার রেলে চাকরির লোভে খাস জমি অবৈধ ভাবে কেনাবেচার বড় কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। অভিযোগ, এই জালিয়াতিতে যুক্ত শাসক দল তৃণমূলেরই একটি অংশ।
নন্দীগ্রামে রেল প্রকল্পে অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তিতে ‘খাস’ হয়ে গিয়েছিল জমি। ‘ভূমিহারা’ হিসাবে ভুয়ো দাবি প্রতিষ্ঠা করে রেলের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ এবং চাকরি হাসিলের চেষ্টায় অবৈধ ভাবে সেই খাসজমিই কেনাবেচা হয়েছে। এই জালিয়াতির মাথা হিসাবে উঠে আসছে প্রশাসনের একাংশ ও তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর নামই। তবে ‘অনিয়ম’ নিয়ে সরবও হয়েছে তৃণমূলেরই অন্য অংশ।
২০০৯-এ রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা তমলুক-দিঘা রেলপথের দেশপ্রাণ স্টেশন (বাজকুল) থেকে নন্দীগ্রাম পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার রেললাইন পাতার কথা ঘোষণা করেন। ২০১০-এর ৩০ জানুয়ারি মমতা স্বয়ং নন্দীগ্রামে প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। ১২১ কোটি টাকার এই প্রকল্পের জন্য ২০১০-এর সেপ্টেম্বরে ১৮০ একর জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি করে রেল। ওই বছরই ডিসেম্বরে ফের এক দফা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জমির প্লট নম্বর, পরিমাণ, মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে তা ‘খাস’ ঘোষণা করা হয়। রেল-প্রকল্পে জমি দিলে ক্ষতিপূরণ ছাড়াও পরিবার-পিছু এক জনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দেন রেলমন্ত্রী মমতা। মূলত এই চাকরির আশ্বাসই নন্দীগ্রামে রেল-প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ মসৃণ করেছে। আবার এই ‘প্যাকেজ’ই জমি-জালিয়াতির কারণ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ‘খাস’ ঘোষণার পরেও গত ৫ অগস্ট নন্দীগ্রাম-২ ব্লকের ঘোলপুকুরিয়া মৌজার (জেএল নং ১৩৪) ৪১০৬ নম্বর দাগের জলাজমির ১ ডেসিমেল করে অংশ কেনেন ১৪ জন। যাঁদের কেউ কেউ এমনকী চণ্ডীপুর, কাঁথিরও বাসিন্দা। একই দিনে নামমাত্র পরিমাণ জমি ১৪ জন কেনার সময়ে প্রত্যক্ষদর্শী এবং শনাক্তকারী ছিলেন মাত্র এক জনই! তার পরেও ব্লক ভূমি-দফতর ওই ১৪ জনের নামে জমি রেকর্ড করে। যার সুযোগ নিয়ে ওই ১৪ জন নিজেদের ‘ভূমিহারা’ দাবি করে রেলের কাছে ক্ষতিপূরণ ও চাকরির দরখাস্তও করেন। একই মৌজায় ৪২১৯ দাগে ২ জন, ৪২১২ দাগে এক জন ১ ডেসিমেল করে জমির ক্রেতা হিসাবে গত ১৯ অগস্ট ফের রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। ৪২০৭ দাগেও ৭ জন এ ভাবে রেজিস্ট্রেশন করান। অধিগ্রহণ বিজ্ঞপ্তির আগে যাঁরা জমির স্বত্বভোগী ছিলেন, ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের এক জনের চাকরির আশ্বাসেই তাঁরা রেলকে জমি দিতে সম্মত হন। তার পরে জমি ‘খাস’ হয়। সেই ‘খাসজমি’রই অংশ ফের ‘রায়তি’ দেখিয়ে যাঁরা বিক্রি করেছেন, তাঁরাও জড়িয়ে এই জালিয়াতিতে।
ভূমি-দফতরের ‘বাস্তঘুঘু’দের যোগসাজশ ছাড়া যে অবৈধ এই কেনাবেচা করা সম্ভব নয়, তা মানছেন দফতরেরই একাধিক আধিকারিক। নন্দীগ্রামের অ্যাডিশনাল সাব-রেজিস্ট্রার সুমন বসুর বক্তব্য, “আইন অনুযায়ী অধিগৃহীত খাসজমি কেনাবেচা যায় না। ওই জমি আগেই অধিগৃহীত হয়ে থাকলে নতুন রেজিস্ট্রেশন বৈধ হবে না।” পাশাপাশি তাঁর সংশয়, “রেল-প্রকল্পের জন্য অধিগৃহীত খাসজমির তালিকা ভূমি-দফতরের হাতে না এলে অবশ্য স্ট্যাম্প ডিউটি, রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে কেউ রেজিস্ট্রেশন করাতেও পারেন।” রেল সূত্রের অবশ্য দাবি, জমির দাগ নম্বর, মালিকানা, পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য ভূমি-দফতরই দিয়েছে। তাই জমি ‘খাস’ হওয়ার বিষয়টি ওই দফতরের অজানা হতে পারে না। ‘অনিয়ম’ নিয়ে অবশ্য সরব হয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূলের ব্লক নেতা মহাদেব বাগ। তাঁর বক্তব্য, “রেলের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে অবৈধ জমি কেনাবেচায় একটি চক্র জড়িত। আমাদের দলেরও কেউ কেউ যুক্ত। প্রশাসনের একাংশের ভূমিকাও সন্দেহজনক। উচ্চ-মহলে বিষয়টি জানিয়েছি।”
মহাদেববাবু যাঁদের দিকে আঙুল তুলেছেন, তাঁদের অন্যতম তৃণমূলেরই সদ্য-প্রাক্তন ব্লক যুব-সভাপতি পরিতোষ জানা। তিনি নিজেও খাস হওয়া জমির ১ ডেসিমেল কিনেছেন। অন্য কয়েক জনকেও কিনতে ‘উৎসাহিত’ করেছেন। তাঁর স্বীকারোক্তি, “গরিব মানুষ। ভেবেছিলাম রেলের চাকরি পেলে সংসারটা বাঁচবে। তবে নিয়মে আটকালে মাথা পেতেই নেব।” পরিতোষবাবুর ইঙ্গিত, আরও কয়েক জনের ‘পরামর্শ’ রয়েছে এই কাজে।
সেই ‘পরামর্শদাতা’ এবং ভূমি দফতরের ‘বাস্তুঘুঘু’দের চিহ্নিত করার দায় প্রশাসনেরই। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না জানিয়ে জেলাশাসক রাজীব কুমারের বক্তব্য, “নিশ্চয়ই খোঁজ নেব। অধিগৃহীত খাসজমি কেনাবেচা অবশ্যই অবৈধ।” |
|
|
|
|
|