‘চুরি’র প্রমাণ মিলছে যত্রতত্র। ‘চোর’ কে, সেটাও পরিষ্কার। তবু অভিযুক্তকে নাগালে পেয়েও ধরার নাম-গন্ধ নেই পুলিশের। অভিযোগ, আইনের কোন ফাঁদে ‘চোর’কে ফেলা হবে তাই নিয়ে পুলিশের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে একই কায়দায় পরপর ‘চুরি’ ঘটেই চলেছে গোটা রাজ্যে।
‘চুরি’র নাম ‘ফিল্ম পাইরেসি’। সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘নকল’ করার কারবার। যে ‘নকলে’র ঠেলায় টলিউডের ছোট-বড় প্রযোজক-শিল্পী-কলাকুশলীদের মাথায় হাত। ইন্ডাস্ট্রি সূত্রের খবর, গোটা দেশে ‘নকলে’র ধাক্কায় বিনোদন শিল্পে বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্বের খেসারত দিতে হয়। টালিগঞ্জের ক্ষতি ফি বছর প্রায় ১০০ কোটি। নকল সিডি তৈরি করে জাঁকিয়ে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে কেব্লে বেআইনি প্রদর্শনও চলে চুটিয়ে। ভিন রাজ্যে, বিশেষত তামিলনাডুতে কড়া আইন করে এই ধরনের অপরাধে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা উল্টো। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির দাবি, গত ৩ বছরে বাংলা ছবির ‘সুসময়ে’ এই প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। এবং মাঝেমধ্যেই কোথায়, কারা এই ‘কুকাজ’ করছে বোঝা গেলেও পুলিশি ‘নিষ্ক্রিয়তা’য় তা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। |
সম্প্রতি ‘বিতর্ক’ বেধেছে বাঁকুড়ার পাত্রসায়রের একটি প্রেক্ষাগৃহের ঘটনা নিয়ে। অভিযোগ, নকল সিডি তৈরির মতলবে ওই হলেই ভিডিও ক্যামেরা চালিয়ে দেব-অভিনীত ‘রোমিও’ ছবিটি আগাগোড়া রেকর্ড করা হচ্ছিল। বুঝতে পেরে হলমালিকের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে ছবিটির প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। কিন্তু সমস্যার নিষ্পত্তি কী ভাবে হবে, তা নিয়ে এখনও ধন্দে এ রাজ্যের প্রথম সারির ওই চলচ্চিত্র-নির্মাতা সংস্থা। তাদের দাবি, এর আগে বহরমপুরের একটি হলে একই ধরনের ঘটনার কথা পুলিশকে জানিয়েও ফল মেলেনি।
কিন্তু বাঁকুড়ার ওই হলে যে নকল ‘রোমিও’ তৈরি হচ্ছিল, তা কী ভাবে টের পেলেন ছবিটির প্রযোজকেরা?
ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের এক কর্তা জানিয়েছেন, ইদানীং কিউব (QUBE) নামের ডিজিটাল সিনেমা প্রদর্শন প্রযুক্তির প্রয়োগেই হলে হলে সিনেমা দেখান তাঁরা। মফস্সলের সিনেমা হলে আর ছবির ক্যান পাঠানোর দরকার পড়ে না। উপগ্রহের সাহায্যে টিভি চ্যানেলে ছবি-খবর সম্প্রচারের ঢঙেই কলকাতা থেকে রাজ্যের বিভিন্ন হলে সিনেমা দেখানো হয়। প্রতিটি হলের নির্দিষ্ট কোড নম্বর থাকে। আর, কোন হলে কখন ছবিটি প্রদর্শিত হচ্ছে তা কলকাতায় বসে তদারকিও করা যায়।
ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতার বক্তব্য, “এই কিউব প্রযুক্তির সাহায্যেই টের পাই বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে একটি হলে গভীর রাতে ছবিটি চলছে। তখনই বুঝতে পারি, ছবিটি নকল করা হচ্ছে।” শ্রীকান্তের দাবি, সাধারণের জন্য শো চলাকালীন ভিড়ে ঠাসা হলে নকল সিডি-র মান খুব একটা ভাল হওয়া সম্ভব নয় বুঝেই অন্য সময়ে ছবিটি চালিয়ে রেকর্ড করা হচ্ছিল। হলমালিক নিমাই লায়েক বৃহস্পতিবার কলকাতায় ভেঙ্কটেশ-এর দফতরে এসেছেন। তিনি স্বীকারও করেছেন, “ওই তল্লাটে প্রভাবশালী কয়েক জনের চাপেই নকল করার জন্য ছবিটি চালানোর অনুমতি দিতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম।”
ভেঙ্কটেশ-এর বক্তব্য, এর আগে বহরমপুরের একটি সিনেমা হল থেকে একই কায়দায় ‘আমি সুভাষ বলছি’ ও ‘পাগলু’ ছবি দু’টি নকল করার অভিযোগে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিল ভেঙ্কটেশ। কিন্তু সাড়া মেলেনি। কেন? ভেঙ্কটেশ-এর দাবি, এনফোর্সমেন্ট শাখার (ইবি) স্পেশ্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট (এসএস) জ্ঞানবন্ত সিংহকে লিখিত ভাবে সবিস্তার অভিযোগ জানানো হয়েছিল। ইবি সূত্রের খবর, তখন জ্ঞানবন্তের বদলি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে তিনি অভিযোগকারীদের ইবি-র উর্ধ্বতন কর্তাদের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দেন। এডিজি (ইবি) বিজয় কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে অবশ্য তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। নির্দিষ্ট অভিযোগ জানিয়ে তাঁকে এসএমএস করা হলেও সাড়া মেলেনি। আইজি (ইবি) জয়ন্ত বসু বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।”
শ্রীকান্তের বক্তব্য, “এই ধরনের অভিযোগে কী মামলা রুজু করা হবে, তা নিয়ে পুলিশ কর্তাদের সংশয় ছিল। সাইবার আইন না কপিরাইট আইন, কোন ধারায় তদন্ত হওয়া উচিত তা নিয়ে পুলিশের মধ্যেও দ্বিমত ছিল। মাস খানেক আগে বহরমপুরের ঘটনাটি নিয়ে অভিযোগ জানানো হলেও পুলিশ এখনও কিছুই করেনি। এই অবস্থায় কারা এই কাজ করছে, বুঝেও কিছু ব্যবস্থা নিতে পারছি না।” জ্ঞানবন্তের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনিও মন্তব্য করতে চাননি। তবে ইবি সূত্রের খবর, এ ধরনের অভিযোগে কপিরাইট আইনেই মামলা হওয়া উচিত।
সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, তামিলনাডুতে এই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করা হয়। কিন্তু এ রাজ্যে পুলিশের ভূমিকা
তত ‘সদর্থক’ নয়। এই পরিস্থিতিতে ‘নকলে’র কারবারে টালিগঞ্জের ভোগান্তি অব্যাহত। |