রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
ওয়ল স্ট্রিট থেকে
য়ল স্ট্রিট বলতে যেমন সুট-বুট পরা পুরুষ আর পাওয়ার-ড্রেসিং করা মেয়েদের ছবি চোখে ফুটে ওঠে, এ ছবিটা একেবারেই সে রকম নয়। রঙিন তাঁবু, বব মার্লির মতো লম্বা চুলের রাস্তাফেরিয়ানেরা, বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক, ভবঘুরে আর গৃহহীন, টিচার আর লাইব্রেরিয়ান সবাই এই রাস্তার জুকোটি পার্ক-এ ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। দেখা হল ম্যান্ডি মাঙ্কের সঙ্গে, উনি শিকাগোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কাজ করেন। বললেন, ‘যখন দেখবে লাইব্রেরিয়ানদের মতো নিরীহ আর গা বাঁচানো চাকুরেরাও রাস্তায় নেমেছে তখন বুঝবে দুনিয়ার গণ্ডগোলটা সত্যি বড় জায়গায় পৌঁছেছে।’
ড্রাম আছে, বঙ্গো আছে, ফ্লুট আর স্যাক্সোফোন আছে। এক জন একটা চেলোও বাজাচ্ছে। এ ছাড়া অগুন্তি সব অচেনা বাদ্যযন্ত্র, নানান রকমের আওয়াজ তাদের। হাজার পোস্টার আর্ট। বব মার্লির ছবি, গাঁধীও আছেন, আবার নানান রকমের হিপি আর্টও আছে। ধূপকাঠি জ্বলছে অনেক, এমনকী খঞ্জনিও বাজছে।
এক ধারে আইন কলেজের ছাত্ররা গম্ভীর মুখে আন্দোলনকারীদের আইনি অধিকার নিয়ে ফাইল সাজাচ্ছে। যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের আত্মীয়স্বজনকে আইনের প্রক্রিয়াগুলো বোঝাচ্ছে, কী করে জামিনের আবেদন ইত্যাদি করতে হবে এই সব নিয়ে আলোচনা চলছে।
বিশাল একটা কম্পিউটার স্ক্রিনের লাইভ ক্যামেরায় পার্কের ছবি দেখা যাচ্ছে। ঠিক ড্রাম বাজিয়েদের পাশেই আবার এক দল লোক ঘুমিয়ে আছে। কী করে ঘুমোচ্ছে কে জানে! লিজা বলে একটি মেয়ে, যে এক মাস ধরে এই পার্কেই আছে, চিৎকার করে বলছে, স্লিপিং ব্যাগের ব্যবস্থা করতে হবে। লোকেরা পালা করে করে ঘুমোচ্ছে। পুরো জায়গাটা একটা তাঁবু-শহরের চেহারা নিচ্ছে, ও দিকে আবার রাতে ঠান্ডা বাড়ছে। পুলিশ এখনও তাঁবু উচ্ছেদ করেনি।
এই ‘৯৯ শতাংশের সমবায়’ নিজেদের এঁরা এই নামেই ডাকেন ওয়াল স্ট্রিট দখল করে রেখেছেন। এই ফিনানশিয়াল এলাকার চেহারাটাই বদলে গেছে। কারা এই ‘৯৯ শতাংশ’? এই নেতাবিহীন আন্দোলন শুরু হয়েছিল এ বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। এখন আমেরিকার ১০০ শহর ছাড়াও দুনিয়ার নানান দিকে ছড়িয়ে গেছে। এঁরা গণতান্ত্রিক মতে সরকার পরিচালনার ওপর বড় ব্যাঙ্ক আর বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কুপ্রভাবের বিরুদ্ধে লড়ছেন। দুনিয়াব্যাপী মন্দা, যার জন্য সাধারণ মানুষ বা ৯৯ শতাংশকে ভুগতে হচ্ছে, তার জন্যে ওয়াল স্ট্রিট, অর্থাৎ ব্যবসাবাণিজ্যের সদর দফতরকে দায়ী করে এঁরা পথে নেমেছেন। এঁদের বক্তব্য: দুনিয়ার ধনীতম ১ শতাংশ মানুষ একটি অন্যায্য বিশ্ব অর্থনীতি বানাচ্ছে, যা বাকি ৯৯ শতাংশের ভবিষ্যতের সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। এটাকে আটকানোর জন্যেই পথে নামা। পথেই হবে এ পথ চেনা।
জন জি রুট নামে এক জন সোশাল ওয়ার্কার, পার্কের সামনের দিকে একটা তাঁবু খাটিয়ে হাজির। তাঁর হাতে ‘সর্বমঙ্গলের জন্যে ব্যাঙ্ক’ (ব্যাঙ্ক ফর কমন গুড) পরিচালনার বিষয়ে লিফলেট। তিনি কিছু নতুন ধরনের নোটও ছাপিয়েছেন, সেগুলো তাঁর কোটে পিন দিয়ে লাগানো। তিনি আমাকে বললেন, ‘কখনও ভেবে দেখেছ, যদি গোটা আমেরিকাই ঋণে ডুবে আছে, আমরা সবাই ঋণে ডুবে আছি, তবে এই ঋণটা কার কাছে? কে এই দুনিয়ার সেই মহাজন? এই সহজ প্রশ্নটার উত্তর পেতে হলে নতুন একটা আর্থিক ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। যেখানে মানুষ ঠিক করবে টাকা কীসের জন্যে ব্যবহার হবে।’
এই সপ্তাহে এক দল চুল ছাঁটিয়ে পার্কে এসে হাজির হয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য হল, ব্যাঙ্কদের চুল ছেঁটে দিতে হবে। আমাদের দেশে চোরদের ধরে চুল কেটে দেওয়ার যে চলটা ছিল, মনে হয় এটা সেই ধরনের একটা গল্প। আপাতত তাঁরা পার্কের সামনের ফুটপাথে লোক ধরে ধরে চুল কেটে দিচ্ছেন, সেই লোকেদের গায়ের ঢাকা দেওয়ার কাপড়ে আবার ‘ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা’, ‘জে পি মরগ্যান’ অথবা ‘চেজ ক্লোকস’, এই সব নাম লেখা।
নতুন অর্থনীতির তাঁবুতে আমাকে পাকড়াও করে জন জি রুটস বললেন, ‘আসলে টাকাটা খরচ করা উচিত সুবিচার, শান্তি, সমাজ, গণতন্ত্র, সুস্থায়ী উন্নয়ন, এই সবের ওপর।’ আমার মুখ দেখে বললেন, ‘তুমি ভাবছ, আমি অসম্ভব কথা বলছি, কিন্তু আমাদের তো অসম্ভবটাই চাইতে হবে। তাই রাস্তায় নেমেছি।’
চেনা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি এই কথাই কী বলছেন না জন জি রুটস? ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম পার্কের সবচেয়ে রংচঙে তাঁবুটায়, তার নাম ‘পিকচার দ্য হোমলেস’। চেঙ্গিস খালিদ মহাম্মদ গত ১২ বছর ধরে নিউ ইয়র্ক শহরে হোমলেস আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। একটা বালতি উল্টে আমার জন্যে সিট বানিয়ে নিজে একটা চাদর পেতে বসলেন। বললেন, ‘মনে রাখতে হবে এই দেশটাই দখল করা দেশ, এই অকুপাই ওয়ল স্ট্রিট-এর আন্দোলনকেও সেই ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে।’ ওয়ল স্ট্রিটের বাড়িগুলো দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এই জমি, এই সব বাড়ি, তাদের ধন সবই তৈরি হয়েছে কালো ক্রীতদাসের শরীর আর জীবন দখল করে। তার বিনিময়ে আমরা একটা পয়সাও পাইনি।’ তিনি বললেন, তাঁর অবাক লাগে যে আমেরিকার বাকি মানুষদের এই সহজ কথাটা বুঝতে এত দিন, এতগুলো যুদ্ধ, এত খুন লাগল। ‘১২ বছর ধরে আমরা চিৎকার করছি যে এই বড় ব্যবসায়ীরা নিউ ইয়র্ক শহরকে বড়লোকদের প্রমোদ শহর বানিয়ে ফেলছে, ওরা আমাদের শ্রম চায়, আমাদের চায় না। ওরা আমাদের বলছে আরও
কাজ করো, জুতোর ফিতে টাইট করে বেঁধে কাজে নামো। আরে, ফিতে বাঁধতে হলে আগে তো পায়ে জুতো চাই।’
দেখি চেঙ্গিসের উদাত্ত গলা শুনে একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। একটি অল্পবয়সি ছেলে বলল, ‘পুলিশ যদি আমাদের তাড়িয়ে দেয় তবে শহরটা হরতাল হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে, ওরা সেটা জানে। মেয়র ব্লুমবার্গ বলেছেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়। আমরা জানি কথা বলা সম্ভব, কিন্তু তার জন্যে ভাষা জানতে হয়।’ ভিড় জমানো লোকেরা কথাটা তুলে নিয়ে বলতে থাকে, ‘কথা বলা সম্ভব, যদি ভাষা জানো’। শব্দটা একটা সমবেত মন্ত্রোচ্চারণের মতো হয়ে ওঠে। আরও কিছু লোক এসে জড়ো হয়, তাদের হাতে নানান রকমের বাদ্যযন্ত্র। কেউ বা হয়তো কিছু কুড়িয়ে নিয়ে সেটাই বাজাচ্ছে। একটা আশ্চর্য শব্দ তৈরি হয়। কেউ নেচে ওঠে, এক জন একটা মাইক নিয়ে কবিতা বলতে শুরু করে। কবিতার বক্তব্য হল, কান পেতে শোনো, তবেই মনটাও খুলে যাবে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই গণ রান্নাঘরের দিকে। এখানে ‘শেফস আগেনস্ট জেনেটিকালি মডিফায়েড অরগ্যানিজম’ সংস্থার সদস্যরা মানুষের নিয়ে আসা খাবার বিতরণ করছেন। এখানে ইমানুয়েলের সঙ্গে দেখা। ইমানুয়েল রাজমিস্ত্রি ছিল। গত বছর কাজ চলে যায়, আর এই বছরের গোড়ার দিকে বাড়িও চলে গিয়ে ওকে পথে আশ্রয় নিতে হয়। তার পর থেকে ও একটা চার্চের সাহায্য নিয়ে কোনও ভাবে বেঁচে আছে। দু’সপ্তাহ আগে চার্চ থেকে ওকে বলে যে জুকোটি পার্কে (মানে আন্দোলনের জায়গায়) ওর একটা ভূমিকা আছে, তাই ও এখানে চলে আসে। ও ঠিক জানত না এখানে কী হচ্ছে, কিন্তু এখানে এসে যখন কথা শুনল, পোস্টারগুলো পড়ল, তখন বুঝল যে এটা ওরও জায়গা। তার পর থেকে ও এখানেই আছে, কিচেনে কাজ করে দিচ্ছে। ইমানুয়েল বলল, ‘যে দিন আমরা চাকরি আর থাকার ঘর ফিরে পাব, সেই দিন এই আন্দোলন থামবে’।
কিন্তু সবাই এতটা আশাবাদী নয়। ইস্ট নিউ ইয়র্কের টিফানি জোনস আমাকে বলল, ‘আমরা অর্থনৈতিক হত্যার মধ্যে বাস করে চলেছি। এ বার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার সময় এসেছে। আমি প্রচণ্ড রেগে আছি। আমি জানতে চাই: কেন ওরা মিলিয়নেয়ারদের কর মকুব করল? কেন ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা কর্পোরেট ট্যাক্স দেয় না? এতগুলো বাড়ির ঋণ কেন ফোরক্লোজ করে দেওয়া হচ্ছে? কেন স্কুলের বাজেট কাট হচ্ছে? সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারগুলোর ক্ষতি করা হচ্ছে। আমি রেগে আছি, আমরা এখানে এসেছি আর আগামী কাল আমরা একটা অনুষ্ঠান করছি। ওয়লমার্ট হল কর্পোরেট লোভের একটা বড় উদাহরণ। ওরা ইস্ট নিউ ইয়র্কে একটা বিশাল স্টোর বানাচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীরা ধ্বংস হবে, বাড়ি ভাঙবে, ট্র্যাফিক জ্যামে নাভিশ্বাস উঠবে। ওরা আমাদের পাড়াগুলোকে ধ্বংস করে, আমাদের জমি কেড়ে নেয়, কোনও বেনিফিট দেয় না। তাই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে। আমেরিকার সব বড় শহরের কলেজ ছাত্ররা পথে নামছে। কে তাদের পড়াশোনা নিশ্চিত করবে? আমাদের রাজনীতিকরা কেবল স্কুলগুলোকে ব্যবসায়িক সম্পত্তি বানানোর ধান্দায় আছেন। যদি এই ভাবে দেওয়ালে পিঠ থেকে যায়, আমরা কোথায় যাব? আমরা তাই দেওয়ালটাকেই দখল করতে এসেছি।’
আর এক জন নিজের পরিচয় দেয়, ‘ড্যানি ফ্রম দ্য সিটি’ বলে। তার গল্পটা আবার আলাদা। তার পোশাকটা হল কমিক বইয়ের ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’র সাজ। কিন্তু সে আমাকে প্রথমেই সতর্ক করে দিয়ে বলল তাকে যেন আমেরিকার ক্যাপ্টেন আমেরিকা, যে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়েছিল, তার সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি। কারণ, জন সেজেছে পুয়ের্তো রিকোর কাপ্তেন আমেরিকা, যে গরিবদের মসীহা। জন নিউ ইয়র্ক পরিবহনে কাজ করে কিন্তু ছুটি নিয়ে, হাফ ডে নিয়ে ও এই আন্দোলনে আসে। ওর বক্তব্য হল: দেশটা হাতের বাইরে চলে গিয়েছে, আমাদের এক জন চ্যাম্পিয়ন দরকার যে কর্পোরেট লোভের বিরুদ্ধে লড়বে।
আর ওয়ল স্ট্রিট হল ওই লোভের প্রতীক। জন বলল এর আগে জীবনে কখনও এত লোকের সঙ্গে এত সহমর্মিতা, এত মতের মিল ও টের পায়নি। ওর কথা শুনে এক জন লাইব্রেরিয়ানের কথা মনে পড়ল, তিনি বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনের সবচেয়ে ভাল দিক হল, যে এটায় যারা এসেছে তারা আগে কখনও মিছিলে যায়নি, অবস্থান করেনি। আমরা রাজনীতি থেকে আসিনি, দল থেকে আসিনি, এন জি ও থেকে আসিনি, কোনও সংগঠন থেকে আসিনি। আমাদের কোনও সুনির্দিষ্ট দাবি নেই, তবু এটা একটা প্রতিবাদ।’
জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা। হবে চেনা হবে জানা।
কেউ কেউ বই নিয়ে আসছেন, কেউ আবার বই ধার করে পড়তেও আসছেন। তাই জুকোটি পার্কে একটা চটজলদি লাইব্রেরিও তৈরি হয়েছে। এক মাসে সেখানে জমা পড়া বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০০। আন্দোলনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন থেকেই লোকে বই আনতে শুরু করে। আগেই যে লাইব্রেরিয়ান ম্যান্ডি ম্যাঙ্কের কথা বলেছি, তিনি ও তাঁর স্বামী মিলে এই বই সামলানোর দায়িত্ব নেন, এগুলোকে বাক্সে সাজিয়ে রাখেন, লোককে পড়তে দেওয়া ও ফেরত নেওয়ার বন্দোবস্ত সামলান। বইগুলোর বেশি ভাগই হল, নোম চমস্কি, বার্নাড ই হারকোর্ট, অলডাস হাক্সলি ইত্যাদি লেখকদের লেখা। তাদের বিষয় হল কী ভাবে কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিয়মিত ভাবে মানুষকে লুঠছে। দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন বৃষ্টি নামল আর বইগুলোকে বাঁচানোর দরকার হল তখন কয়েক জন মিলে প্লাস্টিক জোগাড় করে আনলেন, রাত জেগে বইয়ের ক্যাটালগও বানানো হয়েছে। এখানকার বইয়ের একটা অনলাইন ক্যাটালগও পাওয়া যাচ্ছে এখন। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম যে একটা আন্দোলনে একটা লাইব্রেরির দরকার কীসে, উত্তর পেলাম যে, একটা দেশে যখন উচ্চ শিক্ষা ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে যায়, প্রকাশকরা বইয়ের বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন ছাত্রদের ও তাদের পরিবারের পুরো টাকাটাই চলে যায় পাঠ্যবইয়ের পিছনে, সেই খরচ সামলে ওঠা দুস্কর হয়ে ওঠে। এখন তো আবার শিক্ষার ওপরেও দারুণ ভাবে খাঁড়া নেমে এসেছে। তাই অধিকাংশ মানুষের আর বাইরের বই পড়া হয়ে ওঠে না। তাদের অন্য চিন্তার বই জোগান দেওয়াটা খুব দরকার। ম্যান্ডি আমাকে বললেন, গত এক মাসে তিনি যত পড়াশোনার খোঁজ জোগানোর কাজ করেছেন, গোটা কর্মজীবনে বোধ হয় এতটা করতে হয়নি। অনেক মানুষ তাঁর কাছে আন্দোলনের বিষয় ছাড়াও রাজনৈতিক, আইনি, স্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক খোঁজ নেন। অনেক মানুষ আছেন যাঁরা একটা বড় এয়ার কন্ডিশন্ড লাইব্রেরিতে ঢুকে খোঁজ নেওয়ার সাহস পান না। এই পার্কের মধ্যে প্লাস্টিকের চেয়ার ছড়ানো আর বাক্স ছড়ানো পরিবেশ তাঁদের অনেক বেশি সহজ করে তোলে, প্রশ্ন করার সাহস জোগায়।
দ্বিতীয় বার জুকোটি পার্কে গিয়ে আমি প্রেস টেন্টে গেলাম। অকুপাই ওয়ল স্ট্রিট আন্দোলনের পাবলিক রিলেশনস অফিসার বিল-এর সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসি-র এক জন রিপোর্টার এসে ঢুকলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরে ঘুরে নানান পোস্টারগুলো পড়ছিলেন। রিপোর্টারটি বললেন, তাঁর বস তাঁকে পাঠিয়েছেন বিষয়টাকে এক দল কলেজ ছেলের ধিঙ্গিপনা হিসেবে কভার করতে। কিন্তু এখানে এসে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে ঘটনাটা তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর মনোযোগ দাবি করে।
বিলের মতে, খবরের কভারেজ সমর্থন থেকে বিরোধিতা, নানান অবস্থানে থাকলেও, মিডিয়ার অধিকাংশই আইন অমান্য, পুলিশের হাতে গ্রেফতার ইত্যাদির ওপর জোর দিয়েছে। আন্দোলনের মূল দাবিগুলোকে নিয়ে কথা বলেনি। তাই ৭ অক্টোবর থেকে অকুপায়েড ওয়ল স্ট্রিট নামে একটা কাগজ প্রকাশিত হয়েছে, তার তৃতীয় সংখ্যাও বেরিয়ে গিয়েছে। এই পত্রিকার সম্পাদক অরুণ গুপ্তা, বহু দিনের সাংবাদিক। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, এই কাগজটা ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলনের অফিশিয়াল মুখপত্র কি না, তিনি বললেন, ‘তা নয়, কারণ ওয়ল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলনের কিছুই অফিশিয়াল নয়, সবটাই সহমত আর সম্মতির ভিত্তিতে চলে।’
কাগজের একটা কপি নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি, দেখা হল এসথার আর এডি ডেভিসের সঙ্গে। তাঁদের বয়স সত্তরের কোঠায়। এডি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক ছিলেন, পরবর্তী জীবনে শ্রমিক, থাকেন ব্রুকলিনে, রিটায়ার করেছেন ১৯৮৭ সালে, আর এসথার এই বছরে পড়ানোর কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। তাঁরা নিয়মিত এখানে আসছেন, আজ নিয়ে এগারো বার এলেন। ওঁরা আমাকে একটা পোস্টার দেখালেন। ছবিটা হল গালিভারের। গালিভারকে বেঁধে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, আর এক জন লিলিপুট তাকে বলছে, ‘উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা কোরো না, ওরা তোমাকে বলশেভিক ভাববে।’ ওঁদের বক্তব্য, এখানে এই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাটা হচ্ছে, তাই ওঁরা এখানে আসছেন। এখানে আসতে চান। এডি বললেন, ডাক্তার আমাকে বলে তোমার বাদাম খাওয়া ভাল, গিন্নি বলে, ফল খাওয়া ভাল, কিন্তু আমার শরীরের পক্ষে সবচেয়ে ভাল এখানে আসা আর শান্তির স্বপ্ন দেখা।
এর পর আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বুড়ো বললেন, এই দেশে যা কিছু ভাল, কয়েকটা ইউনিয়ন, আর সোশাল সিকিয়োরিটি, এ সবের জন্যেই কমিউনিস্টরা লড়েছিল। আর আমাদের নেতারা গিয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ল। একটা পুরনো ফোল্ডার থেকে এডি কিছু ছবি বের করে আনলেন। ১৯৩০ সালে ইউনিয়ন স্কোয়ারে আর মিট প্যাকিং এলাকায় শ্রমিকের প্রতিবাদ মিছিলের ছবি। এসথার বললেন, আমি নিয়মিত আসি, কিন্তু অল্পবয়সি ওদের মতো আর খোলা মাঠে ঘুমোতে পারি না। এডি হঠাৎ গান গেয়ে ওঠেন, ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন?’ গান শেষ করে আমাকে বলেন, গানটা ১৯৩৩ সালে কয়লা খনি শ্রমিকের স্ত্রী ফ্লোরেন্স রিকির লেখা।
হেঁটে আসছি, পরের মোড়ে এক জন হোমলেস মানুষ আমাকে দেখে হাসলেন, আমি তাঁকে কিছু পয়সা দেওয়ায় হেসে বললেন, ‘আমিও ওয়ল স্ট্রিট দখলটা সেলিব্রেট করব।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.