খুন এ বার বলরামপুরে, অভিযান শুরুর স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
নেক ধৈর্য দেখানো হয়েছে। এ বার মাওবাদী মোকাবিলায় যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হবে বলে শুক্রবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সাম্প্রতিক কালে মুখ্যমন্ত্রী বার বার মাওবাদীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তারা খুনের রাজনীতি বন্ধ না করলে সরকার ‘কড়া’ হবে। গত ১৫ অক্টোবর ঝাড়গ্রামের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদীদের সাত দিনের সময়সীমা বেঁধে দেন। মাওবাদীদের সম্পর্কে তাঁর এ ভাবে ধীরে ধীরে ‘সুর চড়ানো’ দেখে জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর অভিযান অচিরেই শুরু হবে কি না, তা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এত দিন প্রকাশ্যে ওই অভিযানের কথা বলেননি।
বৃহস্পতিবার রাতে পুরুলিয়ার বলরামপুর থানার ঘাটবেড়া গ্রামে গলায় তার পেঁচিয়ে খুন করা হয় জিতু সিংহ (৫১) নামে এক তৃণমূল কর্মীকে। অভিযোগের আঙুল ওঠে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার পরেই কড়া অবস্থান নেওয়ার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “আমি আলোচনা চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শান্তি-প্রক্রিয়া চললে অভিযান বন্ধ রাখব। কারণ, উগ্রপন্থীরা জন্ম থেকেই উগ্রপন্থী হয় না। সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে পারলে তাদের অনেকে ভালও হয়ে যায়। সে চেষ্টা থাকবে।” এই কারণেই তিনি যে অভিযান বন্ধ রেখেছিলেন, তা-ও স্পষ্ট করে দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমরা কথা দিলে, কথা রাখি। চার মাস যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ রেখেছিলাম। এমনকী, পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার মনোজ বর্মার বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানো নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় আমি চার মাস ওঁকে বসিয়ে রেখেছি। তাতে দেখা গেল, আমরাই একতরফা শান্তি-প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। উল্টো দিকে খুন বেড়ে যাচ্ছে। এ বার অভিযান চালু করতে হবে।”
পড়ে রয়েছে জিতু সিংহের দেহ। ছবি: সুজিত মাহাতো
একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে জনসাধারণের উপরে অত্যাচার হোক, তা অবশ্য আমি চাই না।” পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঘোষণা করেছেন, আগামী ১১ নভেম্বর বলরামপুরেই তিনি জনসভা করবেন।
মাওবাদীদের গ্রেফতার করা হলে তারা এবং তাদের ‘মদতদাতা’রা মিথ্যা অভিযোগ রটাচ্ছে বলেও মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ। তিনি বলেন, “মাওবাদীদের গ্রেফতার করলে বলছে ধর্ষণ করা হয়েছে! এসএমএস করা হচ্ছে। মিথ্যা কথা।” মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “আমি মানবাধিকারের পক্ষে। সে জন্য ২১ দিন ধর্নাও দিয়েছি। মানবাধিকার আদালতও তৈরি হয়েছে। কিন্তু পুলিশকে বলব কড়া হতে। খুনির কোনও জাত হয় না। খুন করলে পুলিশ তো ধরবেই। জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থেই ধরবে।”
তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে এ পর্যন্ত তাদের তিন জন কর্মীকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে। প্রত্যাশিত ভাবেই মমতার প্রতিক্রিয়া, “দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। তৃণমূলের একটা কর্মীকে খুন করলে আমরা লক্ষ কর্মী তৈরি করব। আমরা আরও কঠোর হব। আমাকে তো মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে। গুন্ডাদের হাতে রাজ্যের মানুষকে ছেড়ে দিতে পারি না।” মমতা আবারও অভিযোগ করেছেন, কলকাতা থেকে কিছু লোক মাওবাদীদের মদত দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যাদবপুরের কারা কোন বাড়িতে বৈঠক করছে, সব
জানি। কলেজ স্কোয়্যারে মিটিং করছে। যাদবপুরে পোস্টার মারছে। আমার বিরুদ্ধে কুৎসিত পোস্টার দেওয়া হচ্ছে। এসএমএস করছে। যা ইচ্ছে তাই মিথ্যে রটনা। যারা এ সব করছে, এ বার সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সে যে-ই হোক।”
মমতার অভিযোগ, মাওবাদীরা ‘ভাড়াটে খুনি’র মতো কাজ করছে। টাকা, কয়লা, জঙ্গলের কাঠ লুঠ করছে। তাঁর কথায়, “ওরা এ ভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বানিয়েছে। ২০০১ সালে সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই মাওবাদীরাই কেশপুর-গড়বেতা ঘটিয়েছিল।” তৃণমূল নেত্রীর ‘কটাক্ষ’, “নেপালে ওরা সরকার চালাচ্ছে। সেখানে গণতন্ত্র, আর পশ্চিমবঙ্গে রক্ততন্ত্র? ওরা কী ভাবে যে, শুধু ওদের রক্তেরই দাম আছে? আর কারও নেই?”
জিতুবাবুকে বৃহস্পতিবার রাতে মাওবাদীরা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছিল বলেই জানা যাচ্ছে। সেই সূত্রেই সম্ভবত মাওবাদী-উপদ্রুত এলাকায় থাকা দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রীর সতর্কবার্তা, “কেউ ডাকলেই চলে যাবেন না।” তাঁর পরামর্শ, এলাকায় গ্রামরক্ষী বাহিনী তৈরি করতে হবে। পালা করে পাহারা দিতে হবে।
পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সুনীলকুমার চৌধুরী বলেন, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, এই খুনের পিছনে মাওবাদীরাই রয়েছে। তাদের কিছু পোস্টারও মিলেছে।” পুলিশ সূত্রের খবর, কয়েকটি পোস্টারে তৃণমূল না করার ‘ফতোয়া’ দিয়েছে মাওবাদীরা। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশের ধারণা, বস্তুত এই খুনের মাধ্যমে শাসক দলের নেতৃত্বকে ‘স্পষ্ট বার্তা’ দিল মাওবাদীরা। বোঝাতে চাইল, ‘কোণঠাসা’ করার চেষ্টা হলে তারাও ‘প্রত্যাঘাত’ করবে।
ঘটনাচক্রে আজ, শনিবারই ঘাটবেড়া গ্রাম সংলগ্ন কেরোয়া স্কুল ময়দানে সভা হওয়ার কথা তৃণমূলের। সেখানে মুখ্য বক্তা দলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি দফতরের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। বলরামপুর তাঁরই বিধানসভা কেন্দ্র। জিতু সিংহের মৃতদেহের পাশে সাদা কাগজের উপরে লাল কালিতে সিপিআই (মাওবাদী) নামাঙ্কিত একাধিক পোস্টারে শনিবারের সভা বয়কট করার ডাকও দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও অবশ্য সভা বাতিল করেনি তৃণমূল। বরং ওই সভায় দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন শান্তিরামবাবু।
পেশায় ক্ষুদ্র চাষি জিতুবাবু এলাকায় নির্বিরোধী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। এ দিন তাঁর বৃদ্ধা মা কুলদাদেবী বলেন, “আমার ছেলে কারও সাতে-পাঁচে থাকত না। ওকে মেরে কী লাভ হল, কে জানে!” তবে জেলা গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, প্রাথমিক তদন্তে তাদের অনুমান, হত্যাকাণ্ডের পিছনে রয়েছে বলরামপুরে সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক ঘটনা।
এ বছর বিধানসভা ভোটের আগে এক সময় মাওবাদীদের প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ বলে পরিচিত আদিবাসী মূলবাসী কমিটির একাধিক শীর্ষ নেতা তৃণমূলে যোগ দেন। সম্প্রতি তাঁরা ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’ গড়েছেন। গত মাসে ওই কমিটির নেতৃত্বে বলরামপুরে মাওবাদী-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। পরে কমিটির নেতাদের উদ্যোগে গ্রামবাসীদের সামনে হাতজোড় করে মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা এবং উন্নয়নে সামিল হওয়ার মৌখিক মুচলেকা দেন আদিবাসী মূলবাসী কমিটির তিন জন। বলরামপুর স্টেশনে ‘নারী সম্মান রক্ষা কমিটি’-র পোস্টারে মাওবাদী-প্রতিরোধের ডাকও দেওয়া হয়।
জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “বলরামপুরের এই পরিস্থিতি এবং লাগোয়া পশ্চিম মেদিনীপুরে একাধিক সভায় তৃণমূল নেতাদের তরফে দেওয়া কড়া বার্তা কার্যত অশনিসঙ্কেত হয়ে উঠছিল মাওবাদীদের কাছে। তৃণমূলের কাছে এলাকার প্রভাব হারানোর আশঙ্কাও বাড়ছিল তাদের। সে জন্যই জিতু সিংহের মতো এক জন আপাত নিরীহ তৃণমূল কর্মীকে মেরে তারা দলের উচ্চ নেতৃত্বের কাছে বার্তা পাঠাল।”
এই অবস্থায় ঘাটবেড়ায় চরম আতঙ্ক থাকলেও জেলা তৃণমূল নেতারা তা দূর করতে মরিয়া। শনিবারের সভার কথা উল্লেখ করে শান্তিরামবাবু বলেন, “দীর্ঘকাল পরে এই এলাকায় কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি হবে। মানুষ শান্তি ও উন্নয়ন চাইছেন। শান্তির দাবিতে মিছিল করেছেন স্থানীয় যুবকেরা। বিভিন্ন ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, ওদের (মাওবাদী) পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। স্রেফ সন্ত্রাস জিইয়ে রাখতে ওরা জিতুবাবুর মতো নিরীহ লোককে খুন করল! কিন্তু এ ভাবে কি জন-সমর্থন পাওয়া যায়? মানুষ জবাব দেবেন। আমাদের সভা হবেই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.