পুস্তক পরিচয় ১...
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়
সোনার পিঞ্জরে, মঞ্জুশ্রী রায়। পরিবেশক: শৈব্যা, ৮০.০০
ঞ্জুশ্রী রায়ের উপন্যাসের নাম সোনার পিঞ্জরে। সহজ কথায়, সোনার খাঁচায়। রবীন্দ্রনাথের কথাই প্রথম মনে পড়ে। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। বর্ষীয়সী লেখিকার আত্মজৈবনিক উপন্যাসের জন্য প্রচ্ছদে আর কোন শিরোনাম ভাল মানাত? এত বেদন হয় কি ফাঁকি। দিনগুলির দিকে ফিরে তাকাতে হলে এই নামই ভাল।
পিঞ্জরে ঠিকানা আছে, বন্ধনও আছে। এই উপন্যাসের নায়ক একটা বাড়ি। উৎসর্গ-পত্রেও একটি কেন্দ্রীয় বাড়ির (‘কামাখ্যা-কুটির’) উল্লেখ দেখি। ইংরেজ লেখিকাদের আলোচনাসূত্রে অনেক সময় বলা হয়, মেয়েদের সঙ্গে বাড়ির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে এবং তাদের উপন্যাসের সঙ্গেও বাড়ির যোগ নিবিড়। বাড়ি, নভেল এবং ইংরেজ লেখিকাদের পারস্পরিক সমীকরণ নিয়ে বিখ্যাত ভাবে লিখেছেন ভার্জিনিয়া উল্ফ। সে বাড়ি গার্হস্থ্য কাঠামোর কেন্দ্র, আবার সে বাড়ি একটা আবেগের নোঙরও বটে। একটি পুরাতন বৃহৎ বনেদি বাড়ি নিয়ে এক প্রবীণা লেখিকা যখন স্মৃতিচিত্র আঁকেন, তখন কি অনেক দ্বন্দ্বের টানাপড়েন আসে? খাঁচা কি বন্দি করে, না তৈরি করে?
লেখিকা কিন্তু এই উপন্যাসে নিজের বিবাহ-উত্তর বাড়ির কথা লেখেননি। এ তাঁর বাপের বাড়ির কাহিনি। ওই ভার্জিনিয়া উল্ফেরই বিখ্যাত কথা ছিল, আমরা মেয়েরা যখন লিখতে বসি, তখন আমরা আমাদের মায়েদের মধ্য দিয়ে পিছনপানে ভাবতে থাকি। আশাপূর্ণা দেবীর বকুলও তো সুবর্ণলতা-সত্যবতীর মধ্য দিয়ে ক্রমাগত মাতৃসূত্রে পিছন দিকে তাকাতে থাকে। পিঞ্জরের পিছনে পিঞ্জর, সোনার পিছনে সোনা, অতীতের পিছনে অতীত ক্রমে মেয়েদের মাতৃসূত্র এবং বাপের বাড়ি মিলে-মিশে যায়। তবে উনিশ ও বিশ শতকের ইংরেজি উপন্যাসে নারীদৃষ্টিতে ড্রইংরুম হয়তো বেশি প্রবল। বাংলা উপন্যাসে বৈঠকখানার আধিপত্য কম, বরং গোটা বাড়িটাই যেন ভালয়-মন্দয় একটা আস্ত চরিত্র। অন্তত, মঞ্জুশ্রী রায়ের উপন্যাসে একটা সমগ্র বাড়ির সমস্ত সম্পর্ক ও সব ক’টি মহলকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাই।
মঞ্জুশ্রী রায়ের জন্ম ১৯৩১ সালে। ব্লার্বে দেখছি, বর্তমান উপন্যাসটি তাঁর প্রথম মৌলিক উপন্যাস। ১৯৬৩ সালে রচনা। বইটি প্রকাশ পেল ২০১১-য়। বত্রিশ বছর বয়সি এক যুবতী একদা তাঁর মফস্সলি বাপের বাড়ির ছবি এঁকেছিলেন এক আত্মকথার উপাখ্যানে। তারপর (ব্লার্ব থেকে বলছি) স্বামী-পুত্রের কাজে-কর্মে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘোরাঘুরি হয়েছে। জীবন-সায়াহ্নে যখন উপন্যাস ছাপা হচ্ছে, মেয়ের চোখে তখনও এক আদিগন্ত বাপের বাড়ি-মায়ের বাড়ির ছবি। আশাপূর্ণা দেবী দক্ষিণের বারান্দায় হাঁফ ছাড়ার কথা ভাবতেন। মঞ্জুশ্রী দেবী যেন স্মৃতির জানালায় হাঁফ ছাড়ছেন।
উপন্যাসে এক জন প্যাট্রিয়ার্ক আছেন। গল্পে তাঁর নাম পদ্মনাভ চৌধুরি। উৎসর্গ-পত্রে, কামাখ্যা-কুটিরের আত্মা যে স্বর্গীয় নলিনীকান্ত চক্রবর্তীর কথা আছে, পদ্মনাভ চৌধুরি বোধহয় সেই নলিনীকান্তরই আদলে তৈরি। উত্তরবঙ্গের ছোট শহরের বলিষ্ঠ গৃহপতি, বৃহৎ সংসারের সকল পোষ্যের প্রতি তাঁর অনুশীলিত সমদৃষ্টি। একটু পিউরিটান, একটু স্পার্টান, একটু স্বদেশি। অনায়াসেই তাঁকে দেবতার আসনে বসানো যেত, কিন্তু তাঁর সঙ্গে মতের বিরোধ বাধে তাঁরই মৃত ভাইয়ের পত্নীর। পদ্মনাভ যত্নে নির্মিত, রাঙাদিদি ভাঙায় উচ্ছ্বসিত। মিলিয়ে মিলিয়ে নাম রাখলে মেয়েরা সুখী হয় না বলে বাড়িতে নাম মেলানোর অনুমতি ছিল না। রাঙাদিদি সে বারণ শোনেননি। মেয়েদের নাম রেখেছিলেন মিলিয়ে মিলিয়ে। ফুলের নামে নাম। লিলি, চামেলি, আর ডালিয়া। সংক্ষেপে লিলি, মেলি, ডলি। মেয়েরা সুখী হয়নি, রাঙাদিদিরা বেরিয়ে যান, উপন্যাস দ্বন্দ্বে-বিরোধে-বিরহে-বিচ্ছেদেই গড়ে উঠতে থাকে।
ঘর-গেরস্থালিই ছিল কাহিনির মূল কথা। আত্মীয়-কুটুম্ব, সধবা-বিধবা, জ্ঞানদা-মানদা, আচার-কাসুন্দি, যজ্ঞি-হবিষ্যি ইত্যাদি বহুবিধ উপচারে সংসার তাকে-তাকে সাজানো। তারই মধ্যে ঢুকে পড়ে মুকুল, সন্দেশ, সখা ও সাথী, টুনটুনির বই আর ছোট্ট একটা রামায়ণ। বাড়ির কর্তা-গিন্নিদের জন্য চা বানাতে বানাতেই মা ঘাঁটেন মানসী, প্রবাসী, সাধনা, ভারতী আর সাহিত্য-র ছেঁড়া-ছেঁড়া পাতাগুলো। অন্দরে থাকে তাস, কার্পেট বোনা, উল, লেস-সেলাইয়ের কত আয়োজন। তারই পাশে থাকেন অলীকবাবু, থাকে সধবার একাদশী, নীলদর্পণ, হুতোমের নকশা। থাকেন বঙ্কিমবাবুও।
এ সবের মধ্যেই আনাগোনা করেন দেশের নেতা-নেত্রীরা, ভিড় করে আসে দেশের কাজ। বিলাতি বর্জনের সময় সুরেন বাঁড়ুজ্যে যখন পাবলিক মিটিংয়ে বয়কট ডিক্লেয়ার করলেন, ঘরে ঘরে বিলিতি জিনিস বর্জনের সাড়া পড়ে গেল। দাদু পদ্মনাভ সেদিন ছেলের দলকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দেখিয়েছিলেন, অন্দরে এক কণা বিলিতি পণ্য নেই (মৃত ভাইয়ের দেওয়া লম্বা বেলজিয়ান কাচের আয়নাটা ছাড়া)। বাবা উপল বিপ্লবীদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, দেশের পুরাকীর্তিতেও আগ্রহ। বাবার প্রবন্ধ বেরোয় কলকাতার নামী কাগজে, কিন্তু আন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে বাবা যান জেলে। আইন অমান্য আন্দোলনে নগেন দারোগা বাবার হাত ভেঙে রক্তাক্ত করে দেয়, পিসিমা দারোগাকে নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দেন। কুট্টিপিসির অ্যালবামে ছবি থাকে জওহরলালজি, সরোজিনী নাইডু, কমলা নেহরু, দেশবন্ধু, জিন্না, পটেল ও আজাদের।
মায়ের সৌভাগ্য সবচেয়ে বেশি। উত্তরবঙ্গে বন্যার রিলিফের সময় মা সুভাষ বোসকে দেখেছেন। তা ছাড়া বাড়ির কাছে কংগ্রেসের নিজস্ব ঘর যখন উদ্বোধন হল, তখনও সুভাষবাবু এসেছিলেন। মা দেশবন্ধু এবং বাসন্তী দেবীকেও চাঁদা তুলতে দেখেছেন। সরোজিনী নাইডুর বক্তৃতা শুনেছেন। গাঁধীজিও এসেছিলেন মা’দের স্কুলে। মায়ের হাতে কাটা মিহি সুতো দেখে গাঁধীজি পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। মেয়ের ঈর্ষা হয়, গর্ব হয়। মায়ের শাড়ি সব খদ্দরের। এই সবের মধ্যে দিয়েই একদিন এসে যায় বিয়াল্লিশের আন্দোলন। দিনের মধ্যে হাজার বার এসে হাঁক দেয় পাড়ার ছেলেরা উপলদা বাড়ি আছেন? দাদু মৌতাতে ঝিমোন, উপলদার উপর এখন দেশের ভার।
মঞ্জুশ্রী রায় তাঁর বাল্যের বাড়ির সঙ্গে দেশের গল্পকে অক্লেশে মিলিয়ে দিয়েছেন। সেই দেশ, যা একদিন স্বাধীন হয়, আবার ভাগও হয়। নেহরুর নবীন দেশ তার নীতিকে ছড়িয়ে দেয় দেশে-বিদেশে। বাড়ির সদস্যরাও সুখে-দুঃখে দেশের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। একটি মায়ার সময় সোনালি ফ্রেমে বাঁধা পড়ে যায়।
ভার্জিনিয়া উল্ফ হয়তো খুব ঠিক কথা বলেননি। মেয়েরা শুধু মায়েদের ভিতর দিয়ে পিছনে হাঁটে না। ছেলেদের মতো মেয়েরাও অনেককে নিয়েই পিছনে হাঁটে। মা থাকে, বাবা থাকে, দাদু থাকে, পিসি থাকে, জ্ঞানদা ও মানদারা থাকে, সরোজিনী নাইডু ও অরুণা আসফ আলি-রা থাকেন, গাঁধী এবং সুভাষবাবুও থেকে যান। নারী ও পুরুষ একই ভাবে ইতিহাসের ছায়াপথেই পিছনে হাঁটে।
ইতিহাসের ওই বড় পরিপ্রেক্ষিতের কথা যদি তুলতেই হয়, তবে এই বইটিকে নিশ্চিত ভাবেই একটা পর্বের দলিল হিসেবে গণ্য করা যাবে। একটা সময় ছিল, যখন পুরুষশাসিত পরিবার ভাঙছিল, অথচ মেয়েদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর তখনও সম্পূর্ণ জোর পাচ্ছিল না। প্রতিবাদী মেয়ে তখন খানিকটা ‘আদর্শ’ পৌরুষের পুরনো গৌরব খুঁজছিল, খানিকটা আবার নানা আধারে নিজের জমিও তৈরি করে নিচ্ছিল। ঘর আর বাহির তখন একটু একটু করে এলোমেলো হচ্ছিল এবং ঘরের মধ্যে ঘরও তৈরি হয়ে চলছিল পাশাপাশি, সমান্তরালে। ঘরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল সাহিত্যের ভুবন, সরস্বতীর আঙিনায় ভিড় করছিল ভিতরবাড়ির লোকজন। অন্দরে প্রবেশ করছিলেন দেশমাতৃকা, দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন অন্তঃপুরিকারা। নারীর ভুবন, সাহিত্যের ভুবন, দেশের ভুবন সব মিলিয়ে-মিশিয়ে ধীরে ধীরে সাতমহলা বাড়ি উঠছিল, যার মধ্যে ঘর হচ্ছিল বাহির এবং বাহির হচ্ছিল ঘর। এই কালান্তর হয়তো জোড়াসাঁকোয় এসেছিল শেষ উনিশ শতকে, বালুরঘাটে হয়তো দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে কিন্তু মূলত পর্ব-পরম্পরার কাহিনিটা একই জাতের। শেষ বিচারে, সোনার পিঞ্জরে এই পর্বান্তরেরই অন্তরঙ্গ আলেখ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.