মাছবাজার
নরকের চেনা মুখ
রিকল্পনা হয়েছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছ’তলা মাছবাজার তৈরি হবে। কিন্তু প্রায় দু’বছর কেটে গেলেও সেই অত্যাধুনিক বাজার তৈরির জন্য একটি ইটও গাঁথা হয়নি। ফলে নরকের ছবিটাও বদলায়নি। পাশাপাশি, প্রশাসনিক টালবাহানায় হাওড়ায় বহুতল পাইকারি মাছবাজার তৈরির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রবল অনিশ্চয়তা।
হাওড়া স্টেশনের পাশেই আই সি বসু রোডের উপর রয়েছে একশো বছরেরও বেশি পুরনো মাছবাজারটি। দুর্গন্ধময়, নোংরা জলে ভর্তি বাজারটির সংস্কারের জন্য ২০০৯-এর ২৪ নভেম্বর মহাকরণে রাজ্যের তৎকালীন নগরোন্নয়নমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। হাওড়ার মাছবাজারের জমিটির মালিকানা কেএমডিএ-র। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নতুন মাছবাজার তৈরির জন্য পুরনো বাজারের পাশেই এক একর জমি মৎস্য দফতরকে হস্তান্তর করবে কেএমডিএ। খরচ ধরা হয় ৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
যদিও কেএমডিএ-র চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার বিবেক ভরদ্বাজ বলেন, “দু’বছর আগে জমিটি মৎস্য দফতরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু কেন এখনও কোনও কাজ হয়নি তা ওরাই বলতে পারবে।” রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনার বক্তব্য: “কেএমডিএ জমিটি দিয়ে দু’বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলেছিল। ‘বেনফিশ’-কে দিয়ে বাড়ি তৈরির কথাও হয়েছিল। কিন্তু কেন কোনও কাজ হয়নি তা আগের সরকারই বলতে পারবে।” তাঁর কথায়: “আধুনিক বাড়ি তৈরির জন্য দু’বছরের সময়সীমাও শেষ হয়ে এসেছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওখানে দখলদারি, নিকাশির অনেক সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়াও নতুন বহুতল বাজার তৈরির সময় ব্যবসায়ীদের কোথায় পুনর্বাসন দেওয়া হবে তা-ও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।” হাওড়ার পাইকারি মাছবাজারের বেহাল দশার ছবিটা কি বদলাবে না? মৎস্যমন্ত্রী বলেন, “হাওড়ায় অত্যাধুনিক বহুতল পাইকারি মাছবাজার তৈরির জন্য আমরাও উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু স্থানীয় সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এই মুহূর্তে মৎস্য দফতর ওখানে কোনও কাজ করবে না।” যদিও উত্তর হাওড়ার বিধায়ক অশোক ঘোষ বলেন, “স্থানীয় সমস্যা থাকলে সেগুলি স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই মেটাতে হবে। মাছবাজারের উন্নয়নে আমরা সব কিছু করতে রাজি আছি।” এই অবস্থায় পুরসভা, কেএমডিএ না মৎস্য দফতর কাদের কাছে নিজেদের অভাব-অভিযোগ বা আবেদন জানাবেন, তা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানেন না ব্যবসায়ীরা। হাওড়া ওয়েলফেয়ার ফিশ মার্কেট স্টল ওনার্স কোঅপারেটিভ সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মসুদ বলেন, “আগেও কোনও অভিভাবক ছিল না। এখনও নেই। কার কাছে অভাব-অভিযোগ জানাব, তা-ও জানা নেই। নোংরা, দুর্গন্ধের জন্য সবাই আমাদের দায়ী করে। কিন্তু পুরসভাকে সব রকম কর দেওয়ার পরেও কোনও রকম সহযোগিতা পাই না। পুরসভার সাফাইকর্মীরা কোনও দিনই বাজারের ভিতরে ঢোকেন না।”
এই মাছবাজারে ১৬৮ জন পাইকারি ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা-সহ অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে যে মাছ বিক্রি হয় তার একটা বড় অংশই সরবরাহ হয় হাওড়ার এই পাইকারি মাছবাজার থেকে। গোটা মাছবাজারে কোনও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। স্টলের উপরে প্লাস্টিকের ছাউনি লাগানো। বাজারের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে থার্মোকলের বাক্স। আবর্জনায় বুজে গিয়েছে অধিকাংশ নর্দমা। ফলে নোংরা জলে ভাসছে গোটা বাজার চত্বর। ব্যবসায়ী শঙ্কর মশাট বলেন, “বাজারের বাইরের বড় নর্দমাগুলি দীর্ঘ দিন সাফাই করেনি পুরসভা। ফলে বর্ষার সময় পুরো বাজারে হাঁটু জল জমে যায়। প্রতি দিন আমাদের নিজস্ব ৬ জন সাফাইকর্মী দিয়ে বাজারের আবর্জনা, নর্দমা পরিষ্কার করতে হয়।”
বাজারের বাইরে রাস্তার উপরেই রয়েছে একটি ভ্যাট। দুর্গন্ধের জন্য সেই ভ্যাটের পাশ দিয়ে যাতায়াত করার সময় নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়। সমস্যা রয়েছে পার্কিং নিয়েও। মাছবাজারের নিজস্ব কোনও পার্কিং নেই। বাজারের বাইরে রাস্তার উপরেই একটি বেসরকারি সংস্থা লরি পার্কিং করায়। ফলে অধিকাংশ সময়েই যানজট লেগে থাকে। আনোয়ার মসুদ বলেন, “এত বড় বাজারে অনেক উন্নত পরিকাঠামোর দরকার। কিন্তু সব কিছু আমাদের নিজেদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বাজার তৈরি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত জমি ছাড়া আর কোনও সরকারি সাহায্যই পাইনি। বাজারের ভিতরে আবর্জনা সাফাই দূরে থাক, জল পর্যন্ত দেয় না পুরসভা।”
এ ব্যাপারে হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল অপসারণ) দেবাশিস ঘোষ বলেন, “ওই বাজারের কয়েক জন মাত্র স্টল মালিক আমাদের ট্যাক্স দেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, সবাইকেই পুরসভার আবর্জনা সাফাইয়ের ট্যাক্স দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে হাওড়া মাছবাজারও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু পুরসভার বাজার নয় বলেই ভিতরের ময়লা পরিষ্কারের দায়িত্ব পুরসভার নয়।”
ন্যাশনাল ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর মধুমিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি বাজার আমাদের অনুদানে সংস্কার করা হয়েছে। হাওড়ার পাইকারি মাছবাজারটিরও সংস্কার ও আধুনিকীকরণ করতে আমরা উৎসাহী। তবে এর জন্য রাজ্য সরকারের তরফে পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন।” তাঁর বক্তব্য: “নতুন মাছবাজার তৈরির ক্ষেত্রে যে যে সমস্যা রয়েছে, হাওড়ার পুরকর্তৃপক্ষ, জেলাশাসক ও রাজ্য মৎস্য দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে তা মেটানোর চেষ্টা করছি। ভারতের বৃহত্তম এই মাছবাজারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে এটা অত্যন্ত জরুরি।”

ছবি: রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.