সাক্ষাত্কার ...
গণ-আন্দোলন মানেই মাওবাদী কার্যকলাপ নয়

ফাঁক তো আছেই। দু’ভাবে ব্যাপারটাকে দেখা যেতে পারে। এক, আমার মনে হয়, একটা অংশ আছে যারা মাওবাদীদের সম্পর্কে সাংঘাতিক রোমান্টিক একটা ধারণা পোষণ করে। গত কয়েক বছরে ছাত্র-যুবদের মধ্যে একটা আলোড়ন তো সৃষ্টি হয়েছে। আমি কয়েকজনকে জানি, যাঁরা ওখানে গিয়েছেন, লড়াই করেছেন। সে রকম কিছু আছে, তবে মোটামুটি ভাবে বললে দূর থেকে সমর্থনের একটা ব্যাপার তো স্পষ্ট। আর এঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে আভাস পাই যে, গত দশ বছরে বামফ্রন্ট সরকার প্রায় যাকে-তাকে মাওবাদী বলে দাগিয়ে মূল স্রোতের বাইরে প্রান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখানেই একটা সমস্যা তৈরি হয়। আমি একটা লেখায় সে কথাটা বলতে গিয়ে সিনেমার ‘ফ্রিজ শট’-এর কথা তুলেছি। একটা চলমান ছবি, যেন চলতে চলতে আচমকাই চোখের সামনে স্থির হয়ে গেল, এবং থেকেও গেল।

দেখুন, রাজনৈতিক সন্ত্রাস পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু নয়। আগেও হয়েছে, গত বিধানসভা ভোটের আগে, ভোটের পরে নানা সময় সেটা দেখা গিয়েছে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস যে গত কুড়ি-তিরিশ বছরে হয়নি, তা তো নয়। নানা জায়গায়, বিচ্ছিন্ন ভাবে, ঘটেছে, ফলাও করে গণমাধ্যমে আসেনি। যদি জঙ্গলমহলের কথাই ধরেন, তা হলে দেখবেন, সেখানে দৈনন্দিন যে ব্যাপারগুলো ঘটছে, স্থানীয় ঠিকাদার, স্থানীয় পুলিশ এবং বন দফতরের কর্মী... এদের বড় একটা অংশকে নিয়ে যে নেক্সাস, যে আঁতাঁতটা তৈরি হয়েছে, সাধারণ মানুষের রক্ত শুষে নিচ্ছে, একটু প্রতিবাদ করলেই নানা রকম জুলুম, ভুয়ো কেস, অত্যাচার... এই জিনিসগুলো চলতে চলতে যেন নিতান্তই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো আর চোখের সামনে আসে না। খবর হয় কখন, যখন ওরা পাল্টা আঘাত করে কয়েকজনকে মেরে দেয়, তখন। তখন সেই ঘটনাটা অকস্মাৎ একটা খবরের মতো সামনে এসে হাজির হয়। সেটাই চোখের সামনে বেশ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয়, বেশ তো একটা স্বাভাবিক জীবন চলছিল, এই যেন ছন্দটা কেটে গেল... কিন্তু, যাকে ‘নর্ম্যালসি’ বলে ধরেই নিচ্ছি, সেটাই বা কতটা ‘স্বাভাবিক’, সেই প্রশ্ন আড়ালেই থেকে যায়।
যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে মাওবাদীদের মিছিল। লালগড়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ

হ্যাঁ, সেটা যে থাকছে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু, সন্ত্রাস যে অন্য দিকেও ছিল, দৈনন্দিন ছিল, সেটাও মনে রাখা জরুরি। আর তা ছাড়াও, আর একটা কথা আছে। এই যে সন্ত্রাস, এটা কিন্তু ওদের কাছে একটা রাস্তা, নিজের কথা অন্যের কানে, অর্থাৎ ওই তথাকথিত মূল স্রোতের কানে তোলার একটা রাস্তা। যদি কেউ দেখে যে, হিংসার পথ না নিলে কেউ আমার কথা শুনবে না, তখন ‘ভায়োলেন্স’ তার কাছে একটা ‘টুল’ হয়ে দাঁড়াবে। এটা কিন্তু হিংসাত্মক কার্যকলাপ সমর্থন করা বা না-করার কোনও প্রশ্ন নয়। এখানে প্রশ্নটা অন্য। যে হিংসাত্মক কাজকর্মগুলো ঘটছে, সেগুলো কেন ঘটছে, তা বোঝার চেষ্টা করা জরুরি। খুব জরুরি।
এই ধারণাটা, আমার কাছে, খুবই অতি সরলীকরণ। উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝি? স্কুল তৈরি, রাস্তাঘাট বানানো, ভাল পানীয় জলের বন্দোবস্ত...এগুলো তো? কিন্তু, পনেরো কুড়ি বছর আগে হলে এই সব দিয়ে সমস্যার সমাধানের একটা চেষ্টা হতে পারত। এখন জল অনেক দূর গড়িয়েছে। যদি কোনও ভাবে জঙ্গলমহলের মতো এলাকার লোকেদের অবস্থা একটু ভাল হত, যদি স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এই সব গড়ে তাদের মূল স্রোতে আনার একটা বন্দোবস্ত করা যেত, তা হলে হয়তো বলতে পারতেন যে মাওবাদীদের পক্ষে ওখানে ঢোকাটা কঠিন হত। কিন্তু এখন মাওবাদী প্রভাব ওখানে অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়েছে। পাশাপাশি, এখন যখন এই কথাটা প্রায় স্পষ্টই হয়ে গিয়েছে যে সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বললে তা প্রশাসনের কানে পৌঁছবে না, তখন আর এটা বলার কোনও মানে হয় না যে, স্কুল, রাস্তাঘাট ইত্যাদি করে দিলেই মাওবাদী প্রভাব কমে যাবে। ওই সব খুচরো উন্নয়নে কাজের কাজ কিছু হবে না, এটা প্রথমেই মনে রাখা ভাল। দ্বিতীয় কথাটা এই যে, উন্নয়ন বলতে এখন আমরা কী বুঝি? এখন রাস্তাঘাট তৈরি, পানীয় জলের বন্দোবস্ত এ সব আর উন্নয়ন নয়। এখন যে উন্নয়নের ধারণাটা চালু হয়েছে, সেটা আসলে বড়লোকদের জন্য, সচ্ছল মধ্যবিত্তের জন্য উন্নয়ন। এক্সপ্রেসওয়ে হবে। মল হবে। মুশকিল হচ্ছে, সেই উন্নয়নটা যত বেশি হবে, ততই এদের দুর্গতি। কারণ, এদের উৎখাত না করলে সেই উন্নয়নটা ঠিকঠাক করা সম্ভবই নয়। এই যে দশ শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধির একটা স্বপ্ন দেখছে সরকার, তার মানে দাঁড়াবে এই যে, যতগুলো প্রান্তিক এলাকা আছে, বনাঞ্চল, খনি অঞ্চল সব গ্রাস করতে হবে। না হলে ওই বৃদ্ধি অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, আমার মনে হয়, বিষয়টাকে যদি এ ভাবে ভাবা যায় যে, প্রশ্নটা আসলে উন্নয়নের নয়, গণতন্ত্রের প্রশ্ন।

এখানে আমি গণতন্ত্রের ধারণাটাকে একটা নৈতিক মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে দেখব। দেখুন, জাতীয় আয়বৃদ্ধির যে স্বপ্নটা দেখা হচ্ছে, সেটা তো আসলে একটা ধারণা, এমন নয় যে, ওটা না করা গেলে বিরাট কোনও নৈতিক অন্যায় হবে। কিছু লোক, যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা ভাবছেন যে, ওই জাতীয় আয় বৃদ্ধিই আসলে উদ্ধারের পথ, কিন্তু সেটা তো তাঁদের ভাবনা। অন্য দিকে আছে সুবিচারের প্রশ্ন। আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করার জন্য আমি লোকদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করব, এমন জায়গা থেকেও উচ্ছেদ করব, যেখানে শত শত বছর ধরে তারা আছে। তো, এই উৎখাতের মানে কী দাঁড়ায়? এর মানে দাঁড়ায় এই যে, আমরা সুবিচারের ওপরে একটা বাসনাকে, একটা ‘ডিজায়ার’কে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। যদি আমরা এটা ভাবি যে গণতন্ত্র আসলে একটা মূল্যবোধ, ‘জাস্টিস’ মানে সুবিচার একটা মূল্যবোধ, তা হলে এই প্রশ্নটা উঠবেই যে অগ্রাধিকারটা কে পাবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নাকি কিছু অঙ্ক-কষা উন্নয়নের ধারণা? কার উন্নয়ন, কীসের জন্য উন্নয়ন, সেই প্রশ্নগুলো তখন উঠে আসে।

ঠিকই। ভারতে মাওবাদী কার্যকলাপ, অতি বামপন্থী রাজনৈতিক কাজকর্ম এ সবেরই একটা ইতিহাস আছে, বেশ কিছু ধারা আছে, সে সব সরিয়ে দিয়ে যেখানে সেখানে ‘মাওবাদী মাওবাদী’ বললে সমস্যাটাকে ঠিকঠাক ধরা যাবে না। সত্তরের দশকে তো ‘মাওবাদী’ বলা হত না, তখন নকশাল কথাটা চালু ছিল। আসলে, ২০০৪-এ পিপলস ওয়র গ্রুপ (পি ডব্লিউ জি) এবং মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার (এম সি সি) মিলে গেল, তখনই প্রথম ওরা এই ‘মাওয়িস্ট’, মানে ‘মাওবাদী’ কথাটা ব্যবহার করল। মনে রাখতে হবে, নেপালের মাওবাদীরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই নিজদের মাওবাদী বলত। এখানে, পি ডব্লিউ জি আর এম সি সি নিজেদের ‘মাওবাদী’ বলা মাত্রই সরকারের মনে হল, তা হলে নির্ঘাৎ একটা ‘রেড করিডর’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। অথচ, এখনও ছোট বড় অনেক নকশাল সংগঠন আছে যারা নিজেদের মাওবাদী বলে না, কিন্তু নানা রকম কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। মজাটা এই যে, ‘মাওবাদী’ কথাটা এখন বেশ একটা ‘ক্যাচ অল টার্ম’, যার মধ্যে যা ইচ্ছে তা-ই পুরে ফেলা যায়। ধরুন, নয়ডাতে যেখানে রাহুল গাঁধী গিয়ে সারা দিন অবস্থানে বসলেন, সেখানেও নাকি মাওবাদী ছিল। নরেন্দ্র মোদীর গুজরাতে আদিবাসীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে। আপনি যদি যে কোনও গণ আন্দোলনকেই ‘মাওবাদী’ বলে বসেন, সে তো খুব অদ্ভুত। ওড়িশায় অভয় সাহু যে আন্দোলন করছে, অভয় নিজে সি পি আই করেন, কিন্তু বলা হচ্ছে, অভয়ের আন্দোলনে মাওবাদী প্রভাব। কিষেণজি নিজে সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, নন্দীগ্রামে গোড়ায় একজনও মাওবাদী ছিলেন না, একজনই ছিলেন, তা-ও হলদিয়ায়, নন্দীগ্রামে নয়, পরে সরকারি এবং অন্যান্য জুলুম বাড়তে থাকার পরে অবশ্য মাওবাদীরা দেড়শো রাইফেল পাঠায়, তখন নিশ্চয়ই সঙ্গে লোকও গিয়েছিল, কিন্তু প্রথম থেকেই প্রচারটা হল এই যে নন্দীগ্রামে মাওবাদীরা ঘাঁটি গেড়েছে, জলপথে অস্ত্রশস্ত্র আসছে, আরও কত কী! এর ফলে সমস্যা হচ্ছে এই যে, দু’তরফের মধ্যে ইতিবাচক একটা সংলাপের যে আবহটা তৈরি হতে পারত, সেটাই ভেঙে যাচ্ছে। যতদিন ওই কথাবার্তার প্রক্রিয়াটা ঠিকঠাক শুরু না-হবে, ততদিন সত্যিকার সমাধানের দিশা মিলবে না।

ঠিক। এবং, সেটা করতে গেলে কিন্তু যে কোনও গণ-আন্দোলনের স্বরকে ‘মাওবাদী, সুতরাং গণতন্ত্র-বিরোধী’ এমন কোনও সরলীকৃত খোপে পুরে দিলে চলবে না। শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনের অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। যদি ‘অ-স্বাভাবিক’ কিছু ঘটে, তার প্রেক্ষিতটা খতিয়ে দেখতে হবে। দেখতে হবে, যাকে ‘পলিটিক্যাল সিস্টেম’ বলা হচ্ছে, তার মধ্যে কোথায় কী কী সমস্যা আছে। মজাটা হল, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দশা এমনই যে সেই তার ওপরে জনতার আস্থা প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। পাল্টা স্বরটা কোথা থেকে আসবে? কখনও অণ্ণা হজারে। কখনও গণ-আন্দোলন।
এই প্রশ্নের একটা উত্তর খুব দার্শনিক ভঙ্গিতে দেওয়া যায় যে, কে-ই বা একেবারে নিজের কথা নিজের স্বরে বলতে পারে! একেবারে ‘আনফিল্টারড’, আকাঁড়া স্বর কারই বা আছে? কিন্তু, এখানে সেই তাত্ত্বিক দিকে গিয়ে লাভ নেই। ঘটনা হচ্ছে, একটা ভ্যানগার্ড পার্টি আদিবাসীদের হয়ে লড়ছে। দলিতদের কথা ভাবুন। কাঁসিরামের পরে যে পরিস্থিতিটা হয়েছে তাতে দলিতদের হয়ে আপনি কিছু বলতে যান, ওরাই আপনাকে আগে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি দলিত? না হলে, চুপ করে যান! জঙ্গলমহলে মাওবাদী ছাড়া অন্য কেউ নেই। আপনি হয় ওদের সঙ্গে, না হলে রাষ্ট্রের দালাল! কিন্তু, অন্য প্রশ্ন উঠছে। এই যে ‘মার্শাল’ ছেড়ে দিল, প্রশ্ন তুলল, কিষেণজি থেকে শুরু করে মাওবাদী নেতৃত্বের একটা বড় অংশই ব্রাহ্মণ, তারা কী করে প্রান্তিকদের প্রতিনিধি হয়? অর্থাৎ, প্রশ্নটা উঠছে। আগামী দিনে এই প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে দেখা দেবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.