দুঃস্বপ্নের রেলযাত্রা... ভিতরে দখলদার, বৈধ
যাত্রীরা ঢুকলেন জানলা দিয়ে
কামরা সংরক্ষিত। তবু আগাম কাটা টিকিট নিয়েও ঢুকতে পারছেন না বৈধ যাত্রীরা!
কেন?
কারণ, গোটা কামরাই যে অবৈধ যাত্রীদের দখলে! এক-দু’জন নয়, কয়েকশো মানুষ শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অধিকাংশেরই রিজার্ভেশন নেই। কিন্তু রিজার্ভড কামরার দরজাটি তাঁরা বন্ধ করে রেখেছেন সযত্নে। যাতে বৈধ যাত্রীরা উঠে আর ‘ভিড় বাড়াতে’ না-পারেন।
হাজার অনুরোধ-উপরোধ-হুমকিতেও দখলদারেরা দরজা খোলেননি। শেষমেশ বৈধ যাত্রীদেরই ঢুকতে হল আপৎকালীন জানলা ডিঙিয়ে। ঢুকেও শান্তি নেই। কারণ, কামরায় আলো নেই। সংরক্ষিত আসন দখল করে বসে আছে উটকো লোক। এক একটা আসনে ৫ থেকে ৭ জন। প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টে জুটেছে আরপিএফের লাঠি। অগত্যা অন্ধকারে মেঝেতে বসেই রাত কাটালেন ওঁরা। রিজার্ভেশনের টিকিট হাতে নিয়ে।
এ যে ঘোর আতঙ্কের রেলযাত্রা!
পুজোর ছুটিতে বিশাখাপত্তনম বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে এমনই নিদারুণ অভিজ্ঞতা হল ১২৫১৫ ডাউন তিরুঅনন্তপুরম-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস এবং ১২৮৪২ ডাউন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রীদের। কয়েক জন পরে কোনও মতে বসার জায়গা পেলেও শৌচাগারে যেতে পারেননি কেউই। শৌচাগার যে মালপত্রে ঠাসা! শুধু কি তা-ই? ট্রেনে প্যান্ট্রিকার থাকতেও খাবার মেলেনি। ‘অতিরিক্ত’ ভিড়ের কারণে পরিবেশন বন্ধ। সুতরাং পেটে কিল মেরে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় কী?
দুঃস্বপ্নের ওই যাত্রা শেষে মঙ্গলবার দুপুরে হাওড়া স্টেশনে ট্রেন দু’টো পৌঁছানোর পরে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বিক্ষোভ দেখান। স্টেশন ম্যানেজারের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন। পাশাপাশি রেলমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দু’টি ট্রেনের ভারপ্রাপ্ত সুপারিন্টেনডেন্ট, টিকিট পরীক্ষক এবং আরপিএফ জওয়ানদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও তুলেছেন তাঁরা।
শুরু থেকে কী ভাবে দুর্ভোগের শিকার হলেন ওঁরা?
কামরায় তখন দখলদারদের দৌরাত্ম্য।
তিরুঅনন্তপুরম-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসে এক যাত্রীর তোলা ছবি।
তিরুঅনন্তপুরম-গুয়াহাটির যাত্রীরা জানাচ্ছেন, সোমবার রাত ন’টা নাগাদ বিশাখাপত্তনম স্টেশনে সংরক্ষিত কামরাগুলোয় উঠতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, দরজা বন্ধ। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা যায়, ভিতরে ঠাসা ভিড়। প্রতিটি সংরক্ষিত কামরায় দু’শো-তিনশো ‘দখলদার।’ ধাক্কা মেরেও দরজা খোলা যায়নি। শেষে উপায় না দেখে আপৎকালীন জানলা খুলে ভিতরে ওঁরা ভিতরে ঢোকেন। সেই সময়ে ধস্তাধস্তিতে দু’-এক জনের চোটও লাগে বলে অভিযোগ।
যাত্রীদের আরও অভিযোগ, বৈধ টিকিট থাকলেও কোনও রেলকর্মী তো তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনইনি, আরপিএফ উল্টে হেনস্থা করেছে। ওই ট্রেনে ছিলেন দমদম পূর্ব সিঁথির বাসিন্দা প্রণবেন্দু দাস। পেশায় শিক্ষক প্রণবেন্দুবাবুর কথায়, “প্রতিবাদ করতে আরপিএফ এসে আমাদেরই ক’জনকে লাঠিপেটা করল!” প্রণবেন্দুবাবু স্ত্রী বলছেন, “যা অভিজ্ঞতা হল, তার পরে আর ট্রেনে চেপে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছি না। দরজার বদলে জানলা দিয়ে ঢুকতে হল, রাতভর খাবার, জল কিছু পেলাম না। বাথরুমেও যেতে পারিনি। এই কি রেল-পরিষেবার নমুনা?” আর এক যাত্রী শম্ভুনাথ জানার অভিযোগ, “বেশির ভাগ কামরায় আলো জ্বলেনি। অন্ধকারে মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি হয়েছে। গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টাও বাদ যায়নি। এক জনও রেলকর্মী বা টিটিই-র দেখা মেলেনি।”
একই রকম প্রাণান্তকর অবস্থায় ফিরেছেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রীরা। এ দিন বেলা দেড়টা নাগাদ ট্রেনটি হাওড়া পৌঁছয়। যাত্রীদের অভিযোগ, গোটা ট্রেনে মাঝেমধ্যেই আলো চলে গিয়েছে। জল ছিল না। আরও গুরুতর অভিযোগ: টিকিট পরীক্ষক ওয়েটিং লিস্টের যাত্রীদের কাছে তিনশো টাকা করে নিয়ে সংরক্ষিত কামরায় জায়গা করে দিয়েছেন। ফলে বৈধ যাত্রীদের দমবন্ধ ভিড়ে উদ্বাস্তু হয়ে সারা রাত কাটাতে হয়েছে। দুর্দশার একশেষ হয়েছে মহিলা ও শিশুদের। ওই ট্রেনের যাত্রী, হাওড়ার শিবপুরের বাসিন্দা বিমলেন্দু রায়ের প্রশ্ন, “এই অভিযোগ পাওয়ার পরেও কি রেল নির্বিকার থাকবে?”
রেল কী বলছে?
দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সৌমিত্র মজুমদার এ দিন বলেন, “ঘটনাটি ইস্ট কোস্ট রেলওয়ের এলাকায় হয়েছে। যাত্রীরা হাওড়ায় এসে অভিযোগ দায়ের করেছেন। আমরা তা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট রেল-কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি।”
‘নৈরাজ্যের’ পালা অবশ্য এই দু’টো ট্রেনেই শেষ হয়নি। এ দিন বিকেলে বোলপুর স্টেশনে একই ছবি দেখা গিয়েছে। শিয়ালদহমুখী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে মহিলা কামরা দখল করে বসে ছিলেন প্রচুর যাত্রী। কিছু মহিলা বৈধ টিকিট নিয়ে কামরায় উঠলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। বসতে দেওয়া হয়নি। পুলিশে অভিযোগ জানানোর কথা বলা হলে তাঁদের শাসানো হয় বলেও মহিলাদের অভিযোগ। পরে ব্যাপারটা হাওড়ার রেল-পুলিশ সুপারকে জানানো হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন।
এর আগেও রেলের যাত্রী পরিষেবা নিয়ে বারবার অভিযোগ উঠেছে। কখনও বাতানূকুল কামরায় ছারপোকার উৎপাত সইতে হয়েছে যাত্রীদের, কখনও বা মহিলার কম্বলের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন যুবক। নোংরা কামরা, শৌচাগারের দুরবস্থা বা জল না-থাকার কথা তো আকছারই শোনা যায়। যাত্রীদের প্রশ্ন, রেলে যাত্রী পরিষেবা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে বছর দুয়েক যাবৎ একাধিক কমিটি থাকা সত্ত্বেও কেন এই হাল?
সদুত্তর অবশ্য মেলেনি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.