মমতার হঠাৎ আপত্তিতে বিস্মিত মনমোহন
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘একেবারে শেষ মুহূর্তে’ বেঁকে বসায় বিস্মিত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
তাঁর দু’দিনের বাংলাদেশ সফর জুড়ে তিস্তা-বিতর্কের ছায়া পড়ে থাকলেও মমতা সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি মনমোহন। দেশের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশের মাটিতে মুখ খুলতে চাননি। কিন্তু আজ দিল্লি ফেরার পথে বিমানে সবিস্তার আলোচনা করলেন সেই বিরোধ নিয়ে। আর তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকেও ‘বার্তা’ দিলেন বলেই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের একাংশের মত।
ফেরার আগে ঢাকা বিমানবন্দরে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রের তরফে মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মূল দায়িত্বটা পালন করছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। তিনি পরিস্থিতি ঠিকমতো সামলাতে পারেননি বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। আজ প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, এর পর মেননের মতো কূটনীতিকের পাশাপাশি কোনও রাজনৈতিক দূতকেও তিনি মমতাকে বোঝানোর দায়িত্ব দেবেন কি? জবাবে মনমোহন বলেন, “কূটনীতিক বা রাজনীতিক এই ফারাকটা ঠিক বুঝছি না। কারণ, গত এক মাস ধরে আমি নিজেই মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তাঁর পরামর্শ নিয়ে চলতে চেয়েছি। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও মমতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে মেনন আমাকে জানিয়েছিলেন, চুক্তি নিয়ে সমস্যা নেই। ফলে আমরা খসড়া চূড়ান্ত করি।”
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকে তৃণমূলের মন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী প্রথম তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি তোলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি মমতার সঙ্গে কথা বলার জন্য মেননকে আবার কলকাতা পাঠাই। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে মেননের মনে হয়েছিল, সব অসুবিধা কেটে গিয়েছে। তিনি তেমন কথাই আমাকে জানিয়েছিলেন।”
মমতার সঙ্গে আলোচনার পরে তিস্তা চুক্তির সংশোধিত খসড়া নিয়ে ঢাকা চলে যান মেনন। মনমোহন বলেন, “এর পর অন্য কয়েকটি কারণে মমতা আপত্তি তোলেন। আমার সঙ্গী হিসেবে ঢাকা যেতেও তিনি অস্বীকার করেন। তবে মমতা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শরিক নেত্রী। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করেই তিস্তা চুক্তি হবে।” ‘অন্য কয়েকটি কারণ’ কী, তা স্পষ্ট করে বলেননি মনমোহন। তাঁর সচিবালয়ের একটি অংশ কিন্তু মমতার ‘খামখেয়ালিপনাকেই’ দায়ী করছে।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ করেছেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে। মেননের সঙ্গে বৈঠকে যা ঠিক হয়েছিল, আর চূড়ান্ত খসড়া চুক্তিতে যা ছিল, তা এক নয়। মমতার বক্তব্য, সেই বৈঠকে তো রাজ্যের মুখ্যসচিব এবং কেন্দ্রীয় জলসম্পদ সচিবও ছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই সবটা জানা যাবে। প্রধানমন্ত্রীও আজ দুই খসড়ার ফারাক নিয়ে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঙ্গা চুক্তির জন্য জ্যোতি বসুর প্রশংসা করেছিলেন মনমোহন। বিমানে সেই প্রসঙ্গ তুলে মমতার সঙ্গে তুলনা টানার চেষ্টাকেও আমল দেননি।
তিস্তা চুক্তি যে খুব শীঘ্রই হবে, সেই আশ্বাস কাল বারবার বাংলাদেশকে দিয়েছেন মনমোহন। কিন্তু তাতে কিঞ্চিৎ বরফ গললেও পুরোদস্তুর উষ্ণতা যে ফেরেনি, সেটা স্পষ্ট। আজ সাত সকালে ঢাকা শহরে বিবিসি-র অফিসে এক অসাধারণ আড্ডার আসর বসেছিল। ঢাকার সমস্ত বাংলা এবং ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর নিয়ে চলছিল ময়নাতদন্ত। প্রত্যেকটি কাগজেরই শিরোনাম বলছে, ঢাকা অসন্তুষ্ট। বাংলাদেশের মানুষ হতাশ। দিল্লি শেষ পর্যন্ত মমতাকে বোঝাতে ব্যর্থ হল। বলা হচ্ছে, মনমোহন একটি বড় সুযোগ হারালেন। একটি ইংরেজি দৈনিকের কার্টুন, মমতা যেন মেসি! অনায়াসে ড্রিবল করে যাচ্ছেন মনমোহনকে। আর একটি কার্টুন, বিরাট একটি আশার বেলুন মনমোহন সিংহের হাতে। মমতা একটি আলপিন নিয়ে সেটি ফুটো করতে উদ্যত।
সকাল থেকে সব চ্যানেলেই একই আলোচনা। তবে কি তিস্তা ‘পানি বণ্টন’ চুক্তি আর বাস্তবায়িত হবে না? ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কি মুখ থুবড়ে পড়ল?
দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল মনমোহনের শরীরী ভাষাতেও। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসন্তী শাড়ি পরা বঙ্গললনারা যখন সাম গানের সঙ্গে নাচছিলেন, তখন মনমোহনকে দেখে মনে হল, তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। ছাত্রছাত্রীরা যখন গাইলেন ‘আগুনের পরশমণি’, তখন তিনি করতালি দিলেন বটে, কিন্তু মুখের পরিচিত স্মিত হাসিটুকু অদৃশ্য।
পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ভবনে মনমোহন বুঝিয়ে দেন, তিনি আশাবাদী। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করাটাই তাঁর অগ্রাধিকার। মনমোহনের বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ভারত, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া’। জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগের কথা বিবেচনা করেই তিনি বলেন, “শেষ পর্যন্ত তিস্তা চুক্তি হয়ে উঠল না। তবে সব পক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করেছি। আমি আশাবাদী, সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান মিলবে।”
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও বাংলাদেশের কিছু এনজিও ভারত-বিরোধী প্রচার করছে। তাতে সঙ্গত করছে জামাতের মতো কট্টরপন্থীরা। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছেন, “বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন বাঁধ ভারত নির্মাণ করবে না।” ঢাকাই জামদানি পরা গুরশরণ কৌরও তখন মন দিয়ে শুনছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আশার বাণী। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের কথা স্মরণ করে মনমোহন বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা নিয়ে এক ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সেখানে কট্টরবাদের কোনও জায়গা নেই।
ঢাকার কূটনীতিকদের অনেকেই বলছেন, ‘আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই’। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশই শুধু আশাহত হয়নি, ধাক্কা খেয়েছে ভারতও। এ বার হয়তো সঠিক সহিষ্ণুতা নিয়ে বাস্তবের পথে এগোনোর চেষ্টা হবে, যেটা রঙিন বুদবুদ হবে না। হবে বাস্তবতার শক্ত ভিত্তিতে শরিকি মৈত্রী।
হাসিনাও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। তাঁর সরকারেরও আড়াই বছর অতিক্রান্ত। সংবিধান সংশোধন করতে গিয়ে সরকার যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিরোধী নেত্রী খালেদাও সংসদ বয়কট করছেন। সাম্প্রতিক ভোটের ফলও হাসিনার পক্ষে আশানুরূপ নয়। এই পরিস্থিতিতে ছিটমহল হস্তান্তর হল কি হল না সেটা কিন্তু বাঙালি মনস্তত্ত্বের কাছে বিরাট সাড়া জাগানো ঘটনা নয়। বরং তিস্তার জলের ‘হিস্যা’ প্রাপ্তি তাদের কাছে অনেক বড়। তাই আওয়ামি লিগ চাইছে, কিছু দিনের মধ্যেই এই চুক্তি হোক। তা হলে একে মূলধন করে ২০১৪-র ভোটে যেতে পারেন হাসিনা। সেই কারণে তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার সঙ্গে যোগসূত্র গড়তে চান তিনি।
জামাতের মতো কট্টরপন্থীরাও সক্রিয় হচ্ছে। হাসিনাকেও তাই এক কদম এগিয়ে দু’কদম পিছিয়ে আসার কৌশল নিতে হচ্ছে। মুজিব হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে সরকারকেও সময় নিতে হচ্ছে। ইসলামের দর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানে ‘বিসমিল্লা ইলাহি’কে রাখা হয়েছে। আবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে ঘোষণা করতেও সময় নেওয়া হচ্ছে। এই সবই রাজনৈতিক চাপের খেলা। আর এই পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করাটাও হাসিনার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূণ।
প্রধানমন্ত্রী স্থির করেছেন, দেশে ফিরে গিয়েই মমতার সঙ্গে আলোচনা করবেন। তিনি নিজে স্পষ্ট করে না বললেও রাজনৈতিক দূত নিয়োগ করার কথাও যে ভাবা হচ্ছে, তা কবুল করছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র। বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাইকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কত দিনের মধ্যে তিস্তা চুক্তি হবে? মাথাই জানিয়েছেন, কোনও সময়সীমা বলা সম্ভব নয়। তবে দু’দেশই বিষয়টি মেটাতে উদগ্রীব। মনমোহন সিংহকে শেখ হাসিনা যখন বিদায় জানালেন, তখন যেন একটাই বার্তা দিতে চাইলেন তিনি। আর কিছু নয়, তিস্তা ও ফেনী চুক্তির জন্য ভারতের আর একটু ‘মমতা’ প্রয়োজন বাংলাদেশের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.