রবিবাসরীয় প্রবন্ধ

ঠাৎ মনে পড়ল গত বছর পুজোয় বাবা শারদীয়া আনন্দমেলা দেয়নি। এ বার আমি নিজেই কিনব, তালতলায় নিজের এলাকার দোকান থেকে চিপসের প্যাকেট কিনে পার্ক স্ট্রিট ঘুরে ঘুরে বিক্রি। টাকা উঠে গেল আর ব্যবসাও বন্ধ। ছেলেটার গর্বিত বাবা ঘটনাটা জানতে পেরে সে বইয়ে লিখলেন, প্রথম রোজগারের টাকায়... এ অভিজ্ঞতা অভিনেতা ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু এ তো নিছক মজা। যাদের কাছে এটা রুজি-রুটি? সেই শুরুর শুরু নিয়েই এক ডজন গপ্পো...
মাছের বাবা
বিজয়গড় নিরঞ্জন সদনের পাশের গলি থেকে মাছের সার নিতে হয় রোজ দশ কেজি, কাঁধে প্রায় বস্তাটা নিয়ে ছুটতে হয় হাওড়া। আন্দুলটা বাদ দিতে হত। কারণ, সেখানে যে ওর মামাবাড়ি, আর মামারা সব ডাক্তার, বড় মানুষ, তাদের বোনের ছেলে কিনা এই সব বেচবে? তাই আন্দুল বাদ, বাকি সাঁকরাইল, উলুবেড়িয়া, বাগনান ঘুরে ঘুরে বিক্রি, এটি দিলে মাছের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে। পুকুর, ডোবার আশেপাশে সে লোক খোঁজে। সবাই বলত, ওই মাছের বাবা আসছে। তা ওই মাছেদের যৌন-কবরেজ ছেলেটি এক দিন বাগনানের গোপালনগরে ঘুরছিল, মন খারাপ, এক কেজিও কেউ কেনেনি। হঠাৎ সামনে হাজির এক গাঁধীবাদী বছর সত্তরের বুড়ো, মদন মিত্র। বললেন, যা আছে আমায় বেচে দাও, যদিও আমি এ ভাবে চাষ করি না, গাঁয়ের লোককে দিয়ে দেব। ছেলেটি জানতে চায় তবে আপনার নেওয়ার দরকার কী? বুড়ো বলে, তোমার চোখ বলছে তুমি শিল্পী। আমার চোখ খুব ভুল বলে না, তুমি অভাবে এটা করছ, এ বার থেকে যা বেচার আমায় বেচে যেয়ো আর মন যা বলে তাই কোরো। এর পর তারই দাওয়ায় বসে মনে কী চায় বলে ফেলা, শুনে বুড়োর খুশি দেখে কে, মদন মিত্তিরের চোখকে ভুল বোঝাবে? যাও যাও বেলা গড়াতে দিয়ো না। সময় নষ্ট করেনি ছেলেটা, ডুব দেয় স্বপ্নে। সে ছেলেটা আমার বহু দিনের বন্ধু রুদ্রনীল ঘোষ।

হিসেব বাবু
‘এ জীবন লইয়া কী করিব?’ উত্তর খুঁজে না পাওয়ার ফলে যা হওয়ার তাই হল। ডিপ্রেশন আর মদ্যপান। চন্দন সেন আর সুদীপা বসু প্রায় ঘেঁটি ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘চল নাটক করবি’। সুদিন বোধ হয় এ ভাবেই আসে। জুটে গেল একটা চাকরিও। ইউরেকা ফোর্বস-এর হিসেব বাবু। সারা দিন মুখ গুঁজে এল-গেল’র ধারাপাত মেলানো, টেবিলে খোলা বিল, মনে খোলা স্ক্রিপ্ট। অঙ্ক মেনে ফল যা হওয়ার তাই হল, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। ‘যত পায় বেত না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে’, হিসেবের খাতা না মেলায় মাসের শেষে নিজের মাইনের হিসেবটাও মিলত না। মাইনের টাকা তো কেটে নিলই, মুফতে জুটল বসের গালিগালাজ। নাটক বা চাকরি দুটো নয়, করতে গেলে যে কোনও একটাই করতে হবে। কোনটা রাখব আর কোনটা ছাড়ব ভাবতে ভাবতে আবারও অবাক জলপান। আবারও এক গালাগালি বর্ষণের দিনে মনে মনে বলা ‘ধুত্তোরি।’ তার পর রিহার্সালে এসে কলার তুলে বন্ধুদের বলল ‘চাকরিটা ছেড়েই দিলাম।’ তবে ছাড়ল না ছাড়িয়ে দেওয়া হল এটা আজও বুঝে উঠতে পারেনি আমাদের রনিদা। মানে রজতাভ দত্ত।

চুলের ম্যানেজার
একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় পাঁচতারা হোটেলের গেটে। হাইফান্ডার সিকিউরিটিরাও তাকে দেখে হাসে, বলে ‘অমুক বইতে আপনাকে দেখলুম, খুব ভাল লেগেছে।’ ‘হ্যাঁ, হুঁম’তে উত্তর সেরে সে দ্রুত ঢুকে যায় গেট পেরিয়ে। প্রতি ২১ দিন অন্তর সে এই হোটেলের সালোনে আসে। একমাত্র এরাই নাকি পারে তার চুলটা যথাযথ ভাবে মেনটেন করতে। সালোনের দরজার ঠিক বাম দিকে বসে থাকে একটা লোক। রুটিন মেনে এ লোকটাও হাসিমুখে জানতে চায়, ‘স্যর ভাল?’ এটুকু পথ দ্রুত পেরিয়ে যায় সে। এ পথ বড় অস্বস্তির, এ পথ বড় যন্ত্রণার, এ পথ ভীষণ সত্যির। টপার্স পার্লারে এমন কাজই করতে হত তাকে। বন্ধুরা আওয়াজ দেয়, ‘চুলের ম্যানেজার’, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। ৭০০ টাকা মাইনে যে ভীষণ প্রয়োজন। সারা দিন পার্লারে দেখভাল, সন্ধেয় নাটক। সময় যায়, মাইনে বেড়ে ৯০০ থেকে ১২০০ হয়। সারা দিন কত মানুষ আসে, হরেক কিসিমে চুল কেটে হাসি মুখে বেরোয়, তাদের হাসিমুখ মানেই ‘ম্যানেজার কর্মঠ’। দিনের পর দিন নিজের একমাথা উস্কোখুস্কো চুল সামনে নিয়ে সেটাই করে যায় ছেলেটা। দমবন্ধ লাগে সারা দিন, তবু করতেই হয়। সন্ধেয় নিশ্বাস নেয় সে, নাটক করে। করে স্বপ্নের সন্ধান। এ ভাবেই বেঁচে ছিল সে দিনের কাঞ্চা। আর এ ভাবেই দ্রুত ওই পথটা পেরিয়ে সালোনে ঢুকে যায় আজকের কাঞ্চন মল্লিক।

বেচু বাবু
ডাকনাম বেণু, কেমন করে যেন বেচু হয়ে গেল। আরে সেলসম্যান হলেই তার এমনতরো ছন্দ মিলিয়ে নাম দিতে হবে? বাবার ছিল এক্স-রে মেশিন তৈরির কারখানা, প্রথমে সে কারখানার শ্রমিক, অফিশিয়াল কাজ নয়, আক্ষরিক অর্থেই বানাতে শেখা, তার পর শুরু সেকেন্ড ইনিংস। হাসপাতাল, প্যাথলজিক্যাল সেন্টার, মায় ডাক্তারদের ঘরে ঘরে গিয়ে রোজ একই তদ্বির। সব ছেড়ে এই মেশিনটাই কিনুন, গম্ভীর গলায় এ সব কথাই সারা দিন আওড়ে যেতে হত ওই সেলসম্যানকে। মানে বেচুদা ওরফে বেণুদা ওরফে সব্যসাচী চক্রবর্তীকে।


টোল পণ্ডিত
বয়স আঠারো, উচ্চ মাধ্যমিকটাও শেষ। এ বার? হঠাৎ মনে হল সে অনেক বড় হয়ে গেছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুব জরুরি। রোজগার করতে হবে তাকে। সে মুহূর্তে সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল টিউশনি। জুতোর শুকতলা খসিয়ে এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বন্ধুভাগ্যে জুটেও গেল ছাত্রছাত্রী। সাত জন, প্রতি দিন। হপ্তায় ৪৯, মাসে...। হিসেব কষার মতো সময় নেই তার। নাটক, আড্ডা, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে আড়ি করে দিব্বি চলছিল পড়ানো। যে বেলাই খাওনা কেন, বরাদ্দ এক কাপ চা। বাড়িতে আত্মীয়-কুটুম এলে কদাচিৎ চপ-মুড়ি। বন্ধুরা আওয়াজ দিত ‘টোল পণ্ডিত’, তাতে কী? এলাকায় ও ছিল চলতা-ফিরতা বিজ্ঞাপন, এখানে যত্নসহকারে ক্লাস এইট অবধি সব সাবজেক্ট এবং টুয়েলভ অবধি ইংরেজি আর বাংলা পড়ানো হয়। টিউশন তো শুধু সিগারেট, সিনেমা নয়, বাড়ির এটা-ওটাও। এর পর এক দিন ঘটল একটা দুর্ঘটনা, ছেলেটার এক ছাত্র জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুযোগ পেয়ে গেল, ছেলেটা বুঝল এ বার তার পতন আসন্ন, পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলল সে-দিনই। সে এখন র্যাপচিক রাহুল, হার্টথ্রব রাহুল, নায়ক রাহুল, অভিনেতা রাহুল।

আধুনিক কাবুলিওয়ালা
‘এই শহর জানে আমার পুরনো সব কিছু, পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছুপিছু’ এ গানটা অনিন্দ্যর বড় প্রিয়, ‘শহর’-এর অনিন্দ্য বসু। গানটা প্রিয় হলেও কথাগুলো কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। সে সময়টা ছিল ক্রেডিট কার্ডের গোড়ার সময়। লোকে তখনও সন্দিহান। কার্ড ফিরিওয়ালা না আধুনিক কাবুলিওয়ালা? অতএব চাই বলিয়ে-কইয়ে কিছু ছেলেপিলে। যারা ধরতে পারবে, ঘুরতে পারবে আর করতে পারবে বাজার। নাম লেখাল অনিন্দ্য। সে এক হাস্যকর সহাবস্থান। ছেঁড়া প্যান্টের ওপর কাচা জামা গুঁজে পরতেই হবে। জল দিয়ে হলেও জুতোটাকে সব সময় সাফ রাখতে হবে। গলায় পরতে হবে টাই। দিনের শেষে সে টাই ফাঁসির দড়ির মতো লকলক করে ঝুলত গলায়। ‘এই কার্ড মানে থুতু দিয়ে গুনেগুনে টাকা দেওয়ার দিন শেষ, পকেটে ক্যাশ নিয়ে ঘোরাটাও বোকামি, পছন্দ মতো যা খুশি করুন, কিনুন তার পর জাস্ট পাঞ্চ করলেই ঝামেলা খতম’ এই কথাগুলোই ইংরেজি-বাংরেজি-বিন্দি-সাধুভাষা আর অতি চলিতে উল্টেপাল্টে বলে যেতে হয়। ঠান্ডা ঠান্ডা অফিসে মুখের লবঙ্গ চিবিয়ে ‘মে আই কাম ইন’ বলে ঢুকে পড়া। আর বেরিয়ে এসে কখনও আনন্দে কখনও দুঃখে পাশের ফুটপাথে বসে ইস্ত্রি করা গুঁজে পরা শার্টের পকেট থেকে বিড়ি বার করে জ্বালিয়ে চোখ বুজে সুখটান। মাথায় ঘোরে একটাই শব্দ ‘টার্গেট’। আর সেই টার্গেট ছুঁতে পারার মুহূর্তগুলো কী আবেশে যে দিশেহারা হয়ে যেত, সকাল থেকে বেরিয়ে অফিস বাড়ি ভিজিট মিটতে মিটতে রাত্তির। ...এখন শ্রোতা উন্মাদ হয়ে ওঠে এক বার অনিন্দ্য শহর বসুকে ছুঁয়ে দেখার জন্য।

নতুন নামে ডেকো
পবিত্রর বাবার ছিল বুলডোজারের ব্যবসা, বেশ চলছিল হইহই করে। ছেলে বড় হলে যা হয় আর কী! বাবাকে বলতে বাবা নিয়ে এলেন নিজের ব্যবসায়। তবে ছেলে বলে রেয়াত করে নয়, এক জন সাধারণ কর্মচারী হিসেবেই। চতুর্দিকে মাটি কাটার কাজে এর তখন খুব চাহিদা। বাবার ব্যবসার প্রায় পুরোটাই দেখাশোনা করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা। বুদ্ধিমান ছেলে ঢুকেই বুঝে গেল কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। ব্যবসা চলে রমরমিয়ে অথচ মুনাফার ভাঁড়ারে তেমন কিছু নেই। দিনকয়েকের মধ্যেই ছেলে আবিষ্কার করল যাদের ছাড়া বাবার চলে না, তারাই লাভের গুড় সাবাড়ে দিচ্ছে। অথচ মালিকের সামনে গদগদ। এক দিন সাহস করে বাবার মুখোমুখি হয়ে ছেলে সব কথা খুলে বলল। কী হতে পারে বাবার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া? যা ভাবছেন ঠিক তার উল্টোটাই হয়েছিল। কড়া গলায় বাবা সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, ‘তুমি একটি অপদার্থ। নিজে কিছু করার ক্ষমতা নেই, এখানে কাজ করতে এসে আমার কোম্পানির পুরনো স্টাফদের নামে চুকলি কাটছ, লজ্জা করে না? ক্ষমতা থাকে তো এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১০০ টাকা রোজগার করে দেখাও। কী যে হল পবিত্রর কে জানে। সে-দিনই সে ঠিক করল অনেক হয়েছে আর নয়। এ বার সে এমন কিছু করবে, যাতে বাবার ছায়াও না থাকে। পিতৃদত্ত নাম পদবি একটাও সে আর ব্যবহার করবে না তার নতুন কাজের দুনিয়ায়। শুরু হল নতুন এক লড়াই। আজ পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সে, ওই কারখানাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন নামটাই আজ তার পরিচয়। সে জনপ্রিয় অভিনেতা সাগ্নিক।

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
শুরুটাতে বেশ রোমাঞ্চ ছিল, রোয়িং ক্লাবের হয়ে রোয়িং করতে হত, দু’দশ টাকাও পাওয়া যেত। কিন্তু প্রয়োজনটা বাড়তে থাকায় এক দিন ওই রোমাঞ্চে ইতি টানতেই হল। এ বার শুরু দ্বিতীয় পর্ব। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ‘আপনি আমাদের ক্লাবের সদ্য হন, ভারতের ১৮টা জায়গায় আমাদের ফাইভ স্টার হোটেলে বছরে দু’বার দু’জায়গায় পাবেন তিন দিন দু’রাত থাকার সুযোগ।’ এই ছিল গায়ত্রী মন্ত্র। এমন সময় এক বন্ধু এসে বলল ‘রাত ন’টা থেকে একটা চাকরি আছে, করবি?’ ছুটল ইন্টারভিউতে। সুঠাম শরীর দেখে কর্তৃপক্ষ খুশি। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা রাত ন’টা থেকে হয়ে গেল নাইট ক্লাবের বাউন্সার। অভিজাত হোটেলের ভি আই পি আসনে বসে এ ভাবেই আমাকে নিজের শুরুর কথা বলে যায় অভিনেতা সুদীপ মুখোপাধ্যায়।

গেলাস চাই, গেলাস
আরবেলিয়া গ্রামের পল্টু অভিনয় করার স্বপ্ন নিয়ে চলে আসে কলকাতা। কিন্তু এলেই তো আর কেউ মুখে পাউডার লেপে পাঠ গাইতে দেবে না, তার আগে করেকম্মে খেতে হবে তো। ওল্ড চায়না বাজারের একটা কোম্পানি রোজ ধরিয়ে দিত কয়েকটা কাচের গ্লাস, অফিস দোকান ঘুরে ঘুরে বেচতে হত। ১৫ দিনেই সে চাকরিতে ইতি। ক’টা গ্লাস ভেঙে খানখান, হাতে এল ৪৫০ টাকা। এ বার কাজ জুটল দক্ষিণেশ্বরে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে। যে দিন কাজ থাকবে ১২ ঘণ্টায় মিলবে ৮০ টাকা। কাজ? কখনও ডাক্তারদের সম্মেলনে তাদের তদারকি আবার কখনও গ্রামের জলসায় টিম নিয়ে যেতে বাসের সামনে বসে ড্রাইভারকে রাস্তা দেখানো। কোন ডাক্তারবাবু মুড়ি খাবেন। কে আবার তার সঙ্গে আলুর চপ, সব দায়িত্ব তার। গ্রামেগঞ্জে শিল্পীদের গাইড সে। ফাংশান চলে মঞ্চে আর কালো পর্দার পিছনে বসে চুপ করে ঘণ্টা গোনে পল্টু। ১২ ঘণ্টা পেরোলেই ঘণ্টায় ১০ টাকা এক্সট্রা। প্রোগ্রাম শেষে শিল্পীদের কাউকে মদ, কাউকে মদের সোডা জোগান দেওয়াটাও কাজের অঙ্গ। কেউ টালমাটাল হয়ে গেলে তাকে বাবা বাছা করে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া পর্যন্ত তার ডিউটি থাকত, এটাই নিয়ম। সেই নিয়মের গল্প গড়গড় করে বলে যায় টেলিভিশনে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাওয়া বিশ্বনাথ বসু।

ম্যাজিক ক্যানভাস
উত্তর চব্বিশ পরগনার অলিগলি ছেলেটা চেনে। সে ম্যাজিক দেখায়। সরকারি আপিসের দরকারি প্রজেক্টের অঙ্গ তার ম্যাজিক। শো প্রতি ২০০ টাকা। গ্রামের একে তাকে ধরে তার দাওয়ায় রাত কাটাতে পারলেই দু’দিনে তিনটে শো, হাতে কড়কড়ে ৬০০। বাকি সময়টা ব্যারাকপুরের বাড়িতে বসে হাই তোলা। সে কাজ ফুরোলে নতুন কাজ খোঁজা, কাজও আসে পায়ে সর্ষে নিয়ে। এ বার কাজ ক্যানভাসিং, নিউ দেজ পাবলিশিং-এর হয়ে কমার্সের বই বেচা, এলাকা বর্ধমান আর উত্তরবঙ্গ। এ বার মুঠোয় এল কোচবিহার দিনহাটার আলিগলি। স্কুল কলেজে ঘুরে ঘুরে বাণিজ্যের টোটকা বেচে সে। পরীক্ষা শেষের সময়টায় দম ফেলার ফুরসত নেই, সেটাই যে মরশুম। সস্তার হোটেলে রাত কাটিয়ে সকাল থেকে ছুট আর ছুট। এই জলপাইগুড়ি, এই মাদারিহাট তো পর দিনেই আউশগ্রাম। সেই ছেলেটা আজ অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী।

লিকার চায়ে পাতা
ছেলেটাকে পাড়ার লোকেরা খুব ভালবাসত। বলত, ওর মুখে নাকি মায়া আর প্রশান্তি মাখা আছে। গলির মুখের এক চা-ওয়ালা তার দোকানটা বন্ধ করে দিয়ে চলে যাওয়ায় পাড়ার লোকেরাই ছেলেটাকে বুদ্ধি দিল যে বেকার বসে না থেকে তুই তো এটা চালাতে পারিস। সংসারের ছবিটা ভেসে উঠতেই হ্যাঁ বলে দেয় সে। শুরু হল তার চায়ের দোকান, কিছুই পারে না তাতে ক্ষতি কী, খদ্দেররা নিজেরাই চা করে খায়, উৎসাহ দিতে গোটা পাড়া হাজির সব সময়। দিনে দিনে সে চা বানাতে শিখে গেল, দ্রুত হাতে এঁটো গ্লাস ধো তাতে ক্ষতি কী, খদ্দেররা নিজেরাই চা করে খায়, উৎসাহ দিতে গোটা পাড়া হাজির সব সময়। দিনে দিনে সে চা বানাতে শিখে গেল, দ্রুত হাতে এঁটো গ্লাস ধোওয়াটাও। এখন সে দুটোকে তিনটে করতে পারে, সে জানে লিকার চায়ে কতটা পাতা দিতে হয়, দুধ চায়ে কতটা। দু’এক জন বাকি নিতে শুরু করে, তার মানে ও পারছে। বাড়িতে মা সকাল হলেই একটা বড় ডেকচিতে আলুর দম বসিয়ে দিত, মায়ের তৈরি আলুর দম আর পাঁউরুটির তখন হেব্বি কাটতি। এ বার সঙ্গে যোগ হল পান-বিড়ি-সিগারেট। পান সেজে মুড়ে দিতে শিখে গেল এক দিনেই। প্রিয় ছেলেটা এ ভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় পাড়ার লোক খুব খুশি। কিন্তু সে ছেলেটা সারা দিন গ্লাস ধোয় আর মনে মনে গুমরোয়। এখন ছুটির দিন মানেই সরসুনার সেই চায়ের দোকানে ছেলেটা যাবেই আড্ডা মারতে, যদিও এখন সে আর ‘মায়া প্রশান্তি মাখা ছেলেটি’ নয়, সে ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত নাম শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়।

ধুপ নেবেন ধুপ
রতন দে সরকার স্ট্রিট, এলাকা জুড়ে পুজো পুজো গন্ধ, ফুটপাথে সাজানো আছে নানা নামের ধুপের প্যাকেট। এখানেই ঘুরে বেড়ায় একটা ছেলে, বাংলা হিন্দি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় সে দোকানদারদের সঙ্গে দরদাম করে, মালমশলা যতটা সস্তায় কেনা যায় আর কী! তার পর বাড়ি ফিরে বসে যায় মণ্ড মাখতে, গন্ধ মেশায়, কাঠির গায়ে আলতো হাতে তৈরি মশলার প্রলেপ পড়ে। খবরের কাগজে পেতে বারান্দায় শুকোতে দেওয়া হয়। তার পর প্যাকেজিং। গোলাপ-বকুল-চন্দন-চামেলি প্যাকেটে যা-ই লেখা থাক সে ওই একই ধুপ চালান করে, কোথাও দশ কাঠি, কোথাও বিশ। এর পর কলেজবেলায় বোলপুর ঘুরতে গিয়ে কেনা কবিগুরুর ছবি সাঁটা ঝোলা ব্যাগে সেই প্যাকেট ভরে এক গ্লাস ছাতুর শরবত খেয়ে সকালবেলায় পথে নামা। ‘ধুপ নেবেন ধুপ...’ উত্তর-দক্ষিণের অলিগলি পেরিয়ে সে ঘুরেবেড়ায়, লাল সুতো বিড়ি আর টিউবওয়েলের জল এটাই সারা দিনের টিফিন। জোর গলায় মিথ্যে বলার বিদ্যেটাও দু’দিনে রপ্ত হয়ে গেল, একই ধুপ দুটো আলাদা প্যাকেটে, তবু সবার সামনে জ্বালিয়ে সে প্রমাণ করে দেয় দুটো গন্ধ আলাদা, কোনও কোনও দিন মুনাফা ১০০ ছুঁয়ে গেলে আনোয়ার শাহ মোড়ের ১৮ টাকার বড় বিরিয়ানি আর হরিগোপালের বোতল। এমন দিন আসত কদাচিৎ, দু’মাসে এক বার। বাকি রাত ভাত-ডাল আর খুব বেশি হলে সিলভার কার্প মাছের একটা ক্যারম স্ট্রাইকারের মতো পিস। এ গল্প যার সে এখন মেগাটেগা লেখে, ঠান্ডা গাড়িতে ঘোরে, লোকে বলে হাস্যরসও নাকি তার কলমে হাসে। এ গল্প আমার, তাই ‘আরও এক ডজন’ আমি আর কোনও দিন লিখব না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.