শনিবারের নিবন্ধ
প্রেমিক
বন্ধু
০ বছরে সম্পর্কের সমীকরণ কতটা বদলে যেতে পারে? বন্ধু বা বান্ধবীর সঙ্গে প্রেমের ‘দ্য এন্ড’ হয়ে গেল মানে তার সঙ্গে আর কোনও দিন কথা বললেন না, কোনও দিন তার মুখ দেখলেন না এই বিলাসিতা হয়তো আগের প্রজন্মের হাতের নাগালে ছিল। ফেসবুক, টুইটারের দৌলতে ক্রমশ ছোট হতে থাকা পৃথিবীতে এটা ‘মুশকিল হি নেহি, নামুমকিন হ্যায়’। চান বা না চান, পুরনো সঙ্গী বা তার বন্ধুবান্ধব-পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কোথাও না কোথাও দেখা হয়েই যাবে। অফিস কলিগের সঙ্গে প্রেম না-ই টিকতে পারে। তাই বলে সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে চাকরিটার পাটও কি চুকিয়ে দেওয়া যায় নাকি? কেরিয়ার আগে না আবেগ? আবার স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হল না বলে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কটাও নষ্ট করে ফেলবেন? কোনও মানে হয় শুধু শুধু শত্রু বাড়ানোর?
এই প্রজন্মের দশ জনের মধ্যে ন’জনই বলছেন, কক্ষনও না। প্রেম বা বিয়েটাই শেষ কথা নয়। কেজো, কেঠো, আপস করে নেওয়া সম্পর্কের যুগে এক জন সত্যিকারের বন্ধু বা মন থেকে ভাল চায় এমন এক জন ‘ওয়েল উইশার’ অনেক বেশি জরুরি। একটা সুন্দর সম্পর্কের দামও তো এখন আকাশছোঁয়া। হোক না সেই সম্পর্ক আপনার প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে। বা যে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয় না, তার মা-বাবার সঙ্গে। পঁচিশ বছরের আনন্দরূপ যেমন বলছেন, “স্কুলে অদিতির সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছি। তার পর নানা কারণে সম্পর্কটা ভেঙে যায়। কয়েক বছর ওর সঙ্গে কথা হয়নি।” তার পর কলেজের একটা ফাংশনে হঠাৎ দেখা। এবং শুরু সম্পর্কের দ্বিতীয় ইনিংস। “এখন আমরা খুব ভাল বন্ধু। বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে পারেন।” দু’জনেই এখন অন্য সম্পর্কে আছি, কিন্তু বন্ধুত্বটা টিকে গিয়েছে। “আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া হলে অদিতিকেই সব চেয়ে আগে ফোন করি। ওর কাছ থেকে টিপ্স নিই। কী করলে গার্লফ্রেন্ডের রাগ কমবে, ওকে কী উপহার দেওয়া উচিত, কী বলা উচিত সব কথা খোলাখুলি বলতে পারি।”
সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ালি সুরের মতে, “আগে আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো অনেক বেশি দৃঢ় ছিল। পারিবারিক বা সামাজিক প্রত্যাশার চাপে ভাঙন-ধরা সম্পর্কও টিকিয়ে রাখতে হত। কোনও ভাবে সেই সম্পর্কটা পুরোপুরি ভেঙে গেলে বাড়ির ভেতরে বা বাইরে এত বেশি তিক্ততা তৈরি হত যে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে নতুন করে মেশা আর সম্ভব হত না,” বলছেন তিনি। এখনকার যুগে যে এই ব্যাপারটা একেবারেই খাটে না, সেটা বলে দিতে বিশেষজ্ঞের দরকার লাগে না। “এখন সম্পর্কের সুতোগুলো ছাড়া-ছাড়া। পারিবারিক প্রত্যাশাও খুব বড় ফ্যাক্টর নয়। তাই এখনকার সম্পর্ক এত ভঙ্গুর,” বলছেন পিয়ালি। মনের সামান্য অমিল হলেই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া হচ্ছে এখন। “আর এখনকার সম্পর্কগুলো বেশির ভাগ সময় খুব গভীর হচ্ছে না বলেই হয়তো ব্রেক-আপের পরেও বিশেষ তিক্ততা থাকছে না। প্রাক্তন প্রেমিক বা স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে অসুবিধে বা অস্বস্তি হচ্ছে না।”

১৯৯১: বান্ধবীকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে বসেই অয়নের চোখ পড়ে গেল উল্টো দিকের টেবিলে। মিতালি না? তাঁর কলেজের সময়কার প্রেমিকা। কী অস্বস্তিকর ব্যাপার! মিতালির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার আগেই গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন রেস্তোরাঁ থেকে। আর ডিনার করা যায় নাকি?

২০১১: গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ডিনার করতে এসে খাবার অর্ডার দিয়ে শুভ্রর চোখ চলে গেল পাশের টেবিলে। নতুন সঙ্গী আর এক গ্লাস বিয়ার নিয়ে বসে তার এক্স গার্লফ্রেন্ড রিমি। ভেবলে না গিয়ে শুভ্র স্মার্টলি উঠে গেলেন তাঁদের টেবিলে। আলাপ পর্ব সেরে চার জনে বসে গেলেন একই টেবিলে। একসঙ্গে ডিনার করে বেরোলেন।
১৯৯১: কৌস্তভের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর গোটা বছর কেটে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কমন বন্ধুদের সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে তানিয়ার। এক অফিসে কাজ করতেন বলে অন্য চাকরি খুঁজে নিতে হয়েছে তাঁকে। এখনও কৌস্তভের নাম শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন তানিয়া। একটা ঘরে পাঁচ মিনিট কাটাতে হলেও হাতাহাতি হয়ে যেতে পারে।

২০১১: বছর দেড়েক অফিসে চুটিয়ে প্রেম করার পরে রূপম-প্রিয়ঙ্কা দু’জনেই বুঝতে পেরেছেন, বন্ধু হিসেবে অনেক বেশি শান্তিতে থাকতে পারবেন। প্রেম নেই তো কী হয়েছে? এখনও একসঙ্গে সিনেমা দেখতে চলে যান দু’জন। অফিসের প্রেজেন্টেশন নিয়ে আলোচনা করেন। কমন বন্ধুদের সঙ্গে পাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়াতেও ওঁদের আপত্তি নেই। বয়ফ্রেন্ড নন, রূপম এখন প্রিয়ঙ্কার খুব ভাল বন্ধু। ওঁরা দু’জনেই এই নতুন সম্পর্কে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দও।
১৯৯১: ডিভোর্সের মাসখানেক পর গড়িয়াহাটে শপিং করছেন শ্যামলী। একটা দোকানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল প্রাক্তন স্বামীর মায়ের সঙ্গে। প্রচণ্ড অস্বস্তি, একরাশ খারাপ-লাগা নিয়ে তাড়াতাড়ি মুখ নামিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন শ্যামলী। কেনাকাটা করার মজাটাই উবে গেল।

২০১১: বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে মাস ছয়েক। আর কোনও যোগাযোগ নেই। কিন্তু মন খারাপ হলে এখনও রিয়া ফোন করেন শাশুড়ি-মাকে। কোনও শপিং মলে দেখা করে প্রাণ খুলে আড্ডা দেন। অস্বস্তি? কীসের অস্বস্তি?

বিয়ের পরেও যেমন প্রাক্তন স্বামীর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন স্মিতা। “খুব কম দিনের আলাপে দেব-এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। একটা বছর যেতে না যেতেই দু’জনে বুঝে গিয়েছিলাম, বিয়েটা টিকবে না।” তা হলে এখন দেবের পরিবারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই? “না না, ডিভোর্সের পরেও কিন্তু দেবের মা আমার বন্ধু। মন খারাপ হলে ওঁকে ফোন করে আড্ডা দিই। দু’জনে সিনেমা দেখতে চলে যাই। ডিভোর্সের সময়ও উনি আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন,” বলছেন স্মিতা।
তা হলে কি ব্রেক-আপের পরের জীবনে অল ইজ ওয়েল? প্রেম বা আত্মীয়তা থেকে খাঁটি বন্ধুত্বের রাস্তাটা কি পুরো মাখন? সব সময় যে তা হয়, এমন নয়। সংখ্যাটা কম হলেও এই দলের কয়েক জনের বক্তব্য, কেরিয়ারের খাতিরে পুরনো প্রেমিকা, স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে কাজ করতে কোনও আপত্তি নেই। কারণ ব্যক্তিগত ইচ্ছের চেয়ে প্রফেশনাল সাফল্যই এঁদের কাছে অনেক বেশি জরুরি। “বস-এর সঙ্গে প্রেম করার সময় অনেকেই আমাকে বাধা দিয়েছিল। তখন ও সব কথায় কান দিইনি,” বলছেন ঐশ্বর্য। তার পর? “ব্রেক-আপের পর এখন বস-এর সঙ্গে কথা বলতে বেশ অস্বস্তি হয়। কিন্তু কেরিয়ারের কথা ভেবে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি। সম্পর্ক ভেঙে যেতেই পারে। তাই বলে এত ভাল চাকরি ছেড়ে দেব নাকি?”

এক্স ফ্যাক্টর
কয়েক পেগ খাওয়ার পর পুরনো প্রেমের জন্য মন হু-হু? ওয়াইন গ্লাস হাতে প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ফোন করার জন্য মন আনচান? কষ্ট পাবেন না। ফোন করুন। তবে মনে রাখবেন, নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারছেন এমন মনে হলেই ফোনটা করা উচিত। আর ফোন করে খুব যদি গোলমাল করে ফেলেন তা হলে খুচরো অনুশোচনায় না ভুগে তাকে পরে এসএমএস করে ‘সরি’ বলুন। সঙ্গে এটাও বলুন, তাকে সত্যি ভালবেসেছিলেন বলেই এখনও ওলট-পালট হয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু এখন আপনি সত্যি চান যে তিনি ভাল থাকুন। তাঁর নতুন জীবন নিয়ে। দেখবেন কোনও ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না। তবে বারবার এমন গোলমাল পাকালে কিন্তু মুশকিল!

পুরনো সম্পর্ক থেকে আপনি হয়তো পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু আপনার এক্স এখনও আপনার জীবনে কামব্যাক করার স্বপ্ন দেখছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে বুঝিয়ে বলুন, তাঁকে বন্ধু হিসেবে পেতে আপনার অনেক বেশি ভাল লাগবে। এ ক্ষেত্রে খোলাখুলি কথার কোনও বিকল্প হতে পারে না।

ব্রেক-আপ হয়ে যাওয়ার পরের দিন থেকেই দু’জনে দু’জনকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। নিজেকে ওঁর জুতোয় গলিয়ে দেখুন। বুঝতে চেষ্টা করুন। দু’জনে চাইলে আস্তে আস্তে সম্পর্কটা সহজ হয়ে যাবে।

অনেক বছর একসঙ্গে কাটানোর পর হঠাৎ একা-একা শপিং করতে গিয়ে বা সিনেমা দেখতে যাওয়ার সঙ্গী খুঁজে না পেলে পুরনো সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার কথা মনে হতেই পারে। তবে মনে রাখবেন, এমনি এমনিই আপনাদের ব্রেক-আপ হয়নি। নতুন করে সম্পর্ক শুরু করতে গেলে সেই একই সমস্যা ঘুরেফিরে আসতে পারে।

প্রাক্তন সঙ্গীর নামে মিথ্যে গুজব রটিয়ে বেড়াবেন না। বা তার সম্পর্কে খুব গোপন কিছু কথা, যা শুধু আপনি জানেন, সেগুলো ফলাও করে বলে পোস্টার ছাপাবেন না। প্রাক্তন সঙ্গী কিন্তু আপনার শত্রু নন। আর সে-ও হয়তো আপনার এমন অনেক গোপন কথাই জানেন। তা হলে?

প্রশ্ন তাঁর।
অর্থাৎ সেই একই কথা। মাধবীলতার মতো প্রেম এখন ব্যাকডেটেড। তার থেকে অনেক বেশি দামি নিজস্বতা, কেরিয়ার, ভাল থাকা এবং বন্ধুত্ব। প্রেম কেটে গেল বা বিয়ে ভেঙে গেল মানে চিরকালের জন্য কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যাবে, বন্ধুত্বের দরজায় তালাচাবি, এমন কোনও মানেই নেই।
‘এক্স-বয়ফ্রেন্ড’ বা ‘এক্স-গার্লফ্রেন্ড’ শব্দগুলো এখনও আছে ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বাইরে আর এই শব্দগুলোরও কোনও মানে নেই। অন্তত ‘জেন এক্স’- এর কাছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.