মৃত্যু বেড়ে ১৪
কয়েক দিন কম জল ছাড়াতেই বিপদের মুখে রাজ্য
বার বার চাপ দিয়ে ডিভিসি-র পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধার থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ গত কয়েক দিন ধরে কমিয়ে রাখার ফলে টইটম্বুর জলাধার দু’টি থেকে এখন অনেক বেশি পরিমাণ জল ছাড়তে হচ্ছে। এর জেরে ভেসে যাচ্ছে নিম্ন দামোদরের বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে কয়েকটি জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ বিপন্ন। অভিযোগ বাড়ছে ত্রাণ নিয়েও।
পরিস্থিতি যে ক্রমশ ঘোরালো হয়েছে, তা বুঝেই শনিবার হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরকে ‘বন্যা কবলিত এলাকা’ বলে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সরকারি হিসেবেই বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ তদারক করতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ দিন কয়েকটি জেলায় যান মন্ত্রীরা। কোথাও কোথাও তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন জলবন্দি মানুষ। রাজ্যের তিন জন সচিবকেও তদারকির কাজে পাঠানো হয়েছে। পড়শি রাজ্য ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডে প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। পাশাপাশি, ভরা কোটালের জন্য দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সরকারের চিন্তা বেড়েছে।
শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটে থেকে ডিভিসি-র জল ছাড়ার পরিমাণ আরও ১০ হাজার কিউসেক বেড়ে যায়। পাঞ্চেত থেকে এক লক্ষ কিউসেক আর মাইথন থেকে ৫ হাজার কিউসেক সব মিলিয়ে ১ লক্ষ ৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া শুরু হয়। রাতেই ওই জল পৌঁছয় দুর্গাপুর ব্যারেজে। সেখান থেকে আবার ১ লক্ষ ৪৭ হাজার কিউসেক জল ছাড়া শুরু হয়। ওই জল নিম্ন দামোদর এলাকায় পৌঁছবে আজ, রবিবার দুপুরের পরে।
উধাও রাস্তা: প্লাবিত জনপদ। শনিবার উদয়নারায়ণপুরের সিংটিতে হিলটন ঘোষের তোলা ছবি।
ডিভিসি সূত্রে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় জল কমিশন এবং ডিভিসি-র ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে রাজ্য সরকার ক্রমাগত চাপ দেওয়ার ফলে জলাধার থেকে যে অবস্থায় যতটা জল ছাড়ার কথা, এত দিন তা ছাড়া হয়নি। যে নির্দেশিকা অনুযায়ী জলাধারের জলস্তর নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তাকে উপেক্ষা করেই জল ছাড়ার পরিমাণ কমিয়ে রাখা হয়েছে গত কয়েক দিন। নির্দেশিকায় বলা আছে, গোটা বর্ষাকালই বন্যার জল ধরে রাখার জন্য জলাধারকে যথা সম্ভব খালি রাখা দরকার। একটা বন্যার জল এসে পড়লেই সেই জল নিয়ন্ত্রণ করেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জলাধার খালি করে দিতে হয়। তবেই পরের বন্যার জল ধরে রাখার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে ডিভিসি। এ বার জলাধার খালি করতে বাধা দেওয়ায় যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আরও বেশি জল জলাধারে এসে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে বলে ডিভিসি-র এক কর্তার অভিযোগ।
ডিভিসি-র মতে, এখন আর জলাধারে জল ধরে রাখার মতো জায়গা প্রায় নেই। ফলে যতটা জল ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ জল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে তারা। যেমন, এ দিন দুপুরে পাঞ্চেতে যখন জল ঢুকছে ৭৫ হাজার কিউসেক, তখন জল ছাড়া হচ্ছে ১ লক্ষ কিউসেক। এ ভাবেই জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়িয়ে জলাধারের জলস্তর ৪২০ ফুটে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ডিভিসি-র ওই কর্তা বলেন, “সোমবার আমরা ৭০ হাজার কিউসেক জল ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজ্যের চাপে জল ছাড়া হয় ৫৫ হাজার কিউসেক। তার পর থেকে প্রতি দিনই নির্দেশিকা উপেক্ষা করে কম হারে জল ছাড়া হচ্ছে। এখন আর জল ধরে রাখার উপায় নেই।”
গত পাঁচ দিনে পাঞ্চেতের জলস্তর ৪০৭ ফুট থেকে বেড়ে ৪২৩ ফুটে উঠে যায়। ইঞ্জিনিয়াররা জানান, জলস্তর অন্তত ৪১৫ ফুটে নামিয়ে রাখতে পারলে এখন এত বেশি জল ছাড়তে হত না। গত সোমবার ৭০ হাজার কিউসেক জল ছাড়লে নিম্ন-দামোদর যতটা প্লাবিত হত, শনিবার ১ লক্ষ ৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়ায় অনেক বেশি এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘটনা হল, জলাধারে খালি জায়গা থাকলে এ দিন ১ লক্ষ ৫ হাজারের পরিবর্তে ৮০ হাজার কিউসেক ছাড়লেই চলত।
জল ছাড়ার পরিমাণ বেড়েছে মুকুটমণিপুরে কংসাবতী জলাধার থেকেও। সেখান থেকে এ দিন ৪০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। এই জলাধারে জলস্তর পূর্ণ ক্ষমতার চেয়ে ৫ ফুট কম রয়েছে। পুরুলিয়ায় প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় কংসাবতী ও কুমারী নদীর জলস্তর বেড়ে গিয়েছে। ফলে সেখান থেকে এ দিন অতিরিক্ত ১৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়তে হয়েছে। বীরভূমে ময়ূরাক্ষীর তিলপাড়া ব্যারেজ সকাল থেকে প্রায় ৪০০০ কিউসেক জল ছেড়েছে।
বিভিন্ন জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়ার পাশপাাশি প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে কোটাল। পূর্ণিমার ভরা কোটালের জেরে দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলিতে জল আরও বাড়ার আশঙ্কা
রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। এর প্রভাবে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বর্ধমানের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। মানসবাবু জানান, পূর্ব মেদিনীপুরের শিউলিপুরে স্লুইস গেট জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে। গ্রামবাসীরাই বালি, মাটি দিয়ে সেখানে জল আটকানোর চেষ্টা করছেন। উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা, গাইঘাটায় বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে রূপনারায়ণের জল। মুর্শিদাবাদের কড়েয়া, সুতি, বহরমপুর, সাগরদিঘি এলাকায় একই অবস্থা ভাগীরথী নদীরও। বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, বসিরহাট, বীরভূমের রামপুর ও নলহাটিতে। নদীবাঁধে ধস দেখা দিয়েছে হুগলির হরিপাল, ডাকাতিয়াখোলায়।
রাজ্যের ১৫টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেবল হাওড়ার উদনারায়ণপুরকেই ‘বন্যা কবলিত এলাকা’ বলে ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এর কারণ ব্যাখ্যা করে মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বলেন, “নদীর জল উপচে এসে যে এলাকাকে ভাসিয়ে দেয়, সেই জায়গাকে সাধারণ ভাবে বন্য কবলিত বলা হয়। এ ক্ষেত্রে মূলত ডিভিসি জলাধার থেকে আসা জল উদনারায়ণপুর এলাকাকে জলমগ্ন করেছে। এ ক্ষেত্রে উদয়নারয়ণপুর এলাকাকে বন্যা কবলিত বলা হচ্ছে।” উদনারায়নপুরে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর এক কোম্পানিকে নামানো হয়েছে। আরও দুই কোম্পানিকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
রাজ্য সরকার মনে করছে, কংসাবতী ব্যারাজ থেকে জল ছাড়ার জেরে পূর্ব মেদিনীপুরও জলমগ্ন হওয়ার আশঙ্কা। এ ব্যাপারে ওই জেলা প্রশাসনকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। গোটা রাজ্যে এ পর্যন্ত ১৬ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মুখ্যসচিব জানান, এ পর্যন্ত ১৪ জন মারা গিয়েছেন। ১১২টি শিবির খোলা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনায় ১০০টি, মালদহে ৫টি, বর্ধমানে ৩টি এবং হাওড়া ও মুর্শিদাবাদে ২টি করে খোলা হয়েছে। ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন ১৪ হাজার মানুষ। জলমগ্ন এলাকায় পানীয় জলের পাউচ সরবরাহ করা হয়েছে। জল পরিশুদ্ধ করার ভ্রাম্যমাণ ইউনিট পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলিতে ৬টি শিবির খোলা হয়েছে। বন্যা কবলিত ৯টি জেলায় ২ লক্ষ ১৫ হাজার ত্রিপল দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ হিসেবে এই জেলাগুলিকে নগদ ৩৭ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.