সুশান্তর পাশে বুদ্ধ, বোঝালেন শেষ কথা দলই
কেই বলে ‘পার্টিতন্ত্র’।
নিজের রাজনৈতিক জীবনে সুশান্ত ঘোষদের ‘মারদাঙ্গার রাজনীতির’ ঘোরতর বিরোধিতা করে এসেছেন তিনি। আজ সেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুশান্ত-গ্রেফতারের প্রতিবাদে দলের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে প্রকাশ্যে সরব হলেন। বিজেপি-তে অরুণ জেটলি-সুষমা স্বরাজ বা তৃণমূলে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়-নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ববি হাকিমের ‘পারস্পরিক সম্পর্ক’ নিয়ে যে জনশ্রুতি তার চেয়ে অনেক বেশি দূরত্ব ছিল বুদ্ধ-সুশান্তের।
কিন্তু শেষ কথা বলবে পার্টিই! ভোটে শোচনীয় হারের পর সুশান্তবাবু এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের রাজনৈতিক লাইনই সিপিএমে আপাতত ‘ডমিন্যান্ট’ পার্টি লাইন। যে কারণে সুশান্তবাবুর গ্রেফতারের প্রসঙ্গ টেনে বুদ্ধবাবুকে আজ কলকাতায় বলতে হয়েছে, “সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে! দশ বছর আগে কী ঘটে গিয়েছে, তার জন্য সুশান্ত ঘোষকে গ্রেফতার করতে হবে! আসল কথা হল, প্রতিহিংসা নাও!” রাজ্য সরকারের প্রতি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, “আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নেওয়া বন্ধ করে জঙ্গলমহলে নতুন করে মাথাচাড়া-দেওয়া মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। না হলে রাজ্যের বিপদ বাড়বে।”
কলকাতার সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে ফেরার পথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুক্রবার। পি টি আই
তাঁরা হেরে গেলেও মাথা নিচু করে ‘অন্যায়’ মেনে নেবেন না বলে জানান বুদ্ধবাবু। দলের কর্মীদের বলেছেন, এখন ‘কঠিন সময়’। তাঁর কথায়, “আমরা পরাজিত হয়েছি। কিন্তু মাথা নিচু করে অন্যায়-অত্যাচার মেনে নেব না। প্রতিহিংসা, খুন-খারাপি বন্ধ না-হলে আমাদের পথ আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে।”
দলের প্রবীণ নেতা শ্যামল চক্রবর্তী তাঁর লেখা ‘৬০-৭০ ছাত্র আন্দোলন’ শীর্ষক গ্রন্থে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, বিদ্যাসাগর কলেজে যখন তাঁকে পার্টি সদস্য করা হয়, তখনও তাঁর বয়স ১৮ হয়নি। কিন্তু পার্টির দাদারা বললেন, তাঁকে পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হবে। শ্যামলবাবু বলেছিলেন, পার্টির সংবিধান বলছে, ১৮ বছর না-হলে পার্টি সদস্য হওয়া যায় না। পার্টির নেতা অমিয়শঙ্কর রায় পরিহাসের সঙ্গে তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার বয়স তুমি ঠিক করবে না। ওটা পার্টি ঠিক করে দেবে। সুতরাং এখন তোমার বয়স ১৮।” সে দিন পার্টি অফিসে হাসির হুল্লোড় উঠেছিল।
কিন্তু আজ প্রকাশ্যে বুদ্ধবাবুর আচরণ দেখে তাঁরই ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জনান্তিকে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘পার্টিতন্ত্রে’র জাঁতাকলে পড়ে কি বুদ্ধবাবু তাঁর ‘নতুন সিপিএম’ গড়ার এত দিনের রণে ভঙ্গ দিলেন? প্রশ্ন উঠেছে, মানব মুখোপাধ্যায় থেকে অশোক ভট্টাচার্য, এমনকী, নিরুপম সেনের মতো নেতারা কি দলের এই অবস্থানে খুশি?
পার্টির পলিটব্যুরোর এক সদস্যের অবশ্য দাবি, “বুদ্ধবাবুও নিজে খুশি নন! কিন্তু এটাই রূঢ় বাস্তবতা। হারের পর জেলায় জেলায় যখন সিপিএম কর্মীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, তাঁরা বহু জেলায় মার খাচ্ছেন, তখন পার্টি নেতৃত্ব সুশান্তবাবুকে ‘সমর্থন’ না-করলে দলের নিচুতলার ক্ষোভ বাড়বে।” ওই নেতার ব্যাখ্যায়, সে কারণেই দল সিদ্ধান্ত নেয়, অন্য কেউ নয়, এই কাজ করতে হবে দলের ‘প্রধান কাণ্ডারী’ তথা দলের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবয়ব’ বুদ্ধদেবকেই!
দল দুর্বল হলে পার্র্টিকেন্দ্রও দুর্বল হয়। সিপিএমের পরিভাষায়, ‘ফেডারেলিজমের ঝোঁক’ বাড়ে। অতীতে সালকিয়া প্লেনামের রিপোর্ট থেকে সল্টলেকের দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসের সাংগঠনিক রিপোর্ট পর্যন্ত সর্বত্রই ওই ঝোঁকের ‘প্রবণতা’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। ৩৪ বছর পর ভোটে হেরে যাওয়ায় সেই ‘প্রবণতা’ আরও ভয়াবহ ভাবে বেড়ে গিয়েছে। গণতান্ত্রিক-কেন্দ্রিকতার নীতি ‘বিপন্ন’ হতে বসেছে। পার্টি সূত্র বলছে, সুশান্তবাবুর পর এ বার পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যতম ‘প্রভাবশালী’ নেতা দীপক সরকারকেও গ্রেফতার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাতে পার্টির নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা নেমে আসতে পারে। তাদের তৃণমূলে যাওয়ার ঝোঁক বাড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব সুশান্তবাবুর পাশে জোরগলায় না দাঁড়ালে জেলা স্তরে অন্তত দল ধরে রাখা সম্ভব হবে।
দলের নেতাদের একাংশের আরও বক্তব্য, এই ঘটনার পরেও সুশান্তবাবুর পাশে না-দাঁড়ালে তিনি বা দীপকবাবু প্রকাশ্যে বুদ্ধবাবু, বিমান বসু তথা রাজ্য নেতৃত্ব সম্পর্কে আরও ‘আক্রমণাত্মক’ হতে পারতেন। এমনিতেই রেজ্জাক মোল্লাকে নিয়ে ক্রমাগত বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দলকে। একই সময়ে সুশান্ত-দীপক ‘ক্ষুণ্ণ’ হলে সেই বিড়ম্বনা আরও বৃদ্ধি পেত। রেজ্জাক সম্প্রতি ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, তিনি চুপ করে আছেন। কিন্তু দলের অন্দরে ‘বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের’ বিরুদ্ধে লড়াই চালানোটাই এখন তাঁর প্রধান কাজ। ফলে সুশান্তবাবুকে সমর্থন করে দলের অন্দরে বুদ্ধ-বিমান বিরোধী ক্ষোভকেও কিছুটা ‘প্রশমিত’ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে আলিমুদ্দিন।
সমস্যা হচ্ছে আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে যখন ‘নতুন সিপিএম খোঁজা’র কাজকেই অন্যতম কর্মসূচি করা হচ্ছে, যখন হায়দরাবাদে কেন্দ্রীয় কমিটির গত বৈঠকে স্তালিনীয় গণতান্ত্রিক নীতি সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠছে, দলের বহু নেতা সাম্প্রতিক কমিউনিস্ট পার্টির মহা অধিবেশনে হু জিনতাওয়ের বক্তৃতায় ‘উদ্বুদ্ধ’ হয়ে পার্টির ‘ঊর্দ্ধমুখী সংস্কারে’র কথা ভাবছেন, তখন প্রকাশ্যে সুশান্তবাবুকে সমর্থন কি দলকে আরও বড় এক মতাদর্শগত বিতর্কের দিকে ঠেলে দিল না?
সুশান্ত-বিরোধী নেতারা এখনও বলছেন, ২০০৬ সালে তিনি পূর্ব গড়বেতায় ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বারে তিনি পেয়েছেন ৫২ শতাংশ ভোট। ফলে সিপিএমের ভোট পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ৯ শতাংশ কমলেও সুশান্তবাবুর ভোট কমেছে তার দ্বিগুণ ৮ শতাংশ। এ হেন সুশান্তবাবুকে সমর্থন দেওয়ার প্রয়োজনই বা কী? কিন্তু ঘটনাচক্রে, রথের রশি এখন অনেক বেশি জেলার নেতাদের হাতেই। তাঁরা বলছেন, ভোটের আগে শুধু দুই মেদিনীপুর নয়, বর্ধমানে নিয়ে গিয়েও সুশান্তবাবুকে সভা করানো হয়েছে। দলের স্বার্থে বুদ্ধবাবুর কেন্দ্রেও তাঁকে প্রচারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভোটের আগে যাঁর ‘জনপ্রিয়তাকে’ দল ব্যবহার করেছে, তাঁর ‘লড়াকু’ ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়েছে, তখন পরাজয়ের পর তার অন্যথা হয় কী করে? বিশেষত, যখন আগামী ২১ তারিখ কলকাতায় বর্ধিত রাজ্য কমিটির বৈঠক। গত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও যেখানে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অধিকাংশ নেতারই সুর ঝাঁঝালো ছিল, সেখানে ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী?
দলের একাংশের মতে, এ হল ‘স্বল্পমেয়াদি’ আর ‘দীর্ঘমেয়াদি’ লক্ষ্যের সংঘাত। এক নেতার কথায়, “অরুণ জেটলি যতই উন্নয়ন নিয়ে বক্তৃতা দিন। উমা ভারতী বা প্রবীণ তোগাড়িয়া যে-ই মঞ্চে এসে ‘জয় শ্রীরাম’ বলেন, তখন বিজেপি সমর্থকরা শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তাই নতুন দল গড়ার জন্য বুদ্ধবাবু যতই উন্নয়নমুখী উদার মতবাদের কথা বলুন, আপাতত স্বল্পমেয়াদী জনপ্রিয় দাবিকে অগ্রাহ্য করা প্রকাশ কারাট থেকে বিমান বসু কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।”
পার্টির নির্দেশে এবং প্রয়াত জ্যোতি বসুর সমর্থনে সুশান্তবাবু যখন পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন দীর্ঘদিন তাঁর ঘরে যথেষ্ট চেয়ারটেবিল পর্যন্ত ছিল না! মন্ত্রিসভার বৈঠকে বুদ্ধবাবুর সঙ্গেও কার্যত তাঁর কোনও কথাই হত না। কিন্তু ৩৪ বছরের বামদুর্গ পতনের পর যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে দলের কর্মীদের, তখন সেই সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ করা হচ্ছে বলে বুদ্ধই প্রকাশ্যে সরব ! ধন্য ‘পার্টিতন্ত্র’।

(তথ্য সহায়তা: প্রসূন আচার্য)
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
কখনও রুষ্ট, কখনও করছেন পাল্টা প্রশ্ন


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.