যায় যদি দিন...
আরশিনগর
ন্দননগর থেকে ট্রেনে হাওড়া আসছিলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী সুবল নস্কর। লিলুয়া ছাড়ার পরে বামনগাছি কারশেডের কাছে প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেনে বসে থাকার পরে বিরক্ত হয়ে নেমে পড়লেন লাইনে। শুধু সুবলবাবুই নন। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছনোর জন্য রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করেন অনেক যাত্রীই। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে দক্ষিণ-পূর্ব শাখার টিকিয়াপাড়া কারশেডে জল জমে একই বিপত্তির ছবি উঠে এসেছে।
এটা হাওড়ার রেল-যন্ত্রণার ছবি। অন্য দিকে, হাওড়া শহরের অলিগলি থেকে বড় রাস্তা, সর্বত্রই টানা কয়েক দিন জলমগ্ন থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। কোথাও এক কোমর জল তো কোথাও এক হাঁটু। জলমগ্ন শহরে যানবাহন চলাচলও কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে। পানীয় জলের কলও ডুবে যায় নোংরা জলের তলায়। বসতবাড়ি, হাসপাতাল থেকে স্কুল চত্বর, সর্বত্রই ছবিটা একই। বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য হাওড়ার বাসিন্দাদের জল জমার কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
তবে হাওড়া শহরের এই ছবি নতুন কিছু নয়। উল্টে প্রতি বছরই রেললাইন থেকে পুর এলাকা, সর্বত্র জল জমার সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ফি বছর বর্ষায় হাওড়া শহরের জল-যন্ত্রণার ছবিটা এতটুকুও বদলায় না কেন?
প্রতি বছরের মতো এ বারেও রেল ও পুরসভা জল জমা নিয়ে একে অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। রেলের লাইনে ও কারশেডে জল জমার জন্য হাওড়া পুরসভার বেহাল নিকাশি ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন রেল কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি, হাওড়া পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, রেলের জল পুর এলাকায় ঢুকে সমস্যা বাড়ছে। এমনকী, রেল তাদের দায়িত্বে থাকা ঝিল ও নিকাশি নালা নিয়মিত সংস্কার না করার জন্যই এই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। দুই দফতরের এই চাপানউতোরের ফলে প্রতি বছরই পচা নোংরা জমা জলে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন হাওড়াবাসী।
হাওড়া শহরে জমা জল না সরার বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে সর্বপ্রথম রেলের ‘উদাসীনতা’কেই দায়ী করেছেন হাওড়ার মেয়র মমতা জয়সোয়াল। তিনি বলেন, “রেললাইন ও কারশেড থেকে জমা জল ওরা পাম্প করে আমাদের এলাকায় ফেলছে। তাই জমা জলের সমস্যা আরও বাড়ছে।” যদিও হাওড়ার ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) পার্থসারথি মণ্ডল পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, “পুরসভার বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার জন্যই এই অবস্থা। পাম্প করে জল ফেলা হলেও তা ফের রেলের এলাকাতেই ঢুকে যাচ্ছে।”
পুরসভার তরফে রেলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রথমত: টিকিয়াপাড়া ও বামনগাছি কারশেড ও রেললাইনে জমা জল রেলের নিকাশি নালা দিয়ে বেরিয়ে পুরসভার নিকাশি নালায় মিশেছে। কিন্তু রেলের লাইনের নীচের নিকাশি নালাগুলি নিয়মিত সংস্কার না করায় জল জমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত: রেললাইনের নীচে যে নিকাশি নালাগুলি রয়েছে তা অত্যন্ত সরু। প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে জল বেরোতে পারে না। রেলের তরফে সেই নালাগুলি চওড়া করা হয়নি। ফলে জল উপচে রেললাইন ভেসে যায়। আবার জমা জল বের করার জন্য তাঁরা পাম্প করে পুর এলাকার মধ্যেই জল ফেলেন। তৃতীয়ত: টিকিয়াপাড়া ও বামনগাছি রেল ইয়ার্ডের আবর্জনা ও লুব্রিক্যান্ট প্রতিনিয়ত রানি ঝিলের জলে মিশছে। পলি ও কচুরিপানায় ঝিলটি ভর্তি হয়ে গিয়েছে। ঝিলটি সংস্কারের দায়িত্ব রেলের থাকলেও তারা নিয়মিত কাজটি করে না। ফলে ওই ঝিলের জলধারণ ক্ষমতা কমেছে। পুর এলাকার জলও ওই ঝিলে জমতে না পারায় ভাসছে উত্তর হাওড়া।
রেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য কারশেড, রেললাইনে জল জমার জন্য পুরসভার ‘ভেঙে পড়া’ নিকাশি ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। পার্থসারথিবাবু বলেন, “রানি ঝিল সংস্কারের কাজ রেল ও রাজ্য সরকারের যৌথ ভাবে করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। এ ছাড়াও পচা খাল-সহ বেশ কয়েকটি খালও সংস্কারই হয়নি। সে জন্যই বার বার এই সমস্যা হচ্ছে।”
মধ্য হাওড়ার টিকিয়াপাড়া, বেলিলিয়াস রোড, ইস্ট ওয়েস্ট বাইপাস-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জল জমার বিষয়ে পুরসভার ইঞ্জিনিয়াররা জানাচ্ছেন, টিকিয়াপাড়া কারশেডের জমা জল নোনা পাড়া দিয়ে বেরিয়ে পচা খালে পড়ে। কিন্তু রেলের তরফে দীর্ঘ দিন কারশেডের নালাগুলি সংস্কার করা হয়নি। তাই টিকিয়াপাড়া কারশেডে ফি বছর জল জমে। সেই জলই আবার এলাকায় ঢুকে যায়। আবার টিকিয়াপাড়া থেকে শুরু হয়ে সিঙ্গল ও ডাবল ব্যারেলের মাধ্যমে মধ্য হাওড়ার কিছু এলাকার জমা জল কোনা এক্সপ্রেসওয়ের কাছে রেলের ৬ নম্বর কালভার্ট হয়ে পদ্মপুকুর জলায় পড়ে। সেখানেও রয়েছে সমস্যা। সেচ দফতরের দায়িত্বে থাকা সেই জলা দীর্ঘ দিন সংস্কারই করা হয়নি। ফলে তারও জলধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে।
পাশাপাশি, হাওড়া শহরের ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্কের জলের লাইন ও বৃষ্টির জমা জল বের হওয়ার লাইন এক সঙ্গে মিশে গিয়েছে। ফলে ইছাপুর পাম্পিং স্টেশনও বেশি জল টানতে পারছে না। এ ছাড়াও নিকাশি নালার মধ্যে যথেচ্ছ প্লাস্টিক ফেলার ফলে অধিকাংশ জায়গাতেই নিকাশি ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
মেয়র মমতা জয়সোয়াল বলেন, “পাম্প চালিয়েও খুব বেশি জমা জল সরানো যাচ্ছে না। কেননা, সেই জল কোথাও ফেলার জায়গা নেই। গঙ্গার জলস্তর উঁচু হওয়ায় সেখানে ফেললে ফের এলাকাতেই ঢুকে যাচ্ছে। এক এলাকার জল নামাতে গিয়ে অন্য এলাকা ডুবে যাচ্ছে। তবে রেল যদি নিজেদের কাজটি ঠিকমতো করত তবে সমস্যা অনেক কমে যেত।”

ছবি রণজিৎ নন্দী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.