আপনার কলমে...
১৭ আষাঢ় ১৪১৯ রবিবার ১ জুলাই ২০১২


অবিস্মরণীয় কানাডিয়ান রকিজ
রন্টোতে থাকাকালীন ওখানকার বেদান্ত সোসাইটিতে প্রায়ই যাওয়া হত। সন্ধ্যারতির পরে মহারাজের সঙ্গে একটু কথা বলে বাড়ি ফিরতাম। সেই রকম এক দিন কথায় কথায় মহারাজ কৃপাময়ানন্দজি বললেন, “কানাডাতে আছেন আর ‘কানাডিয়ান রকিজ’ দেখবেন না?” উত্তর আমেরিকার রকি মাউন্টেনের একটা অংশ কানাডার আলবার্টা থেকে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মধ্যে পড়েছে। সেটাই কানাডিয়ান রকিজ নামে খ্যাত। ভাগ্যক্রমে এসে গেল সুযোগ। হাতে পেলাম কানাডিয়ান এয়ার লাইন্সের একটা প্যাকেজ ট্যুর। বেশ সস্তায় দু’জনের টরন্টো থেকে ক্যালগারি যাওয়া আসার প্লেন ভাড়া এবং তিন রাত ব্যানফ-এ হোটেলে থাকা। ক্যালগারি থেকে ব্যানফ এবং তার আশপাশে ঘোরার জন্য অবশ্য নিজেদের গাড়ি ভাড়া করতে হবে।

মে মাসের এক সকালে আমি ও আমার স্বামী সন্দীপ, আড়াই ঘণ্টার উড়ানে ক্যালগারি এয়ারপোর্টে এসে নামলাম। আমাদের পুরনো বন্ধু রবিন ও ডলি-কে আগেই খবর দেওয়া ছিল। পরিকল্পনামাফিক ‘হার্টজ— রেন্ট এ কার’ থেকে একটা প্রায় নতুন গাড়ি চার দিনের জন্যে ভাড়া নিয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যেই পৌঁছলাম রবিনের বাড়ি। রবিন, ডলি আর ওদের দুই মেয়েকে দেখে অনেক পুরনো কথা নতুন করে মনে পড়ে গেল।


হোটেল ব্যানফ
খাওয়া দাওয়া গল্পগুজবে সময়টা কাটল ভালই। রবিনের কাছ থেকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে বিকেলে হাইওয়ে ধরলাম ১২৮ কিলোমিটার দূরের ব্যানফের উদ্দেশে। গাড়ি চলছে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে। দূরে এক দিকে পাহাড়ের সারি আর অন্য দিকে সবুজ সমতলভূমি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই এসে গেল ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের গেট। ওখানে প্রবেশ মূল্য দিয়ে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম ‘হোটেল ব্যানফ’-এ। হোটেলটা বেশ সুন্দর। পেছনে জঙ্গল, সামনে কাঠের ডেক আর পাশে একটা সুইমিংপুল। বেশ কয়েকজন জলে গা ডুবিয়ে বসে আছে। বুঝলাম, জল নিশ্চয়ই গরম।

সন্ধে হতে তখনও দেরি। জিনিসপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম পায়ে হেঁটে, আশপাশটা একটু দেখতে। ক্যালগারিতে একটু গরম ছিল, ব্যানফ সেই তুলনায় বেশ ঠান্ডা। পাহাড়ের চুড়ো তখনও বরফে ঢাকা। শহরটার চারপাশে পাহাড় আর জঙ্গল, লোক সংখ্যা প্রায় আট হাজারের মতো। হোটেলের সামনে একটা দোকান, এখানে রেডিমেড খাবার থেকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসই সহজলভ্য।

ঠিক ছিল একটা দিন আমরা ব্যানফে ঘুরব ও লেক লুইস দেখব। সেই মতো পরের দিন সকালে জলখাবার খেয়ে মেঘলা আকাশ ও ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় করে বেরোলাম লেকের পথে। লেক লুইস যাওয়ার দু’টি রাস্তা, আমরা নিলাম ‘বো ভ্যালি পার্কওয়ে’— যার দু’ধারে ঘন জঙ্গল। এই পথে রাত ন’টা থেকে ভোর ছ’টা পর্যন্ত গাড়ি চালানোর উপর ‘স্বেচ্ছা নিষেধ’, জঙ্গলের জীবজন্তুদের যাতায়াতে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়। রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। গ্রীষ্মের পর্যটক এখনও আসা শুরু করে়নি। চারিদিক খুব শান্ত। জঙ্গলের মধ্যে চোখ, যদি কোনও জন্তু দেখা যায় এই আশায়!
বরফের চাদরের নীচে লেক লুইস এক জোড়া মুজ
কিছু ক্ষণের মধ্যে এসে পড়লাম লেক লুইসে। পাহাড়ের কোলে, বরফের চাদরের নীচে সে তখনও ঘুমিয়ে। মেঘ ও কুয়াশায় ঘিরে থাকায় হয়ে উঠেছে আরও স্বপ্নময়ী। কয়েক জন পর্যটক এ দিক ও দিক ঘোরাফেরা করছে ক্যামেরা হাতে, যদি সূর্যদেবের কৃপা হয়! আমরাও কয়েকটা ছবি তুলে ফিরে এলাম জঙ্গলের রাস্তা ধরেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। একটা মোড় ঘুরতেই দেখি এক জোড়া হরিণ (মুজ) একমনে ঘাস খাচ্ছে।


সালফার পাহাড় থেকে ব্যানফ
শহরের দিকে না গিয়ে আমরা চলে এলাম সালফার পাহাড়ে— যেখানে রয়েছে একটা উষ্ণ প্রস্রবণ। পাহাড়ের গা দিয়ে সর্পিল পথে গাড়ি উঠে এল বেশ খানিকটা উঁচুতে একটা চওড়া জায়গায়। এখান থেকে ব্যানফের দৃশ্য খুবই সুন্দর দেখা যায়। আর একটু উপরে উঠতেই দেখলাম, পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ধোঁয়া ওঠা গরম জলের ধারা, আর তা এসে জমছে একটা চৌবাচ্চার মতো জায়গায়। জলে হাত না দিয়ে থাকতে পারলাম না!

বেলা প্রায় দুটো। এ বার পেটে কিছু দেওয়া দরকার। রাস্তায় নেমে এলাম খাবারের খোঁজে। একটা শপিং মল দেখে ঢুকে পড়লাম। হাওয়ায় নানা ধরনের খাবারের গন্ধ। এখানে একটা চমৎকার ফুড কোর্ট রয়েছে এবং সেখানে লোকজনের বেশ ভিড়। সারাদিন ঘুরে আর খাবারের গন্ধে খিদেও চনমনিয়ে উঠেছে। বসে পড়লাম একটা দোকানের সামনে।

এর পর খানিকটা গাড়িতে, কিছুটা অলস পায়ে ঘুরে বেড়ালাম ব্যানফ শহরটা। রাস্তার নামগুলো খুব মজার— মুজ স্ট্রিট, এল্ক্ স্ট্রিট, উলফ স্ট্রিট, ক্যারিবু স্ট্রিট, অটার স্ট্রিট, বিভার স্ট্রিট। কয়েকটা বড় এল্ক্ দেখি একটা বাড়ির ডাস্টবিনের আশপাশে ঘুরছে। দেখতে হরিণের মতোই। এই রকম কিছু হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে ফিরে এলাম।

পর দিন খুব ভোরে উঠে বেরিয়ে পরলাম জেসপারের পথে। আকাশ আজ অনেকটা পরিষ্কার। যাওয়া আসায় প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার রাস্তা। ফেরা সেই দিনই। আমাদের ইচ্ছে ছিল দুপুরের মধ্যেই জেসপার পৌঁছনো। রকিজের বিশেষ আকর্ষণ এই পথ, কেন না এখানে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান, যার মধ্যে কলম্বিয়া আইসফিল্ড (অ্যাথাবাসকা গ্লেসিয়ার) আর অ্যাথাবাসকা ফলস অন্যতম।

আমরা চলেছি হাইওয়ে নম্বর ৯৩ ধরে, যার অন্য নাম ‘আইস-ফিল্ড পার্কওয়ে’। বিখ্যাত ট্র্যান্স ক্যানাডিয়ান রেলপথ কখনও আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে, কখনও বা অদৃশ্য হচ্ছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে। রাস্তাটা এমন ভাবে তৈরি যে খুব ধীরে ধীরে উঠে আসে প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতায়। দূরের বরফ-ঢাকা পাহাড়গুলো ক্রমশ কাছে আসতে আসতে একেবারে হাইওয়ের ধারে এসে পড়ল। প্রত্যেকটা মোড় ঘুরলেই অতুলনীয় সব দৃশ্য। কোথাও কোথাও বরফগলা জল পাহাড়ের গা দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তায় নেমে আসছে।

জায়গায় জায়গায় গাড়ি দাঁড় করানোর ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে পর্যটকরা এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো ক্যামেরা-বন্দি করতে পারে। পথের ধারে রয়েছে ‘সার্ভিস এরিয়া’। কিন্তু বেশির ভাগ তখনও বন্ধ। আমরা খোলা পেলাম একটা গ্যাস স্টেশন এবং তার সঙ্গে একটা ক্যাফেটেরিয়া। কফি খেতে খেতে দেখতে পেলাম কিছু যাত্রী নিয়ে একটা ট্যুরিস্ট বাস এসে দাঁড়াল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই আবার আমরা হাইওয়েতে উঠে এলাম। কিছুটা যাওয়ার পর একটা জায়গায়, যেখানে পাহাড় ঢালু হয়ে পথের ধারে নেমে এসেছে, দেখি কয়েকটা বড় শিংওয়ালা পাহাড়ি ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাড়ি বেশ জোরে চলছিল তাই ওদের ছবি তোলা গেল না।

দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়লাম অ্যাথাবাসকা হিমবাহের কাছে। হাইওয়ের বাঁ দিকে বরফে ঢাকা প্রান্তর আর ডান দিকে বড় একটা চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল চওড়া টায়ারওয়ালা বাস। এই বাসে করেই পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয় হিমবাহ দেখাতে। কোথাও জনমানব নেই। তবুও যদি কেউ থাকে এবং হিমবাহ দেখার কোনও ব্যবস্থা হয়, এই ভেবে আমরা এগিয়ে গেলাম অফিস ঘরের দিকে। কিন্তু সেটা তালাবন্ধ রয়েছে। যাই হোক, ওখানে গাড়ি রেখে রাস্তা পার হয়ে গ্লেসিয়ারের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট নোটিশ রয়েছে যে উপযুক্ত পোশাক ও আইস বুট ছাড়া পায়ে হেঁটে গ্লেসিয়ারের উপর যাওয়া নিষেধ। কাজেই বেশি এগোতে সাহস হল না। দূর থেকেই দেখলাম কয়েকটা বরফের চাঙড় ভেঙে পড়ছে। গ্লেসিয়ারের শুধু আভাস পেয়েই তৃপ্ত হতে হল এ যাত্রায়। প্রখর সূর্যের আলো বরফের উপর থেকে ঠিকরে আসছে যেন! চারিদিকে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য!

আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল অ্যাথাবাসকা ফলস্। এখান থেকে জেসপার মাত্র তিরিশ-চল্লিশ কিলোমি
টার। এখানে বেশ কিছু লোকজন এবং গাড়ির দেখা পেলাম। কিছু ক্ষণ জায়গাটা ঘুরে দেখলাম। ঘন বনের মধ্য দিয়ে বয়ে আসছে জলের ধারা। গিরিখাতের পাথরে ধাক্কা খেয়ে তা হয়ে উঠছে আরও ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর।
অ্যাথাবাসকা গ্লেসিয়ার অ্যাথাবাসকা ফলস্
বেলা ১টা নাগাদ জেসপারে পৌঁছলাম। টরন্টো-ভ্যাঙ্কুভার রেলপথে জেসপার একটা প্রধান স্টেশন। স্টেশনের কাছেই একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। গাইড বুক দেখে ঠিক হল করলাম যে রোপওয়ে চড়ে হুইসপার মাউন্টেন যাব আর অবশ্যই দেখব লেক প্যাট্রিসিয়া। বেশ কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে আমরাও টিকিট কেটে কাচ দিয়ে ঘেরা গন্ডোলায় উঠলাম। গন্ডোলা খুব ধীরে উপরের দিকে উঠতে লাগল। শহর, পাহাড়, নদী, লেক সব কিছু নীচে রেখে, পাইন গাছের মাথার উপর দিয়ে উঠে এলাম হুইসপার মাউন্টেনের চূড়ায়। চারিদিকে বরফ, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর হাওয়ার শব্দ। নীল আকাশকে মনে হল হাতের খুব কাছে। সে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে যথা সময়ে আবার শহরের জনজীবনে ফিরে এলাম।

দু’পাশে জঙ্গল, মাঝে মাটির রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল পাহাড় আর গাছপালা দিয়ে অতি যত্নে ঘেরা লেক প্যাট্রিসিয়ার দিকে। গাছের ছায়ায় জলের রং হয়েছে ঘন সবুজ। সিরসিরে হাওয়ায় জলে লেগেছে মৃদু কম্পন আর মাঝেমাঝে পাতা পড়ার টুপটাপ শব্দ। একটা কাঠের পাটাতনের উপর বসে রইলাম বেশ কিছু ক্ষণ। উঠে যেতে মন চায় না, কিন্ত উপায় নেই, ঘড়িতে তখন বিকেল চারটে। আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম।


ব্যানফ থেকে জেসপারের পুরো রাস্তাটাই গেছে দু’টি ন্যাশনাল পার্কের ভিতর দিয়ে আর এর দু’দিকের জঙ্গলে আছে গ্রিজলি ভাল্লুক, পাহাড়ি ভেড়া, ক্রয়টি, এল্ক্, মুজ, ইত্যাদি জন্তুজানোয়ার। পুরো অঞ্চলটাই ‘বেয়ার কান্ট্রি’। সকালে আসার সময় ভেড়া ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়েনি। ফেরার পথে তাই আমাদের তীক্ষ্ণ নজর ছিল দু’পাশে।

প্রায় ১৮০ কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখতে পেলাম মা ভাল্লুক তার দুই শাবক নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। গাইড বুকের নিয়ম অনুযায়ী গাড়ি রাস্তার ধারে থামিয়ে হ্যাজারড বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হল পেছনের গাড়িকে জানান দেওয়ার জন্যে। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে লাগল। এই সময় রাস্তায় নামা একদম বারণ। আরও কিছুটা এগিয়ে দেখি রাস্তার একেবারে কাছে বড় একটা ভাল্লুক, মাটি খুঁড়ে গাছের মূল বের করার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিলাম।

সূর্যাস্তের একটু পরেই ব্যানফে পৌঁছে গেলাম— ক্লান্ত, শ্রান্ত, কিন্তু মন খুশিতে ভরপুর।

এক কথায়: অসামান্য সব প্রাকৃতিক মুহূর্ত আর অচেনা জীবজন্তুর সম্ভার এখানকার প্রতিটি দ্রষ্টব্য স্থানে।

হাওড়ার মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে নানা দেশ ঘুরে আপাতত ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেবে বসবাস। নানা রকম রান্না করা ও বই পড়া ছাড়া বেড়ানোও একটা বিশেষ সখ।
ছবি: সন্দীপ মিত্র


রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ