৩ কার্তিক ১৪১৮ শুক্রবার ২১ অক্টোবর ২০১১ |
|
|
|
|
|
|
বঙ্গে কালীপুজোর উদ্ভব ও বিকাশ |
দুর্গাপুজো শেষ হল, শেষ হল লক্ষ্মীপুজোও। এ বার কালীপুজো। বাংলার উত্সবের এক অন্যতম অঙ্গ এই কালীপুজো, যা শ্যামাপুজো নামেও পরিচিত। দুর্গাপুজোর মতোই কালীপুজোও যে ঠিক কে কবে আরম্ভ করেছিল তা সঠিক ভাবে বলা কঠিন, তবে অনুমান করা হয় বাংলায় কালীপুজোর ইতিহাস হয়তো বা দুর্গাপুজোর থেকেও প্রাচীন।
গবেষকরা মনে করেন খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে, মধ্য এশিয়া থেকে আসা আর্য জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসে যে ধর্মাচারণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তারই এক পরিবর্তিত রূপ আজকের হিন্দুধর্ম। সেই সূত্রে আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ— হিন্দু ধর্মের প্রধান আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায় যে বেদের তিন প্রধান দেবতা ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যম আজকের হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবতা নন কেন? এর উত্তর, হিন্দু ধর্ম বলতে আজকের দিনে আমরা যা বুঝি তা আসলে তথাকথিত কোনও একক ধর্ম নয়, এক আচরণ মাত্র— যার মূল প্রোথিত রয়েছে ভারতবর্ষের সনাতন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে। আর্যদের এ দেশে আসার আগে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যে সমস্ত ধর্মাচারণ ছিল, মূর্তিপুজো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আর্যরা এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যতই মিশে যেতে থাকে, এখানকার প্রাচীন আচার-ব্যবহার এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণ আর্য-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে তত বেশি মাত্রায়। এই সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের একটা পর্বে রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারতের মতো দু’খানি মহাকাব্য। মনে রাখতে হবে এই দুই কাব্য কিন্তু ধর্মগ্রন্থ নয়। এই সময়কাল থেকেই ঋগবেদের প্রধান ত্রিদেব ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যমের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন অনার্য দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। পাওয়া যায় মাতৃরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার উপাসনার কথাও।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রবর্তিত হয় বৌদ্ধ ধর্ম। এই ধর্ম প্রাথমিক ভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ উদ্ভুত হলেও, একটা সময়ের পরে, বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর, এর মধ্যেও তন্ত্র-মন্ত্রজাত বিভিন্ন সংস্কার প্রবেশ করে। হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও রয়েছে অজস্র তন্ত্র-গ্রন্থ। বৌদ্ধেরা হিন্দুদের তথাকথিত দেবদেবীতে বিশ্বাসী না হলেও হিন্দু তন্ত্রকে তারা শুধু গ্রহণই করেনি, তাকে আরও পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করেছিল বলা যায়।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে নালন্দা, বিক্রমশীলার বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বৌদ্ধতন্ত্রের চর্চা ছিল। ঐতিহাসিক ও গবেষকদের রচনা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে যে দশ মহাবিদ্যার (কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা) উল্লেখ রয়েছে তা বৌদ্ধ তন্ত্রজাত। এ ছাড়া উগ্রা মহোগ্রা, বজ্রা, কালী, সরস্বতী, কামেশ্বরী, ভদ্রকালী, তারা নামের শক্তির অষ্ট রূপ ও তাদের মন্ত্রাবলীও বৌদ্ধতন্ত্র থেকেই এসেছে। প্রাথমিক পর্বে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে কোনও মূর্তি পুজোর উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালে তার সংযুক্তি ঘটে। সাধনমালা নামে এক বৌদ্ধতন্ত্রে মহা সরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী ও আর্য সরস্বতীর ধ্যানের উল্লেখ রয়েছে। জাপানে চনস্টি নামের এক বহুভুজা দেবীমূর্তিকে বুদ্ধমাতৃকা রূপে আরাধনা করা হয়। তিব্বতি লামারা ঊষার দেবতা রূপে বৌদ্ধ মারিচী দেবীর পুজো করেন। মূর্তি ভেদে তা কখনও দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা, দশভুজা কিংবা দ্বাদশভুজা। সাধারণ ভাবে এই তথ্যগুলি আশ্চর্য মনে হলেও এটাই স্বাভাবিক। ধর্ম অনেকাংশেই লোকাচার সম্ভূত। স্থান-কাল ভেদে মানুষের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস যেমন বদলায়, তেমনই বদলায় ধর্মীয় আচার আচরণও।
বৌদ্ধধর্ম খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রবর্তিত হলেও তা বিস্তৃতি লাভ করেছিল মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (সম্রাট অশোক রাজত্ব করেছেন খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ থেকে ২৩২ অব্দ পর্যন্ত) বা আরও স্পষ্ট ভাবে বলা যায় খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত প্রসার আরম্ভ হয়েছিল। বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতক থেকে এবং তা চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে পাল রাজাদের আমলে। বাংলায় বৌদ্ধযুগে লোকসাধারণের ধর্ম পাল্টাল বটে কিন্তু সংস্কার-লোকাচার রয়ে গেল বহুলাংশেই। এখানকার বিভিন্ন প্রাচীন লৌকিক দেবদেবী এ বার পূজিত হতে লাগল বৌদ্ধ তন্ত্রমন্ত্র অনুসারে।
পাল রাজাদের পর বাংলার শাসন ক্ষমতা আসে সেন রাজাদের হাতে। এঁরা ছিলেন কট্টর হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং বাংলায় হিন্দু যুগ ফিরিয়ে আনার প্রধান হোতা। ইতিমধ্যে শঙ্করাচার্য ও তাঁর অনুগামীদের হাতে বৌদ্ধ বিতাড়নের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে উত্তর ভারতেও ফিরে এসেছে হিন্দু যুগ।
বাংলার শক্তি আরাধনা চলতে লাগল আগের মতোই। তবে তার প্রকৃতি পাল্টে গেল হিন্দু যুগের আচার অনুযায়ী।
কিছু কালের মধ্যেই বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এল এক বিরাট পরিবর্তন। হিন্দু রাজত্ব শেষ হয়ে কায়েম হল ইসলাম শাসন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যে সামাজিক জীবনেও প্রভাব বিস্তার করবে সেটাই স্বাভাবিক। মুসলিমদের ধর্মীয় আগ্রাসন রুখতে আরম্ভ হল ভক্তিবাদ আন্দোলন। বাংলার সমাজ আন্দোলনের এমনই এক সন্ধি ক্ষণে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করলেন শ্রীচৈতন্যদেব। আর তাঁর ভক্তি আন্দোলনের জোয়ারে মেতে উঠল সমগ্র বঙ্গদেশ।
এক দিকে মুসলিম আগ্রাসন, অন্য দিকে চৈতন্য প্রবর্তিত কৃষ্ণপ্রেমের জোয়ার— এই দুইয়ের মাঝে বাংলার সনাতন শক্তি-চেতনা যেন ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যেতে বসেছিল। এমন অবস্থায় ওই নবদ্বীপেই জন্ম নিলেন আর এক যুগস্রষ্টা পুরুষ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। কৃষ্ণানন্দের জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন এক জন বিশিষ্ট শাক্ত তন্ত্রশাস্ত্র পণ্ডিত। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা, শক্তি হিসাবে পূজিত লৌকিক দেবদেবীদের একটি সংহত রূপ দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হন তিনি। পুরাণের বর্ণনা ও লৌকিক মূর্তি সমূহের আকৃতিগত বিভিন্নতা দূর করার জন্য কালীর একক মূর্তি প্রবর্তন করেন কৃষ্ণানন্দ। বর্তমানে আমরা কালীর যে প্রতিমা দেখি তার রূপকার ওই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।
|
|
পরবর্তী কালে বাংলার শাক্ত চেতনাকে জাগ্রত করার কাজে সাধক বামাক্ষ্যাপা, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অবদান বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। একদা লৌকিক দেবী হওয়া সত্ত্বেও, কালীর আর্য দেবতা হয়ে ওঠায় বৌদ্ধ তন্ত্রের অবদান যেমন আছে, আবার লোকসাধারণের দেবী থেকে সর্বজনের দেবী হিসেবে উত্তরণে বাংলার ওই বিশিষ্ট সাধকদের ভূমিকাও কম নয়। |
তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক
নিজস্ব চিত্র |
|
|
|