৩ কার্তিক ১৪১৮ শুক্রবার ২১ অক্টোবর ২০১১


 
দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো
থায় বলে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পয়লা বৈশাখে গণেশপুজো-হালখাতা দিয়ে সূচনা আর চৈত্র সংক্রান্তির গাজনে সমাপ্তি। সেই অনুসারে সারা বছরেই নানা পুজো-পার্বণ থাকলেও বাংলার প্রকৃত উত্সবের মরশুম আরম্ভ হয় দুর্গাপুজো দিয়ে আর শেষ কালীপুজোতে। তিথি নক্ষত্রের হিসেবে আশ্বিন-অমাবস্যা (মহালয়া) থেকে কার্তিক-অমাবস্যা (কালীপুজো)— এই এক মাস কাল হল বাংলার প্রধান উত্সবের মরশুম। দুর্গাপুজো শেষ হলে আসে লক্ষ্মীপুজো এবং তার পরে কালীপুজো তথা দীপাবলি।

দীপাবলি আদতে আলোর উত্সব। বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেই এক ধরনের আলোক উত্সবের কথা বলা আছে। তারই একটি হল হিন্দু তথা ভারতীয় সংস্করণ, দীপাবলি। এই উত্সবে পুজোর থেকেও বেশি উল্লেখযোগ্য হল দীপমালার সজ্জা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতীয় সংস্কৃতির নানা কাহিনি, যেগুলির সঙ্গে কালীর থেকেও বেশি সম্পর্ক লক্ষ্মীর।
প্রচলিত বিশ্বাস হল— কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতেই সমুদ্র থেকে ধন্বন্তরী উঠে এসেছিলেন। তাই এই তিথির নাম ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী বা সহজ কথায় ধনতেরাস। সে জন্য এই দিন ধনের উপাসনা করতে হয় আর ওই দিন একই সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীও সমুদ্র থেকে উঠে আসেন বলে লক্ষ্মীর আরাধনাও করা হয়। লক্ষ্মী পুরাণ অনুযায়ী স্বর্গে ফিরে গেলেন, কার্তিক-অমাবস্যায়। তাই লক্ষ্মীর স্বর্গে ফেরা উপলক্ষে স্বর্গকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল আলোকমালায়। আর একটি কাহিনি অনুসারে, লঙ্কা বিজয় সেরে সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে রামচন্দ্র যে দিন অযোধ্যায় ফেরেন, তিথি হিসেবে সেটি ছিল ওই কার্তিক-অমাবস্যা। ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামের লীলাসঙ্গিনী লক্ষ্মীদেবীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সেই রাতে অযোধ্যা নগরীকে সাজানো হয়েছিল অগণ্য দীপমালায়। অন্য এক কাহিনি আবার বলে, কার্তিক-চতুর্দশীতে কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে তার কারাগারে বন্দি ১৬ হাজার গোপিনীকে মুক্ত করেন। সেই উপলক্ষে, পরের দিন অর্থাত্ কার্তিক-অমাবস্যাতে আলোকমালা সাজিয়ে উত্সব হয়েছিল। দীপাবলিতে দীপ জ্বালানো নিয়ে এমন হরেক কাহিনি প্রচলিত আছে হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্রগুলিতে।

শৈব (শিবের উপাসক), বৈষ্ণব (বিষ্ণুর উপাসক), শাক্ত (শক্তির উপাসক), গাণপত (গণেশের উপাসক), সৌর্য (সূর্যের উপাসক)— ভারতীয় হিন্দু ধর্মের এই পাঁচ উপ-বিভাগের অন্যতম শাক্তদের প্রাধান্য পূর্ব ভারতেই বেশি। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় এই ধারা চলে আসছে। বাংলার উত্সব মরশুমে এই শক্তি আরাধনাই হয় দুর্গা ও কালীপুজোর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মধ্যযুগে চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার প্রাধান্যও লক্ষ করা যায় বাংলার শক্তি আরাধনার ক্ষেত্রে। দেবীপক্ষের শেষ দিন অর্থাত্ আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। আর তার পনেরো দিন পরে কার্তিক-অমাবস্যায় দীপাবলীর দিন হয় কালীপুজো। হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে দেবী কালিকা দুর্গারই আর এক রূপ। শক্তির উপাসকেরা দীপাবলীর দিন কালীপুজো করেন আর সে দিন সারা ভারত জুড়ে বিষ্ণুর উপাসকেরা আরাধনা করেন মহালক্ষ্মীর। বঙ্গদেশেও তার ব্যতিক্রম হয় না। কালীপুজোর রাতে দীপান্বিতায় অলক্ষ্মী বিদায় ও মহালক্ষ্মীর পুজো দিয়ে সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গীয়দের কার্তিক, পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসের লক্ষ্মী পুজোর। এমনকী বাংলার অন্যতম প্রাচীন শক্তিপীঠ মহাতীর্থ কালীঘাট মন্দিরে এই কার্তিক-অমাবস্যায় দীপান্বিতা মহালক্ষ্মীর পুজো করেন হালদার বংশীয় সেবাইতরা। এর কারণ জানতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে অতীতের দিকে।

কালীঘাটের প্রতিষ্ঠা ঠিক কবে হয়েছিল তা বলা খুবই কঠিন। ইতিহাস, পুরাণকথা, কিংবদন্তী মিলেমিশে এমন হয়ে আছে যে তার থেকে এর প্রকৃত উদ্ভবের কাল উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত টলেমির ভারতের ভৌগোলিক বিবরণে এই অঞ্চলে কালীগ্রাম নামের এক জনপদের উল্লেখ আছে! আবার ভবিষ্যপুরাণের এক জায়গায় লেখা হয়েছে,
তাম্রলিপ্ত প্রদেশে চ বর্গভীমা বিরাজতে।
গোবিন্দপুরপ্রান্তে চ কালী সুরধুনীতটে।।

টলেমির কালীগ্রামই যে আজকের কালীঘাট— তার যেমন কোনও প্রমাণ নেই তেমনই টলেমির সমসাময়িক কালে লেখা ভবিষ্যপুরাণে গোবিন্দপুর গ্রামের উল্লেখ প্রায় অসম্ভব। আসলে কালীঘাটের প্রাচীনত্ব ও মহিমা জাহির করতে ওই সব তথ্য হাজির করা হয়েছে অনেক পরে। ইতিহাসগত ভাবে কালীঘাটের কথা জানা যায় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। কথিত আছে, আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে এক দলছুট সন্ন্যাসী ঘুরতে ঘুরতে কালীঘাট অঞ্চলে নির্জন বনের মধ্যে পর্ণকুটির তৈরি করে বসবাসকালে একটি বড় প্রস্থরখণ্ডকে কালীরূপে পুজো করতেন। তিনি এবং ব্রহ্মানন্দ গিরি নামে আর এক সন্ন্যাসী সংলগ্ন কুণ্ড থেকে একটি ছোট পাথরখণ্ড খুঁজে পান। তাঁরা সেই খণ্ডটি সতীর দক্ষিণ পদের কনিষ্ঠ অঙ্গুলী বলে দাবি করেন। পরে সেটিকে বড় পাথরটির নীচে স্থাপন করেন। সতীপীঠ হিসেবে কালীঘাটের পরিচিতির সূচনা তখন থেকেই।

আত্মারাম ও ব্রহ্মানন্দের পর থেকে দীর্ঘকাল মূলত সন্ন্যাসীদের হাতেই ছিল কালীঘাটের পুজোর ভার। তাঁরা প্রধানত শৈব হলেও তন্ত্র মতে শক্তির উপাসনাও করতেন। ইতিমধ্যে শক্তিপীঠ হিসেবে কালীঘাট যথেষ্ট পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রথমে যশোহরের রাজা বসন্ত রায় ও পরে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আনুকূল্যে তৈরি হয়েছে মন্দিরও। সেই সময়ে অন্যান্য শৈব ও শক্তি পীঠগুলির ন্যায় কালীঘাটেও মন্দিরের সেবাপুজো ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার থাকত সন্ন্যাসীদের হাতে। ভুবনেশ্বর গিরি নামে এমনই এক তান্ত্রিক সেবাইত ও তাঁর ভৈরবী যোগমায়ার, উমা নামে এক কন্যা জন্ম নেয়। ওই উমাকে কেন্দ্র করে পাল্টে যায় কালীঘাটের সেবাপুজোর ইতিহাস।

যশোহরের জনৈক পৃথ্বীধর চক্রবর্তীর ছেলে ভবানীদাস তাঁর হারিয়ে যাওয়া বাবার খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে কালীঘাটে উপস্থিত হন। ভবানীদাস আদতে ছিলেন কৃষ্ণের উপাসক কিন্তু নানা কারণে তিনি কালীঘাটে থেকে যান এবং নিজের ইষ্ট দেবতা বিষ্ণুর পাশাপাশি কালীরও উপাসক হয়ে ওঠেন। কালীর পুজোয় ভবানীদাসের নিষ্ঠা দেখে ভুবনেশ্বর গিরি তাঁর সঙ্গে মেয়ে উমার বিয়ে দিলেন এবং তাঁকেই করে গেলেন কালীঘাট মন্দিরের ভবিষ্যত্ উত্তরাধিকারী। শেষ হল সন্ন্যাসীদের যুগ, কালীঘাটের দেবী দক্ষিণাকালীর সেবাপুজোর ভার অর্পিত হল গৃহস্থ-সেবায়েত ভবানীদাস চক্রবর্তীর হাতে। সেই শুরু। কালীঘাটের আজকের সেবাইত হালদারেরা ওই ভবানীদাসেরই উত্তরপুরুষ।

শাক্ত পরিবারের সন্তান হলেও ভবানীদাস নিজে ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক। যশোহরের খনিয়ান গ্রামে ছিল তাঁর কুলদেবতা বাসুদেব। ভবানীদাস কালীঘাটে থাকাকালীন, গ্রামের বাড়িতে তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী-পুত্রেরাই পুজো করতেন কুলদেবতার। কালীঘাট মন্দিরের সব দায়িত্ব পাওয়ার পরে তিনি যশোহর থেকে পরিবারকে নিয়ে আসেন কালীঘাটে। পরে কুলদেবতার বিগ্রহও নিয়ে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করলেন দক্ষিণাকালীর মূর্তির ঘরেই। একই সঙ্গে চলল কালী ও কৃষ্ণের পুজো। বিষ্ণুভক্ত কালীসেবক ভবানীদাসই প্রথম কালীর নাসিকাগ্রে আঁকেন বৈষ্ণবীয় তিলক। সেই প্রথা আজও বজায় আছে। তিলক আঁকার পাশাপাশি কালীপুজোর দিন কালীঘাটে লক্ষ্মীপুজোর প্রবর্তনও করেন তিনি। দীপান্বিতার সন্ধ্যায় এই পুজো হয়, তাই এর নাম দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো।
কালীঘাট মন্দিরে কালীপুজোর সন্ধ্যার এই লক্ষ্মীপুজো একান্ত ভাবেই সেবাইতদের পুজো, এর সঙ্গে কালীঘাট মন্দির কমিটির বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই। অমাবস্যা তিথি থাকলে কালীপুজোর দিন সূর্যাস্তের ২৪ মিনিটের মধ্যে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। তার আগে অবশ্য সেরে নেওয়া হয় অলক্ষ্মী বিতাড়ন পর্ব। তিন বা চার ইঞ্চি মাপের অলক্ষ্মী পুতুল তৈরি করা হয় গোবর বা জলে চটকানো পিটুলি (চালবাটা) দিয়ে। সেটিকে রাখা হয় মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে। এ বার অলক্ষ্মী পুতুলের সামনে পাটকাঠিতে আগুন লাগিয়ে সেবাইতরা তিন বার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। আর জোরে জোরে কুলো বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদায় করে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। এটি যেহেতু সেবাইতদের পুজো তাই নিরামিষ ভোগ আসে সেবাইতদের বাড়ি থেকেই। সেগুলি রাখা হয় কালীমূর্তির সামনেই। আবার কালীর যে হেতু আমিষ ভোগ, সেখানে মাছ-মাংসও থাকে, সেগুলিও রাখা হয় তার পাশেই, তবে লক্ষ রাখা হয় যেন আমিষ ও নিরামিষ ভোগ ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়। ভোগ ছাড়াও সেবাইতরা দেন তাঁতের শাড়ি। সেগুলি কালীর অঙ্গেই পরানো হয়। ভোগ-বসন সাজানোর পরে পুরোহিত পুজো শুরু করেন। প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে হয় কালীপুজোর সন্ধ্যার ওই দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো।

হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে লক্ষ্মী ধন-সম্পদ-সৌভাগ্যের দেবী। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে লক্ষ্মীপুজোর আলাদা এক গুরুত্ব আছে। বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালির ঘরে সোমবচ্ছর উপাচার, নৈবেদ্যর বাহুল্য ছাড়াই লক্ষ্মীর উপাসনা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে পুরোহিতেরও প্রয়োজন হয় না। সামান্য ফল-ফুল আর পাঁচালি-ব্রতকথা দিয়েই সারা হয় বাঙালি গৃহবধূর লক্ষ্মী-আরাধনা। কলকাতার অনেক বনেদি বাড়িতে এখনও কালীপুজোর সন্ধ্যায় দীপান্বিতা লক্ষ্মীর পুজো হয় নিয়ম মেনে।

তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক
নিজস্ব চিত্র

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.