৩ কার্তিক ১৪১৮ শুক্রবার ২১ অক্টোবর ২০১১


 
...স্মৃতিতে ও মননে
মার শৈশব এখন বহু দূরে। তবু মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি সেই দিনগুলো। স্মৃতি সততই রঙিন। হয়তো যতটা রঙিন ছিল না, তার চেয়েও রাঙিয়ে রেখেছে আমার মন তাকে।

জন্ম ভবানীপুরে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বেলতলা স্কুলে ভর্তি হই, সেই আমার প্রথম চার দেওয়ালের বাইরে পা ফেলা। স্কুলের পথে ঝরে পড়া বকুল কুড়োই, শরতে শিউলি কুড়োই, বর্ষার হাঁটু জলে ছলাৎ ছলাৎ করে বাড়ি ফিরি, আর গান শুনি। একই গান, প্রথম কলিটা স্কুলের কাছাকাছি কোনও বাড়ি থেকে ভেসে এল হয়তো, তার পর হাঁটতে হাঁটতেই অন্য বাড়ি থেকে ভেসে আসে একই গানের অন্যান্য লাইন। এ যেন এক মজার খেলা!

আমার জীবনটা ভবানীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবই কাছাকাছি। শুধু মামারবাড়ি ছিল শ্যামবাজারে। প্রতি রবিবার বাসে করে যেতাম সেখানে। মনে হত কত দূর, যেন পৃথিবীর অন্য প্রান্ত। সেখানে শুধু মামা-মামিরাই নয়, আশপাশের বাড়ির লোকেরাও হৈ হৈ করে উঠত। তারা আমাদের বলত ‘সাউথ’-এর লোক। ওদের বিশাল থামের রাজকীয় প্রাচীন বাড়ি, এক ছাত থেকে অন্য ছাতে লাফিয়ে যাওয়া, অত্যন্ত বেশি আপন আপন ভাবটা আমাদের নতুন লাগত।

বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তাম বাসে। মাঝে মাঝেই পাশের লোকের কাঁধে ঢলে পড়ত মাথা। বাসের ঝাঁকুনিতে জেগে উঠে দেখতাম কাঁধ বদল হয়ে গেছে। এই ভাবে যেই লিপটনের বিখ্যাত চায়ের বিজ্ঞাপনের কেটলিটা দেখতাম চৌরঙ্গির মোড়ে এবং মোনাকো বিস্কুটের বিজ্ঞাপন পূর্ণর মোড়ে, তখনই মন খারাপ হত— বুঝতাম বাড়ি এসে গেছে। পর দিন সকালে আবার সেই স্কুলে যাওয়া, প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে সেই এক গান “মোরা সত্যের ’পরে মন...”।

কয়েক বছর পরে নতুন স্কুল ডায়োসেশানে ভর্তি হই। এ বারে আর পুরোটা হাঁটাপথ নয়, ট্রামে চড়ে এলগিনের মোড়ে নেমে বাকিটুকু হাঁটা পথ। কিন্তু স্কুলে পৌঁছাতে মাঝে মাঝেই দেরি হয়ে যেত বলে মা মাসকাবারি রিকশা ঠিক করে দিলেন। বাহন বদল হল, সঙ্গে পথও। গিরীশ মুখার্জী রোড ধরে উত্তরকুমারের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে আমার রিকশা। কিন্তু তাঁর দেখা পাই না কখনওই।

উত্তমকুমার!

মহানায়ক উত্তমকুমার ছিলেন আমার বাবার সহপাঠী, সাউথ সাবার্বান স্কুলে। পিসিমাদের কাছে শুনেছি উনি স্কুলে পড়ার সময় বেশ কয়েক বার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। মা অবশ্য কোনওদিন দেখেননি। বাবা তো কবেই মারা গেছেন, তা বলে কি উত্তমকুমারকে ‘পিতৃতুল্য’ বলা যায়! উনি ছিলেন কলকাতার যাবতীয় মহিলা, মাসি, পিসি, কাকিমাদের ‘হার্টথ্রব’। মায়েরও অত্যন্ত প্রিয় পুরুষ এবং অবশ্যই আমারও।
------------
তখন গানটা ছিল শুধুই শ্রবণের। এখন যেমন স্টেজ পারফরম্যান্স খুব গুরুত্বপূর্ণ, গানের সঙ্গে নাচতে জানলে তার খাতিরই আলাদা, আমাদের সময় তেমনটা ছিল না। পুজোর পর ওই প্যান্ডেলেই বিশাল জলসা হত। কত যে বিখ্যাত লোকের গান শুনেছি সারা রাত জেগে। শুধু নিজেদের পাড়ায় নয়, কাছাকাছি পাড়াতেও জলসা শুনতে গেছি বহুবার। সঙ্গে হাল্কা শাল, ভোরের দিকে শীত শীত করে যে!

মনে আছে একবার উত্তমকুমারের পাড়ায় রাতভর জলসা শুনতে গেছিলাম এক বন্ধু ও আমরা সপরিবারে। কথা ছিল শেষ রাতে তিনি আসবেন স্টেজে। গান শুনছি, কিন্তু ভেতরটা অস্থির। মাঝে মাঝেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত রাত দু’টোর কাছাকাছি সময়ে এলেন ওঁর স্ত্রী। কানে ঝোলা দুল, মুখে পান। একটু নিরাশ হলেও তত ক্ষণে নির্মলেন্দু চৌধুরী এসে গেছেন আসরে। আসর জমানোর দারুণ ক্ষমতা ছিল ওঁর।

নির্মলা মিশ্র গাইতে এলে সবাই যখন “ও তোতা পাখিরে...” গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে, আমার দুষ্টু দিদি কানে কানে বলল, “দেখবি, গানটার শেষে উনি কাঁদবেন।” আর আশ্চর্য, হলও তাই! রুমকি, চুমকির নাচ হল শোলের বিখ্যাত “আ, যব তক হ্যায় জান...” গানের সঙ্গে। উহ্! সে কি সিটি ছেলেদের।

আর ছিল সঙ্গীত সম্মেলন। যদিও এ হল অন্য পরিবেশ, তবু ভরা প্রেক্ষাগৃহে ধ্রুপদী সঙ্গীত আর বাজনার আসর শুনে রাত ভোর হয়ে আসত। ডোভার লেন ছাড়াও ছিল সদারঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন। অতি উৎসাহীরা হলের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকতেন একটা টিকিট পাওয়ার আশায় অথবা ভেসে আসা গান শোনার বাসনায়। আকাশ লাল হয়ে আসে, ভীমসেন যোশী ধরেছেন ভৈরবী। সে এক অন্য জগৎ।
------------
পুজোয় যেমন ছিল গান, তেমন ছিল পুজোসংখ্যা। পুজোর ঠিক আগেই হাতে আসত আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ ইত্যাদি। আমাদের বাড়িতে যে কোনও বই এলেই কে আগে পড়বে এই নিয়ে ঝগড়া লেগে যেত। প্রথমে বই পড়ে নিয়ে অন্যদের পড়া না হওয়া পর্যন্ত তা নিয়ে কোনও আলোচনা করা যাবে না— এটাও ছিল অন্যতম শর্ত। তবে ভাল লেখা পড়লে উত্তেজনা দমন করা ছিল কঠিন। আমি ছিলাম ভাবের জগতে থাকা মেয়ে। অন্যান্য অনেক প্রলোভন ছেড়ে বইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি অনেক সময়। পুজোর আগে দিদি আর মা যখন বাজারের শেষ (শেষ কি আর হয়!) টুকিটাকি কিনতে গেছেন, আমি তখন মগ্ন হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মেঘ, বৃষ্টি, আলো’ পড়ছি। সন্ধে হয়ে গেছে, ঘর অন্ধকার হয়ে আসছে তবু উঠে আলো জ্বালানোর অবস্থায় নেই, এতই তন্ময় হয়ে শেষ ক’টা পাতা পড়ছি। জয়শ্রী আর অনুরাধা এই দুই নায়িকা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তবু ওদের জীবনে প্রবেশ করতে অসুবিধা হয়নি আমার। আর সেই সঙ্গে সেই সময়ের কলকাতার প্রেক্ষাপট, গড়িয়াহাটের মোড়, ভিক্টোরিয়ার সামনে কলাবতী ফুলের গাছ...। এই লেখাটা পড়ে লেখককে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু পোস্ট করিনি আজও।

তখন শপিং মল তো দূরের কথা, তেমন ভাল দোকান ছিল না কলকাতায়। আমাদের বড়লোকিয়ানা সীমাবদ্ধ ছিল প্রথমে নিউ মার্কেট ও পরে ট্রেজার আইল্যান্ডে। আর ছিল হকার্স কর্নার। কাজের লোকের কাপড় কেনার জন্য যাওয়া হত। আর সে কি দরাদরি! দুশো টাকার শাড়ি ষাট টাকায় দিল দোকানদার। পাশের বাড়ির মাসিমা ডেকে বললেন, এই একই শাড়ি উনি কিনেছেন চল্লিশ টাকায়। সে সব কত মজার ঘটনা!
------------

ভবানীপুরে পর পর অনেকগুলো সিনেমা হল ছিল বলে, আমার আত্মীয়রা অনেকে খুব আফশোস করত। আমাদের অবশ্য বিশেষ কিছু লাভ হত না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে এক দল নাইট-শো দেখা লোক উচ্চস্বরে গল্প করতে করতে আমাদের গলিটা পেরিয়ে যেত। উজ্জ্বলার চানাচুর ছিল বিখ্যাত। সেই চানাচুরের বিশেষত্ব ছিল টাটকা গরম ভাজা। বসুশ্রী সিনেমার উপরে নাকি তখন কলকাতার নাম করা ‘স্টার’দের আড্ডা ছিল। আর কালিকা সিনেমা হল ছিল ছারপোকার জন্য বিখ্যাত। রুপালি সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যেতে ভয় লাগত। শহরের হবু মাস্তানরা নাকি ওখানে দাঁড়িয়ে টিকিট ‘ব্ল্যাক’ করত— তাদের চোখগুলো টকটকে লাল। পাশেই গাঁজাপার্কে একরকম ভাজা কাবাব পাওয়া যেত, আমাদের খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু পরে জেনেছিলাম ওগুলো গাঁজাখোর বা মাতালদের জন্য।

কলকাতায় এত রেস্তোরাঁ ছিল না তখন। খুব সকালে হরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গুটি কচুরি আর হালুয়া পাওয়া যেত ব্রাউন পেপারের ঠোঙায়— অসাধারণ তার স্বাদ! যেতে একটু দেরি হলে খালি হাতেই ফিরতে হত দাদাকে। দ্বারিকের কড়াইশুঁটির কচুরি আর ছোলার ডাল নিয়ে ভবানীপুরবাসীদের গর্বের শেষ ছিল না। এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে গেলে অনাদির মোগলাই কিনে বাড়ি ফিরতাম। সেই মোগলাই পরোটা বানানোর কায়দাটাই ছিল দেখার মতো।

নিউ মার্কেটে নাহুমের ক্রিমরোল, টিনের বাক্সের গরম প্যাটিস অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অন্য প্রদেশের ভেলপুরির প্রথম স্বাদ নেওয়া— সব পেছনে ফেলে এসেছি বহু বহু দিন। এই সবই আমার কলকাতা।

দীর্ঘদিন প্রবাসে আছি। প্রতি বছরই কলকাতা যাই। কলকাতা এখন অনেক পাল্টে গেছে এবং তার অনেকটাই ভালর দিকে। আমার কলকাতাকে আর খোঁজার চেষ্টা করি না। আজকের কলকাতা আমি আজকের নবীন-কিশোরদের উপহার দিয়েছি। আমার কলকাতা থাকুক আমার স্মৃতিতে, আমার মননে।



 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.