দু’শো বছরের জাদু আজও অম্লান
সে দিন সারি সারি গরুরগাড়ি চৌরঙ্গির জাদুঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাতে নাকি ছিল অমূল্য সব ধন সম্পদ!
তখনও ভারতের রেল-মানচিত্র অসর্ম্পূণ। তাই সুদূর মধ্যপ্রদেশের ভারহুত গ্রাম থেকে গরুরগাড়ি চেপেই মৌর্যসম্রাট অশোকের সময় তৈরি স্তূপের তোরণ এবং রেলিংগুলি ১৮৭৫ সালের ওই দিনে জাদুঘরে এসে পৌঁছেছিল স্যর আলেকজান্ডার ক্যানিংহ্যামের উদ্যোগে।
এমনই বহু স্মরণীয় ঘটনাকে সাক্ষী রেখেই সম্প্রতি ২০০ বছর পেরলো ভারতীয় সংগ্রহালয়।
এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো এবং বৈচিত্রময় সংগ্রহ দেখতে এসে প্রতি দিন অসংখ্য কৌতূহলী চোখ খুঁজে বেড়ায় অদেখা অজানা বিস্ময় মিশরের মমি হোক বা ডায়নোসরের জীবাশ্ম, ভারহুত স্তূপের তোরণ কিংবা সমুদ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা, অথবা মানভূমের প্রসিদ্ধ দুর্গামূর্তি বা হাতির দাঁতের তৈরি তাজমহল।
সাজানো গ্যালারি দেখতে দেখতে আজও দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় দু’শো বছরের বহু অজানা কাহিনি। জাদুঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি আজও হাতছানি দেয় দর্শকদের।
কিন্তু শুরুর দিনগুলো ছিল অন্য রকম। কোপেনহাগেন থেকে শ্রীরামপুরে এসে ডেনমার্কের এক কলোনিতে ওঠেন ড্যানিশ উদ্ভিদবিদ ন্যাথানিয়াল ওয়ালিচ। ১৯০৮-এ ব্রিটিশদের হাতে অবরুদ্ধ হয় ওই কলোনি। বন্দি হন ওয়ালিচ। পরে যদিও তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য কারামুক্ত হন তিনি। তত দিনে এশিয়াটিক সোসাইটি-তে চিঠি দিয়ে একটি মিউজিয়াম তৈরির অনুরোধ জানিয়েছিলেন ওয়ালিচ। শুধু তাই নয়, নিজের সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য গাছগাছালি মিউজিয়ামে দান করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। অবশেষে ১৮১৪-র ২ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটের এশিয়াটিক সোসাইটি-র বাড়িতেই ন্যাথানিয়াল ওয়ালিচের তত্ত্বাবধানে এক সংগ্রহালয়ের সূচনা হয়।
এর পর শুরু হল দেশ বিদেশ থেকে আকর্ষণীয় এবং দুর্লভ নিদর্শন সংগ্রহের পালা। সে যুগের সাহেব-মেমদের পাশাপাশি বাঙালি বাবুরাও দান করেছিলেন অদ্ভুত সব নিদর্শন। জাদুঘরের ২০০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে বহু নামের হদিশ মিলবে, যাঁদের দান সমৃদ্ধ করেছে এই সংগ্রহালয়কে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শোভাবাজার রাজপরিবার, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরপরিবার, রাজশাহির জমিদার পরিবার, নাহার পরিবার প্রমুখ। সাম্প্রতিক কালে অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী তাঁর গণেশ মূর্তির সংগ্রহ জাদুঘরে দান করেছেন। সেই প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এই সংগ্রহালয়ের সঙ্গে কিছু মানুষ যুক্ত ছিলেন যাঁদের অবদান আজও অবিস্মরণীয়। এঁদের মধ্যে অন্যতম স্যর জন অ্যান্ডারসন, স্যর আলেকজান্ডার ক্যানিংহ্যাম, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ননীগোপাল মজুমদার প্রমুখ।
শুধু ভবনটি নয়, প্রদর্শবস্তুগুলিরও চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে। তেমনই কিছু না-জানা কথা শোনা গেল সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর কাছে। যেমন পান্নাখচিত শাহজাহানের পানপাত্র এবং আংটি রয়েছে এখানেই। ইতিহাস বলে, নাদির শাহ এ দু’টি সঙ্গে নিয়ে যান। অনেক পরে এই পানপাত্র এবং আংটি মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহের হাতে আসে। তার পর লর্ড ডালহৌসি এগুলি কিনে নিয়েছিলেন। শেষে ১৯২১ সালে ডালহৌসির জামাই কর্নেল ডব্লিউ এইচ ব্রাউনের কাছ থেকে ভারত সরকার এগুলি কিনে নেয়। তেমনই পাথুরিয়াঘাটার রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের দেশ-বিদেশের অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে এখানেই। আছে মানুষের হাড়ের তৈরি অলঙ্কার। এগুলি ব্যবহার করতেন তিব্বতীয় এক তান্ত্রিক সম্প্রদায়। কিংবদন্তী, রাতের অন্ধকারে নাকি আলো ঠিকরে বেরোয় ওই অলঙ্কার থেকে। তেমনই মিশরের সেই মমিকে নিয়েও রয়েছে অদ্ভুত সব কাহিনি।
দু’বার এই সংগ্রহালয়ের সংগ্রহ দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, ১৯৩০ এবং ১৯৪৯-এ। তবে প্রবল প্রতিবাদের ফলে তা সম্ভব হয়নি।
জাদুঘরের প্রসঙ্গ এসেছে সে যুগের বিখ্যাত মানুষের রচনায়। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সুরধুনী কাব্য’ হোক বা অবনীন্দ্রনাথের ‘বাদশাহী গল্পে’ গদ্য-পদ্যে লেখা ভূতেদের জাদুঘরের বর্ণনা। আসলে অতীত এবং বর্তমানের মাঝে জাদুঘরএকটা সেতু।
দু’শো বছর উদযাপন উপলক্ষে সংস্কারের সময় উঠেছে মূর্তি ভাঙার বিতর্ক। তবুও নতুন করে সেজেছে বেশ কিছু গ্যালারি। হয়েছে সংগ্রহালয় ভবনটির ভিতর ও বাইরের সংস্কার। এখনও বাকি বেশ কিছু গ্যালারি সংস্কারের কাজ। তাই সংস্কারের পরে জাদুঘরের সেই জাদু আজ কতটা অম্লান সেটা দর্শকরাই বিচার করবেন বলে আশা কর্তৃপক্ষের।

জাদুঘরের দিনপঞ্জি
• ১৮১৪-র ২ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটের এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়িতেই ন্যাথানিয়াল ওয়ালিচের তত্ত্বাবধানে সংগ্রহালয়ের সূচনা।
• ১৮১৪ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত সংগ্রহালয় ছিল এশিয়াটিক সোসাইটির বাড়িতে।
• ১৮৭৮-এ সংগ্রহালয় স্থানান্তরিত হয় বর্তমান ভবনটিতে। ভবনটির নকশা করেছিলেন ওয়াল্টার বি গ্রানউইল।
• প্রথমে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়াম’ পরে নাম বদলে ‘ইমপিরিয়াল মিউজিয়াম’। পরবর্তী কালে সেটাও বদলে হয় ‘ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম’।
• প্রথমে ছিল মাত্র দু’টি গ্যালারি। পরবর্তী কালে শিল্প, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, প্রাণিতত্ত্ব এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অন্তর্গত গড়ে ওঠে অসংখ্য গ্যালারি।
• ১৯১৪-এ শতবার্ষিকী উদযাপন।
• ২০১৪-এ দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন।

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.