|
|
|
|
|
নতুন রাজাকে চলতে হবে সত্যের পথেই
আমলাতন্ত্র ও রাজনীতি-প্রশাসনে অধিক গণতন্ত্র অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের
পথে বাধা। জনসভায় কি ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
|
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে বেশ কয়েকটি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। এই বিদ্রোহগুলি, বিশেষত দোয়াবের বিদ্রোহ তো ছিল ব্যাপক, দীর্ঘস্থায়ী আর রক্তাক্ত।
এখন ঐতিহাসিকেরা বলছেন, ওই সব বিদ্রোহর মাত্রা ও ব্যাপকতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই যে ওই সময়কালের তীব্র আর্থিক সঙ্কটই ছিল এই সব বিদ্রোহের মূল কারণ। ইতিহাসের প্রধান বিচার্য বিষয় আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। কিন্তু ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যক্তিও সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, তা সে সামন্তবাদই হোক বা আজকের আধুনিক উদারবাদী গণতন্ত্র। |
|
আলাউদ্দিন খিলজি মোটামুটি একই সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রে সফল হলেও মহম্মদ তুঘলক চরম ব্যর্থ হয়েছিলেন কেন? মহম্মদ তুঘলক দোয়াবে রাজস্ব বৃদ্ধির সময় সেখানকার কৃষকদের মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেননি। দোয়াবের সম্পন্ন ও সমৃদ্ধশালী কৃষকগণ, বিশেষত খুত মুকদ্দম প্রভৃতি শীর্ষস্থানীয় কৃষক ছিলেন সাহসী, নির্ভীক ও স্বাধীনচেতা। তাঁরা সরকারি কর্তৃত্ব সহজে মেনে নিতেন না। আর সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে প্রায়ই বিদ্রোহ করতেন। দোয়াবের বিদ্রোহী কৃষকদের দমন করার জন্য সুলতান গিয়াসুদ্দিন বল বন এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অভিযান চালান। গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করেন, কৃষকদের হত্যা করে তাদের বিদ্রোহ দমন করা হয়।
কিন্তু আলাউদ্দিন খিলজির ব্যবস্থা দেখে মনে হয়, তিনি প্রতিটি সিদ্ধান্ত গভীর ভাবে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করতেন। তিনি যখন দোয়াবের রাজস্ব বৃদ্ধি করেন তখন তিনি নতুন নতুন রাজ্য জয় ও বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করেন। একাধিক বার মোগল আক্রমণ প্রতিরোধ করে সাফল্য ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে তিনি অবস্থান করছিলেন। মূল্যহ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ করে কৃষকদের বোঝাও অনেকটা কম করে দিলেন। সরকারি কর্মচারীরা যাতে ঘুষ না নেয়, কৃষকদের উপর নিপীড়ন না করে সেটাও তিনি দেখতেন। |
নরেন্দ্র মোদী |
মনমোহন সিংহ |
|
মহম্মদ তুঘলক আর আলাউদ্দিন খিলজি— এই দুই চরিত্রের তুলনার সাতকাহন কেন?
কারণ একটাই।
ইতিহাসের পটেই লুকিয়ে থাকে সাম্প্রতিক।
ভোটযুদ্ধে ভারত অবতীর্ণ। রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজ ছিল কানাডার গভর্নর জেনারেলের সৌজন্যে। গত সোমবার ভোজসভায় দেখা হল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে। গত দশ বছর ধরে ওঁকে দেখছি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে। কত বার ওঁর সঙ্গে বিদেশ সফর করেছি। কিন্তু এ বার ওঁকে দেখলাম, বড় ক্লান্ত, ভিড়ের মধ্যেও যেন একাকী। খুব অসহজ। আসলে উনিও বোধহয় বুঝতে পারছেন ইতিহাসে উনিও একজন ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই বর্ণিত হবেন। পরমাণু চুক্তির সময় সংবাদমাধ্যমই বলেছে, দ্য সিং ইজ কিং। আর আজ সেই তিনিই ভোটের আগে পরাজিত নায়ক। এর জন্য হতে পারে প্রধানমন্ত্রী মনে মনে বলছেন, আমি কী করব? আমি সংবিধানে ফার্স্ট অ্যামং ইকোয়ালস। কিন্তু আসলে তো গত দশ বছর আমিই ছিলাম নম্বর-টু। প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি টি কে নায়ারকে সরিয়ে পুলক চট্টোপাধ্যায়কে আমার সচিব করে দেওয়া হল আমার মতামতকে উপেক্ষা করে। কপিল সিব্বল আর অশ্বিনী ছাড়া আর কোন মন্ত্রীকে বলব, আমার সৈনিক? তলে তলে সকলেই তো ১০ জনপথ। ক্ষমতার উৎস ছিল ১০ জনপথ।
জওহরলাল নেহরু |
সামাজিক প্রকল্প থেকে বাজেট— সবই তো ছিল কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তবু ’৯১ সালে নরসিংহ রাও ও তাঁর নম্বর টু মনমোহন সিংহের মতাদর্শগত বা নীতিগত সংঘাত ছিল না। এখানে তো বিসমিল্লায় গলদ। প্রথম থেকেই সমাজতন্ত্রী হয়ে গেলেন। মন্টেক আর চিদম্বরম তো কিছুই করতে পারলেন না।
কিন্তু মনমোহন সিংহ মনে মনে এ কথা যদি বলেনও, তার পরেও বলব, তাঁর ব্যক্তিত্বের অভাব কর্তৃত্বকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে। আজ ভারতের যে আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থা তাতে প্রয়োজন এক সবল ও কঠোর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ’৪৭ সালে তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখনও এ দেশের আর্থসামাজিক সঙ্কট ছিল চরমে। নেহরু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়মিত চিঠি লিখতেন। সে সব চিঠিতে দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার কথা বার বার তিনি বলেছেন, সতর্ক করেছেন রাজ্যের সরকারকে। সমস্যাগুলি চিরপুরাতন। আজও এই সব সমস্যায় ভারত জেরবার। নেহরু প্রশাসনিক ভাবে কতটা সফল, কতটা অসফল এ সব নিয়েও প্রচুর বিতর্ক আছে। গাঁধীর স্বয়ংশাসিত গ্রামীণ অর্থব্যবস্থাকে সরিয়ে ভারী শিল্প ও নগরায়নের পুঁজিবাদী পথে নেহরুর দ্রুত হাঁটতে চাওয়া ঠিক ছিল কি না, সে-ও এক বিতর্কের বিষয়।
ইন্দিরা গাঁধী |
কিন্তু নেহরুর ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্ব শত সমস্যাতেও ’৬২ সাল পর্যন্ত অটুট ছিল। ’৬২ সালে চিন আগ্রাসনের পরে দু’বছরের মধ্যে তাঁর মৃত্যুও হয়। ইন্দিরাও দীর্ঘ দিন ছিলেন এক প্রবল কর্তৃত্ব। অটলবিহারী বাজপেয়ীর স্টাইলও ছিল ভিন্ন। দলটাও আলাদা, উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ চতুর নেতার স্টাইলটাও ছিল আলাদা। বাজপেয়ী খুঁটিনাটি সমস্যায় নাক না গলিয়ে সে সব লালকৃষ্ণ আডবাণীর হাতে তুলে দিয়ে মূলত নীতি নির্ধারণের কাজ করতেন। সারা দিন বেশি লোকের সঙ্গে দেখা করতেন না।
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী সফল এ ব্যাপারে কিন্তু কোনও বিতর্ক নেই। এই সাফল্য শুধু গুজরাতের নিজস্ব অর্থনীতি ও ব্যবসার অনুকূল গুজরাতি মানসিকতার জন্য, এ কথা বললে সম্ভবত মোদীর প্রতি অবিচার করা হবে। মোদী নিজের প্রবল ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করেছেন ধীরে ধীরে। নিন্দুকেরা বলেন, মোদীর মধ্যে আছেন এক লুক্কায়িত হিটলার। কিন্তু এ কথাও সত্য, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতি-প্রশাসনে অধিক গণতন্ত্র অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে বাধা। জনসভায় কি ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?
অটলবিহারী বাজপেয়ী |
ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ আজও এক জনপ্রিয় গ্রন্থ বিশ্ব সমাজে। আসলে ‘রিয়েল পলিটিকা’র প্রিন্সকে সম্ভবত এই দুঃসহ দুর্দিনে আমরা সবাই খুঁজছি। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, রাজাকে চলতে হবে সবাইকে নিয়ে। শুধু কয়েক জন শহুরেকে নিয়ে নয়, চলতে হবে প্রান্তিক, অন্ত্যজ ও বনবাসীদের নিয়েও। শুধু তা-ই নয়, রাজাকেও বিকশিত হতে হবে। মগ্ন হতে হবে আত্মচর্চায়।
আজ আমাদের নতুন প্রধানমন্ত্রীকেও হতে হবে এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি গোটা ভারতের নানা ভাষা নানা মতের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ম্যাকিয়াভেলি বা কৌটিল্য, দু’জনেই একটা কথা বলেছিলেন— রাজাকে মিথ্যার আশ্রয় নিলে চলবে না। তাঁকে সত্যের পথে থাকতেই হবে। কারণ, তা না হলে তিনি রাজধর্মচ্যুত হবেন। প্রশাসনিকতা সফল হতে পারে একমাত্র সত্যের পথে। তাই আজকের মিডিয়া-ম্যানেজমেন্ট দেখে মাঝে মাঝে ভয় হয়। রাজা সত্যের পথেই চলবেন তো? তা সে রাজা যে-ই হোন না কেন! |
পুরনো সমাচার: সংসদীয় রাজনীতিতে নতুন ব্র্যান্ড কেজরীবাল |
|
|
|
|
|